Monday 13 Oct 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

রহস্যময় ইস্টার দ্বীপ: যেখানে পাহারা দেয় হাজারো পাথরের চোখ!

ফারহানা নীলা
১৩ অক্টোবর ২০২৫ ১৪:৫৫

ভাবুন তো— একটি দ্বীপ, চারদিকে অশেষ নীল সমুদ্র, আর সেখানে দাঁড়িয়ে আছে হাজারো বিশাল পাথরের মূর্তি। কোনো সেনা নেই, কোনো দুর্গ নেই, তবুও মনে হয় দ্বীপটি কড়া পাহারায় ঘেরা। কারণ সমুদ্রের হাওয়ার সাথে সাথে এক অদৃশ্য শক্তি যেন পাহারা দিচ্ছে দ্বীপকে। আর সেই পাহারাদার— হাজারো মোয়াই নামের রহস্যময় মূর্তি।

দক্ষিণ-পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরের এক প্রান্তে লুকিয়ে থাকা এই দ্বীপ পৃথিবীর মানচিত্রে চিলির অংশ হলেও, ইতিহাস ও রহস্যে এটি নিজেই এক পৃথিবী। নাম— ইস্টার দ্বীপ।

মূর্তির দ্বীপ

মোয়াই মূর্তিগুলো একেকটি যেন আকাশ ছোঁয়া প্রহরী। সবচেয়ে লম্বা মোয়াই প্রায় ১০ মিটার উঁচু এবং ওজন ৮২ টন। সবচেয়ে ভারীটির ওজন আবার ৮৬ টনেরও বেশি—যা বোয়িং বিমানের চেয়েও ভারী! এত বিশাল মূর্তি কীভাবে দ্বীপের উপকূল পর্যন্ত আনা হয়েছিল, তার কোনো সঠিক উত্তর এখনো পাওয়া যায়নি।

বিজ্ঞাপন

স্থানীয় কিংবদন্তি বলে, মোয়াই নিজেরাই হেঁটে উপকূল পর্যন্ত চলে আসে। কেউ বলেন, পূর্বপুরুষের আত্মারা শক্তি দিয়ে এগুলো সরিয়ে এনেছিলেন। ইতিহাসবিদরা অবশ্য বলেন, রাপা নুই জনগোষ্ঠী সম্ভবত কাঠের গুঁড়ি ও দড়ির সাহায্যে মূর্তি টেনে এনেছিল। কিন্তু আজকের দিনে দাঁড়িয়ে সেটি কল্পনা করাও কঠিন।

দূরত্বে মোড়া একাকী দ্বীপ

ইস্টার দ্বীপ পৃথিবীর অন্যতম দূরবর্তী জনবসতিপূর্ণ স্থান। নিকটতম শহরও রয়েছে দু’হাজার কিলোমিটার দূরে। এই বিচ্ছিন্নতা দ্বীপটিকে আরও রহস্যময় করে তুলেছে।

খ্রিস্টানদের বিশেষ উৎসবের দিনে (ইস্টার সানডে) ১৭২২ সালে ডাচ অভিযাত্রী জ্যাকব রোগেভিন এই দ্বীপে প্রথম পৌঁছান। তাই এর নাম রাখা হয় ইস্টার আইল্যান্ড। তবে স্থানীয় রাপা নুই জনগোষ্ঠী বহু শতাব্দী ধরে এখানে বসবাস করছিল। তাদের বিশ্বাস, এই মূর্তিগুলোর মাধ্যমে পূর্বপুরুষেরা জীবিতদের আশীর্বাদ পাঠাতেন— ফসল, স্বাস্থ্য আর শান্তির জন্য।

ঐশ্বর্যের ছায়া আর ধ্বংসের গল্প

একসময় দ্বীপে ছিল অসংখ্য তালগাছ। সেগুলো কেটে কেটে মূর্তি স্থানান্তর করা হয়েছিল বলে ধারণা করেন ইতিহাসবিদরা। ফলস্বরূপ গাছ প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। বন উজাড় হলে ভূমিক্ষয় শুরু হয়, ফসল কমে আসে, আর জনজীবনে নেমে আসে সংকট।

তারপরও মূর্তিগুলো দাঁড়িয়ে থাকে অটল প্রহরীর মতো। মনে হয়, প্রকৃতি যখন সব কেড়ে নিল, তখনও পূর্বপুরুষের স্মৃতিগুলো পাহারা দিয়ে যাচ্ছে দ্বীপকে।

মূর্তির চোখে পাহারা

রাপা নুই জনগোষ্ঠীর কাছে মোয়াই শুধু পাথরের মূর্তি নয়; এগুলো জীবন্ত আত্মার প্রতীক। তারা বিশ্বাস করে, মূর্তিগুলো দ্বীপকে রক্ষা করে। রোগ, দুর্ভিক্ষ বা প্রাকৃতিক বিপর্যয় যাতে না আসে, সেই পাহারাই দেয় পাথরের চোখ।

আজও যখন পর্যটকেরা ইস্টার দ্বীপে যান, তারা অবাক হয়ে দেখেন—অসংখ্য মূর্তি উপকূলের দিকে তাকিয়ে আছে। যেন নীরব সৈনিক, যারা যুগের পর যুগ ধরে এই দ্বীপের সীমান্ত পাহারা দিচ্ছে।

সময়ের আঁচড়ে ক্ষতবিক্ষত

১৯৯৫ সালে ইউনেসকো ইস্টার দ্বীপকে বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় যুক্ত করে। কিন্তু প্রকৃতির খামখেয়াল এখানেও ছাড়েনি। ২০২২ সালে ভয়াবহ দাবানলে বহু মোয়াই মূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবুও রহস্যময় এই প্রহরীরা আজও দাঁড়িয়ে আছে, পর্যটক আর গবেষকদের বিমোহিত করে।

চিলি সরকার পর্যটনের চাপ নিয়ন্ত্রণে এখন সময় বেঁধে দিয়েছে—যেখানে আগে কেউ ৯০ দিন থাকতে পারত, এখন সর্বোচ্চ ৩০ দিন থাকার অনুমতি মেলে, তাও সমাজ বা পরিবেশ সংশ্লিষ্ট কাজে যুক্ত থাকলেই।

এক চিরন্তন রহস্য

ইস্টার দ্বীপ শুধুই একটি ভৌগোলিক স্থান নয়, এটি মানব ইতিহাসের এক অমীমাংসিত রহস্য। কে বানাল এই মূর্তি? কীভাবে বানাল? কেনই বা বানাল? শতাব্দীর পর শতাব্দী কেটে গেছে, তবুও প্রশ্নগুলোর উত্তর আজও অজানা।

তবে একটি বিষয় স্পষ্ট—এই দ্বীপ মানুষকে তার অতীতের কথা মনে করিয়ে দেয়। মনে করিয়ে দেয়, প্রকৃতির সঙ্গে বিরোধ করলে সভ্যতা ধ্বংস হতে বাধ্য। আর পূর্বপুরুষের প্রতি শ্রদ্ধা মানুষকে শক্তি দেয়—যেমনটি রাপা নুইরা পেয়েছিল মোয়াইয়ের রহস্যময় চোখ থেকে।

শেষকথা

আজকের পৃথিবী প্রযুক্তি আর শক্তির প্রদর্শনীতে ব্যস্ত। কিন্তু প্রশান্ত মহাসাগরের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা ইস্টার দ্বীপ যেন নিঃশব্দে অন্য এক বার্তা দেয়— ‘সবকিছু হারালেও স্মৃতি আর বিশ্বাসকে কেউ মুছতে পারে না।’

হাজারো পাথরের চোখে ভর করে দ্বীপটি পাহারায় দাঁড়িয়ে আছে, ঠিক যেমন যুগের পর যুগ ধরে থেকেছে। আর মানুষের কাছে থেকে গেছে শুধু বিস্ময়, কল্পনা আর এক অন্তহীন রহস্য।

সারাবাংলা/এফএন/এএসজি
বিজ্ঞাপন

অর্থনীতিতে নোবেল পেলেন ৩ জন
১৩ অক্টোবর ২০২৫ ১৬:৫২

আরো

সম্পর্কিত খবর