একটি কবিতা কখনো শুধু শব্দের বাহার নয়— তা হয়ে ওঠে এক জাতির আত্মপরিচয়, লোকজ ভাষার গন্ধমাখা এক জীবন্ত ইতিহাস। এমনই এক কবি, যিনি তার কলমে বুনেছেন বাংলার মাটি, মানুষ, ধর্ম, প্রেম আর প্রতিবাদের প্রতিধ্বনি— তার নাম আল মাহমুদ। আজ, ১১ জুলাই ২০২৫, তার ৮৯তম জন্মদিনে আমরা স্মরণ করছি সেই সৃষ্টিশীল ও বিপ্লবী কবিকে, যার কবিতার জগতে গ্রামীণ বাংলা পেয়েছে আপন ঠিকানা।
একজন কবির জন্ম নয়, এক ভাষার নবজাগরণ
১৯৩৬ সালের এই দিনে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মৌড়াইলে জন্ম নিয়েছিলেন মীর আবদুস শুকুর আল মাহমুদ। ছোট্ট শহরের সেই মোল্লা বাড়ি থেকেই যাত্রা শুরু করেছিল এক সাহসী কবির, যিনি পরবর্তীতে হয়ে উঠেছিলেন বাংলা সাহিত্যের এক অপ্রতিরোধ্য কণ্ঠস্বর। তার লেখায় উঠে এসেছে বাংলা মুসলিম মধ্যবিত্ত সমাজের অপ্রকাশিত ইতিহাস, যা আগে এতটা গভীরভাবে সাহিত্যে দেখা যায়নি।
‘সোনালি কাবিন’ থেকে শুরু এক আলোকবর্তিকা
বাংলা কবিতার ধারায় ‘সোনালি কাবিন’ যেন এক মাইলফলক। এটি কেবল একটি কাব্যগ্রন্থ নয়, বরং এক সাংস্কৃতিক চেতনার বিস্ফোরণ। লোকজ শব্দ, মাটি-ঘেঁষা উপমা আর ধর্মীয় ভাবনার সাহসী উপস্থাপনায় এই কবিতা আজও পাঠকের হৃদয়ে অম্লান।
‘সোনার দিনার নেই, দেনমোহর চেয়ো না হরিণী
যদি নাও, দিতে পারি কাবিনবিহীন হাত দু’টি’ — আল মাহমুদ
যুদ্ধ, সাংবাদিকতা আর সাহিত্যের সমান্তরাল জীবন
আল মাহমুদ ছিলেন কেবল কবি নন। তিনি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সৈনিক, সাংবাদিক, সম্পাদক এবং সমাজের সত্য বলার এক নিঃসঙ্গ যোদ্ধা। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণের পাশাপাশি প্রবাসী সরকারের দায়িত্ব পালনের ভূমিকা পালন করেন। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে প্রতিষ্ঠিত সরকার বিরোধী সংবাদপত্র দৈনিক গণকণ্ঠ (১৯৭২-১৯৭৪) পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। তার কলম কখনো ক্ষমতার কাছে মাথানত করেনি।
একান্ত গ্রামীণ, অথচ অসীম আধুনিক
আধুনিকতা মানেই শুধু শহুরে ভাব নয়—আল মাহমুদ তা দেখিয়েছেন। তার কবিতায় ‘দেওয়ানবাগী’, ‘ঘুঘুর ডিম’, ‘হিজড়ার গান’ বা ‘কাফনের কাপড়’ এসেছে অকপটভাবে, এসেছে মসজিদের মিনার থেকে বটতলার গানে। এসব শব্দ, যেগুলো একসময় সাহিত্যে পরিহার্য ছিল, তিনিই তা দিয়েছেন সম্মান আর হৃদয়ের আসন।
প্রাপ্তির ঝুলিতে বহু পুরস্কার, তবুও এক নিঃসঙ্গ প্রস্থান
বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদক, কলকাতার ‘ভানু সিংহ’ সম্মাননাসহ বহু পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন তিনি। কিন্তু বার্ধক্যের শেষ প্রান্তে তাকে ঘিরে ছিল নীরবতা, বিতর্ক আর উপেক্ষা। ২০১৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি, ঢাকার একটি হাসপাতালে নিঃশব্দে থেমে যায় এক দ্রোহী কবির হৃদয়।
আজ কেন স্মরণ জরুরি?
এই সময়ে, যখন সাহিত্য বাজারের পণ্যে রূপ নিচ্ছে, তখন আল মাহমুদের মতো কবিরা আমাদের শেখান—কবিতা হতে পারে প্রতিবাদ, হতে পারে পরিচয়ের অস্ত্র। তার ‘ধর্ম ও দেশচেতনা’ নিয়ে বিতর্ক থাকলেও সাহিত্যিক অবদান নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। তিনি ছিলেন সময়েরও আগে, আবার সময়েরও গভীরে।
শেষ কথা
আজ তার ৮৯তম জন্মদিনে আমরা যদি সত্যিই তাকে শ্রদ্ধা জানাতে চাই, তবে দরকার তার কবিতা আবার পড়া—নিজস্ব শব্দে, নিজস্ব ভাষায়, নিজের শিকড়ে। কারণ, আল মাহমুদ কেবল কবি নন, তিনি এক চিরকালীন প্রতিধ্বনি—আমাদের ভাষা, আমাদের আত্মপরিচয়ের।
‘তুমি ভুলে গেলেও কবিতা ভোলে না’ — কবি নিজেই বলে গেছেন।
আজকের দিনে তাই কবিতার পাতায় তার নাম লেখা থাকুক আরেকবার, হৃদয়ের মৃদু কাব্যতালে।