বাংলার মাটিতে শত শত বছর ধরে ছড়িয়ে আছে অগণিত মসজিদ ও মন্দিরের নিদর্শন। এর অনেকগুলোই কালের স্রোতে বিলীন হয়ে গেছে, আবার কিছু কিছু আজও দাঁড়িয়ে আছে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে। ঠিক তেমনি লালমনিরহাট জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার গোড়ল ইউনিয়নের হাজীপাড়ায় নিভৃত এক গ্রামে দাঁড়িয়ে আছে একটি ছোট কিন্তু বিস্ময়কর মসজিদ— যা সবার কাছে পরিচিত ‘এক কাতার মসজিদ’ নামে।
প্রথম দেখায় মসজিদটিকে সাধারণ মনে হলেও এর ভেতরের বৈশিষ্ট্যই এটিকে বিশেষ করে তুলেছে। মাত্র একটি কাতারে নামাজ পড়া যায় এখানে। ১৩ থেকে ১৪ জন মুসল্লি পাশাপাশি দাঁড়ালেই পূর্ণ হয়ে যায় জামাত। শত শত বছর ধরে গ্রামীণ মানুষের ধর্মচর্চা আর ঐতিহ্য বহন করে চলা এই মসজিদ আজও সগৌরবে টিকে আছে।
ইতিহাসের গহীনে হারিয়ে যাওয়া নির্মাণকাল
মসজিদটির সঠিক ইতিহাস আজও রহস্যে ঢাকা। কারা, কখন এই মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন তার সঠিক নথি নেই। স্থানীয়দের ধারণা, এটি মোঘল আমলে নির্মিত হয়েছিল। স্থাপত্যশৈলী আর দেয়ালের কারুকাজ দেখে অনুমান করা হয়, মসজিদের বয়স প্রায় ৫০০ বছরের বেশি।
গ্রামের প্রবীণরা বলেন, তাদের দাদা-পরদাদারা এই মসজিদের কথা শুনে এসেছেন। তবে কোনো নির্দিষ্ট সাল বা নির্মাতার নাম কারও জানা নেই। মসজিদের বাম পাশে একটি প্রাচীন কবর রয়েছে, ধারণা করা হয় সেটি মসজিদের প্রতিষ্ঠাতারই।
স্থাপত্যশৈলীর বৈশিষ্ট্য
এক কাতার মসজিদটি আকারে ছোট হলেও এর স্থাপত্যশৈলী দৃষ্টি কাড়ে। তিনটি গম্বুজ নিয়ে গড়ে তোলা এই স্থাপনা স্থানীয় মুসল্লিদের কাছে আধ্যাত্মিক প্রশান্তির জায়গা। দেয়ালগুলো অনেক পুরু, যেন প্রাচীন স্থাপত্যের দৃঢ়তার পরিচয় বহন করছে।
ভেতরে প্রবেশ করলেই চোখে পড়ে নকশা ও কারুকার্য। বর্তমান সময়ে এত সূক্ষ্ম কারুকাজ ও মোটা দেয়াল দিয়ে মসজিদ নির্মাণ কল্পনাতীত। মসজিদের ডান পাশে রয়েছে শিয়া সম্প্রদায়ের একটি দাহা, যার দেয়ালেও শোভা পাচ্ছে প্রাচীন শিল্পকর্মের নিদর্শন। সব মিলিয়ে একে ঘিরে তৈরি হয়েছে ঐতিহাসিক এক আবহ।
আধ্যাত্মিক প্রশান্তির কেন্দ্র
যদিও মসজিদটি ছোট, তবুও এর মাহাত্ম্য অনেক বড়। ভিন্ন এলাকা থেকেও মানুষ নামাজ আদায় করতে আসেন এখানে। স্থানীয়রা বলেন, এই মসজিদে নামাজ পড়লে একধরনের আধ্যাত্মিক শান্তি অনুভূত হয়।
এক প্রবীণ মুসল্লি বলেন— ‘আমি ছোটবেলা থেকেই এই মসজিদে নামাজ পড়ি। এ জায়গাটিতে দাঁড়ালে মনে হয় অতীতের মানুষের সঙ্গেই নামাজ আদায় করছি। মসজিদটি পুরনো হলেও এখনও অটুট আছে, আর নামাজ পড়তে বিশেষ স্বস্তি লাগে।’
অবহেলিত প্রত্ননিদর্শন
দুঃখজনক হলেও সত্যি, এত পুরনো ও ঐতিহাসিক স্থাপনা হওয়া সত্ত্বেও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের কোনো উদ্যোগ নেই এক কাতার মসজিদকে ঘিরে। স্থানীয়রা জানান, এখন পর্যন্ত কোনো কর্মকর্তা মসজিদটি সরেজমিনে দেখতেও আসেননি। অথচ এটি সংরক্ষণের উদ্যোগ নিলে বাংলাদেশে ঐতিহ্যবাহী নিদর্শনের তালিকায় যুক্ত হতে পারত অনন্যভাবে।
মসজিদটি প্রাচীন হলেও নিয়মিত নামাজ আদায় হয়। স্থানীয় মুসল্লিদের নিজস্ব উদ্যোগেই এটি রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়। তবুও সময়ের ছাপ পড়েছে দেয়ালে। সংরক্ষণের অভাবে যে কোনো সময় ভেঙে পড়তে পারে এই ঐতিহাসিক স্থাপনা।
নতুন মসজিদের দাবি
এক কাতার মসজিদে স্থান সংকুলান হয় না। এলাকায় মুসল্লিদের সংখ্যা বাড়ছে, ফলে জুমার নামাজ বা ঈদের জামাতে ভিড় সামলানো কঠিন হয়ে পড়ে। তাই স্থানীয়রা দাবি তুলেছেন, ঐতিহাসিক এই মসজিদটিকে সংরক্ষণ করে তার পাশে নতুন একটি বড় মসজিদ নির্মাণ করা হোক।
স্থানীয় এক যুবক জানান— ‘আমরা চাই এই পুরনো মসজিদটা যেভাবে আছে সেভাবেই থেকে যাক। এটা আমাদের গর্ব, ইতিহাস। তবে মুসল্লিদের সুবিধার জন্য পাশেই নতুন মসজিদ দরকার। সরকার বা প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ এগিয়ে এলে আমাদের স্বপ্ন পূরণ হবে।’
ঐতিহ্য সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা
বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে অনেক এমন নিদর্শন রয়েছে, যেগুলো সঠিক পরিচর্যার অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে। এক কাতার মসজিদও সেই তালিকায় চলে যেতে পারে যদি সময়মতো উদ্যোগ না নেওয়া হয়। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের পাশাপাশি স্থানীয় প্রশাসন, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও সচেতন জনগণ একসঙ্গে কাজ করলে এই ঐতিহ্য সংরক্ষণ সম্ভব।
ঐতিহাসিক নিদর্শন শুধু স্থাপত্য নয়, এগুলো আমাদের সংস্কৃতি ও ইতিহাসের জীবন্ত দলিল। তাই সেগুলোকে সংরক্ষণ করা মানে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য ইতিহাসকে বাঁচিয়ে রাখা।
লালমনিরহাটের এই ‘এক কাতার মসজিদ’ শুধু একটি উপাসনালয় নয়, এটি বাংলার ইতিহাস, ঐতিহ্য ও আধ্যাত্মিকতার প্রতীক। পাঁচ শতাব্দীর সাক্ষী হয়ে আজও এটি দাঁড়িয়ে আছে মানুষের ধর্মীয় চর্চার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে।
তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষয়ে যাচ্ছে এর গৌরব। এখনই যদি সংরক্ষণের উদ্যোগ না নেওয়া হয়, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হয়তো কেবল গল্পেই শুনবে এই মসজিদের কথা। তাই প্রয়োজন সরকার, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ ও স্থানীয় জনগণের সমন্বিত উদ্যোগ।
এক কাতার মসজিদ আমাদের ঐতিহ্যের অমূল্য সম্পদ। এটি রক্ষা করা আমাদেরই দায়িত্ব। ইতিহাস বাঁচিয়ে রাখতে হলে আজই শুরু করতে হবে সংরক্ষণের কাজ।