সমুদ্রের গভীর নীল জগতে এক সময় বাস করত এক শান্ত-নিরীহ দৈত্য— স্টেলার’স সি কাউ। আকারে ছিল অবিশ্বাস্য— প্রায় ৩০ ফুট লম্বা আর ৮ থেকে ১০ টনের ওজন! বিশাল এই প্রাণীটি ছিল সমুদ্রঘাসভোজী, মানুষের জন্য একেবারেই ক্ষতিহীন। তাদের চামড়া ছিল মোটা, রুক্ষ আর কালচে বাদামী; দেহের চারপাশে মোটা চর্বির আস্তরণ যেন ঠান্ডা সাগরের বিরুদ্ধে এক প্রাকৃতিক বর্ম।
১৭৪১ সালে জার্মান প্রকৃতিবিদ জর্জ উইলহেম স্টেলার প্রথম এই প্রাণীটিকে চোখে দেখেন। তখন তিনি রাশিয়ান অভিযাত্রী ভিটাস বেরিঙের সঙ্গে কমান্ডার দ্বীপপুঞ্জে পৌঁছেছিলেন। স্টেলার মুগ্ধ হয়েছিলেন এই প্রাণীর শান্ত স্বভাব দেখে। প্রাণীগুলো মানুষের কাছ থেকে পালিয়ে যেত না, বরং অচেনা অতিথিদের কৌতূহলভরে দেখত। এই ভয়হীনতাই হয়ে উঠেছিল তাদের সর্বনাশের কারণ।
নাবিক আর ব্যবসায়ীরা দ্রুত বুঝে গেল— এই প্রাণী যেন সমুদ্রের ভাসমান খাদ্যভাণ্ডার। একবার হত্যা করলেই শত শত কেজি মাংস পাওয়া যায়, যা দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করা সম্ভব। তাদের মোটা চর্বি দিয়ে জ্বালানি তৈরি হতো, চামড়া ব্যবহার করা হতো নৌকার কাজে। অল্পদিনেই শিকারীদের প্রধান লক্ষ্য হয়ে ওঠে স্টেলার’স সি কাউ।
ফলাফল ছিল ভয়াবহ। মাত্র ২৭ বছরের মধ্যে, অর্থাৎ ১৭৬৮ সালে, পৃথিবী থেকে চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে যায় এই নিরীহ প্রাণী। ইতিহাসের পাতায় এটি রয়ে গেছে মানুষের লোভের কারণে সবচেয়ে দ্রুত বিলুপ্ত হওয়া প্রজাতিগুলোর একটি উদাহরণ হিসেবে।
আজ আমরা কেবল কল্পনায় আঁকতে পারি— যদি তারা বেঁচে থাকত, তাহলে হয়তো আজও উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরের শীতল পানিতে বিশাল দেহ নিয়ে ভেসে বেড়াত এই সমুদ্রের দৈত্যরা। হয়তো শিশুদের কৌতূহলভরা চোখে বইয়ের পাতার বদলে সমুদ্রের জলে দেখা যেত তাদের।
স্টেলার’স সি কাউ-এর গল্প আমাদের শেখায় এক কঠিন সত্য— প্রকৃতির প্রতি মানুষের অযাচিত লোভ ও নির্দয়তা কেবল একটি প্রাণীকে নয়, পুরো পৃথিবীর ভারসাম্যকে ধ্বংস করে দিতে পারে।
এই বিলুপ্তির ইতিহাস যেন আমাদের জন্য সতর্কবার্তা— যাতে ভবিষ্যতে আর কোনো প্রাণী মানুষের স্বার্থের শিকার হয়ে চিরতরে হারিয়ে না যায়।