কল্পনা করুন, আপনি এক মরুভূমিতে হাঁটছেন। চারপাশে শুকনো সমতল মাটি, কোথাও গাছ নেই, পানি নেই, শুধু লালচে বাদামি ধুলোমাখা উপত্যকা। হঠাৎ দেখলেন, বিশাল এক পাথর মাটির ওপর দিয়ে একা একাই সরে গেছে! আর পেছনে টেনে গেছে লম্বা একটি দাগ। ভাববেন নিশ্চয় ভূতের কারসাজি, কিংবা কোনো অজানা শক্তির খেলা। কিন্তু না, এ ঘটনা বাস্তব, আর জায়গাটির নাম হলো ডেথ ভ্যালির রেসট্র্যাক প্লায়া।
ডেথ ভ্যালি, নাম শুনলেই এক অদ্ভুত শীতলতা কাজ করে। পৃথিবীর অন্যতম উষ্ণতম স্থান এটি। এখানে দিনের তাপমাত্রা গরমে ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যেতে পারে, আবার শীতে হিমাঙ্কের নিচেও নেমে যায়। কিন্তু প্রকৃত রহস্য লুকিয়ে আছে এখানকার সমতল ভূমিতে। এই রেসট্র্যাক প্লায়া একসময় ছিল একটি হ্রদ, যা শুকিয়ে গিয়ে তৈরি করেছে মসৃণ, ফাটলধরা মাটি। আর এই মাটির বুকে ছড়িয়ে আছে নানা আকারের পাথর—কেউ ছোট, কেউ বিশালাকার।
মজার বিষয় হলো, পাথরগুলো কিন্তু স্থির নয়। বছরের পর বছর ধরে এগুলো এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় চলে যায়, আর পেছনে রেখে যায় টানা সোজা বা বাঁকানো দাগ। স্থানীয়দের কাছে এটি ছিল এক রহস্য, পর্যটকদের কাছে বিস্ময়ের এক খেলা। অনেকে বলতেন, শক্তিশালী ঝড়ো হাওয়া পাথরগুলোকে ঠেলে নেয়। আবার কেউ ভাবতেন, এখানে কোনো অদৃশ্য চৌম্বক শক্তি কাজ করছে। বিজ্ঞানীরাও দীর্ঘদিন এ রহস্যের সমাধান খুঁজে পাননি। ফলে ‘সেলিং স্টোনস’ বা ‘ভ্রমণকারী পাথর’ নামেই খ্যাত হয়ে ওঠে এরা।
বছরের পর বছর ধরে অনেক গবেষক মাথা ঘামিয়েছেন। কেউ রাতে ক্যাম্প বসিয়ে পাহারা দিয়েছেন, কেউ ক্যামেরা বসিয়েছেন। তবু কোনো দিন চোখের সামনে পাথর নড়তে দেখা যায়নি। যেন পাথরগুলো কেবল তখনই হাঁটে, যখন কেউ তাকিয়ে থাকে না—একদম জাদুর মতো!
অবশেষে ২০১৪ সালে রহস্যের সমাধান হলো। একদল বিজ্ঞানী কয়েকটি পাথরে জিপিএস ট্র্যাকার বসিয়ে পরীক্ষা চালান। তারা দেখতে পান, শীতকালে যখন বৃষ্টি হয়, তখন মাটির ওপরে পাতলা বরফ জমে যায়। পরদিন সূর্যের আলোয় সেই বরফ ভেঙে ছোট ছোট টুকরো হয়ে ভেসে থাকে। ঠিক সেই মুহূর্তে যদি বাতাস জোরে বয়ে যায়, বরফের পাতলা টুকরো ভেলার মতো কাজ করে আর পাথরগুলোকে আলতোভাবে ঠেলে নিয়ে যায়। ফলে পাথরগুলো বরফ ও কাদার ওপর দিয়ে ধীরে ধীরে সরে যায়। পরে বরফ গলে গেলে শুধু থেকে যায় দাগগুলো।
ভাবুন তো, বিশাল ভারী এক পাথর এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাচ্ছে, অথচ গতি এত ধীর যে চোখে ধরা পড়ে না। ঠিক সিনেমার ‘টাইম-ল্যাপস’ শটের মতো, যেখানে কয়েক ঘণ্টা বা কয়েক দিনের দৃশ্য এক মিনিটে ধরা পড়ে।
আজ রহস্য ভেদ হলেও এই ভ্রমণকারী পাথরগুলো এখনো পর্যটকদের কাছে এক বিস্ময়ের উৎস। কারণ প্রকৃতির এই অদ্ভুত খেলা প্রমাণ করে—পৃথিবী এখনো আমাদের চমক দেওয়ার মতো রহস্য ধরে রেখেছে। প্রযুক্তি যতই এগোক না কেন, প্রকৃতির জাদু সবসময়ই মানুষকে মুগ্ধ করে রাখবে।
ডেথ ভ্যালির রেসট্র্যাক প্লায়া তাই শুধু মরুভূমি নয়, বরং এক চলমান গল্পের বই। যেখানে নীরব পাথরও একদিন ভ্রমণকারীর চরিত্রে অভিনয় করে, আর মানুষ বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে তাদের রহস্যময় পথে আঁকা দাগের দিকে।