ভাবুন তো— একদিন হঠাৎ ব্যাংকের দরজা বন্ধ হয়ে গেল, অথচ আপনার হাতে নগদ টাকা নেই। আজকের দিনে এটা খুব একটা সমস্যা নয়। কারণ আমরা জানি, রাস্তায় কোণার মোড়েই হয়তো একটি এটিএম মেশিন অপেক্ষা করছে। কিন্তু অর্ধশতাব্দী আগে মানুষ এমন সুবিধার কথা কল্পনাও করেনি। সেই কল্পনাকে বাস্তবে রূপ দিয়েছিলেন এক উদ্ভাবক, আর এর সাক্ষী হয়েছিলেন এক অভিনেতা।
এক ব্যর্থতার গল্প থেকে আবিষ্কার
১৯৬৫ সালের একদিন জন শেফার্ড ব্যারন ব্যাংকে পৌঁছালেন দেরিতে। দরজা তখন বন্ধ। টাকার প্রয়োজন থাকলেও তিনি আর কিছুই করতে পারলেন না। সেই হতাশা থেকে মাথায় এলো অদ্ভুত এক ধারণা— ‘চকলেট ভেন্ডিং মেশিন যদি থাকে, তবে কেন টাকার ভেন্ডিং মেশিন থাকবে না?’ এভাবেই জন্ম নিল নতুন এক বিপ্লবী ভাবনা।
দুই বছর পর, ১৯৬৭ সালের ২৭ জুন, লন্ডনের এনফিল্ডে বার্কলেস ব্যাংকের শাখায় দাঁড় করানো হলো পৃথিবীর প্রথম এটিএম।
নাটকের মঞ্চ থেকে প্রযুক্তির ইতিহাসে
ব্যাংক চাইল প্রচার হোক। মানুষ যেন কেবল মেশিনটিকে না দেখে, বরং এর ভেতরের সম্ভাবনা অনুভব করে। তাই তারা বেছে নিলেন জনপ্রিয় কৌতুক অভিনেতা রেজিনাল্ড জনসন (Reg Varney)-কে। টেলিভিশন নাটক ‘On the Buses’-এর মাধ্যমে যিনি ঘরে ঘরে পরিচিত নাম হয়ে উঠেছিলেন।
সেদিন জনসন যখন মেশিনে কুপন ঢুকিয়ে হাতে প্রথম ১০ পাউন্ড পেলেন, জনতার ভিড়ের মধ্যে এক ধরনের বিস্ময় ছড়িয়ে পড়ল। হয়তো তখনও কেউ বুঝতে পারেনি—এই ছোট্ট মুহূর্তই বদলে দেবে ভবিষ্যতের ব্যাংকিংয়ের পথ।
মানুষের সহজতার জন্য
প্রথম এটিএমে কোনো প্লাস্টিক কার্ড ছিল না। গ্রাহকরা ব্যবহার করতেন বিশেষ কাগুজে কুপন। প্রতিটি কুপনের সীমা ছিল ১০ পাউন্ড। তবে মানুষের জন্য সহজ করার ইচ্ছাটিই ছিল মুখ্য। এমনকি এটিএমের নিরাপত্তা পিনও শুরুতে রাখা হয়েছিল ৬ সংখ্যার, কিন্তু ব্যারনের স্ত্রী মনে রাখতে কষ্ট পান বলে সেটি নামিয়ে আনা হয় ৪ সংখ্যায়। সেই ৪ সংখ্যার পিন আজও আমাদের জীবনের অংশ।
এক লেনদেনের প্রতীকী মানে
জনসনের হাতে ধরা সেই প্রথম ১০ পাউন্ড আসলে ছিল মানুষের হাতে ধরা এক নতুন স্বাধীনতা। আর্থিক স্বাধীনতা। ব্যাংকের সময়সূচির শিকল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসার স্বাধীনতা। আর তার সঙ্গে শুরু হয়েছিল এমন এক যাত্রা, যার শেষ নেই—আজ পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তে ৩০ লাখের বেশি এটিএম দাঁড়িয়ে আছে, আর প্রতিদিন কোটি কোটি মানুষ সেখানে হাত বাড়িয়ে নিচ্ছে অর্থ, সময় আর সহজতার নিশ্চয়তা।
অতীত থেকে বর্তমান
যখন আমরা আজ মোবাইল ফোনে চাপ দিয়ে মুহূর্তেই টাকা তুলে ফেলি, তখন সেই দিনের কথা ভাবা দরকার। ১৯৬৭ সালের গ্রীষ্মে এক অভিনেতার হাতে ধরা সেই প্রথম নোট ছিল আসলে মানব সভ্যতার প্রযুক্তি-ভিত্তিক নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা।
একটি ব্যাংকের শাখার ছোট্ট এক পরীক্ষামূলক যন্ত্র থেকে শুরু হয়েছিল যাত্রা—যা আজ আমাদের প্রতিদিনের জীবনের অপরিহার্য অংশ।