বুড়িগঙ্গার ঢেউ ছুঁয়ে ঢাকার আকাশে আজও দাঁড়িয়ে আছে এক নীরব রহস্য… ইঁট, পাথর, বুরুজ আর ইতিহাসের ভার তার বুকে— লালবাগ কেল্লা! যার আরেক নাম— কেল্লা আওরঙ্গবাদ। এটি শুধু একটি দুর্গ নয়… এটি অসমাপ্ত স্বপ্ন, অপূর্ণ প্রেম আর হারিয়ে যাওয়া ইতিহাসের সাক্ষী।
১৬৭৮ সাল। মুঘল সুবেদার ও সম্রাট আওরঙ্গজেবের পুত্র মুহাম্মদ আজম শাহ ঢাকায় এসে শুরু করলেন এক রাজকীয় দুর্গ নির্মাণ— স্বপ্ন ছিল বাংলাকে আরও শক্তিশালী, আরও প্রভাবশালী করে তোলা। কিন্তু ইতিহাস কখনো সরল পথে হাঁটে না। নির্মাণ শেষ হওয়ার আগেই মারাঠা বিদ্রোহ দমনে তাকে ডেকে পাঠানো হয় দিল্লিতে। এবং থেমে যায় কেল্লার কাজ।
দুই বছর পর দায়িত্ব নিলেন নতুন সুবেদার— শায়েস্তা খাঁ। তিনি ফের শুরু করলেন নির্মাণকাজ। তখন কেউ জানত না, এই প্রাচীরই একদিন হয়ে উঠবে শোকের প্রতীক। কারণ ১৬৮৪ সালে অকালে মারা গেলেন তার প্রিয় কন্যা— পরী বিবি। কন্যার মৃত্যুতে ব্যথিত শায়েস্তা খাঁ এই দুর্গকে অপয়া ভাবলেন। আর এরপরই… কেল্লাটি চিরদিনের মতো রয়ে গেল অসমাপ্ত। ঢাকা রাজধানী হারালো, সময়ের স্রোতে হারাতে বসলো লালবাগও। কখনো পরিত্যক্ত, কখনো অবহেলিত…
তারপর ১৮৪৪ সালে ‘আওরঙ্গবাদ’ নাম বদলে হলো লালবাগ। এবং দুর্গটি ফিরে পেল নতুন পরিচয়— লালবাগ কেল্লা।
দুর্গে ঢুকলেই চোখে পড়ে— পরী বিবির সমাধি। সাদা মার্বেল, কষ্টি পাথর, ফুল-পাতার অপূর্ব কারুকাজ। নয়টি কক্ষের মাঝখানে সেই নীরব সমাধি। একসময় গম্বুজটি নাকি সোনায় মোড়ানো ছিল। আজও দর্শনার্থীরা দাঁড়িয়ে থাকে নীরব শ্রদ্ধায়। যদিও অনেক বিশেষজ্ঞের দাবি— এখানে পরী বিবির মরদেহ নেই!
দুর্গের পশ্চিমে দাঁড়িয়ে আছে তিন গম্বুজবিশিষ্ট শাহী মসজিদ— এখনও নামাজ আদায়ের শব্দ প্রতিধ্বনিত হয় এখানে, যেন সময় থেমে গেছে ১৬৭৯ সালেই।
আর পূর্বদিকে দেওয়ান-ই-আম— যেখানে বসে সুবেদাররা বিচার করতেন, প্রশাসন চালাতেন। নিচতলার হাম্মামখানা— রাজকীয় বিশ্রাম ও স্নানের স্থান। এককালে এখানে চলত সুগন্ধ, সংগীত, রাজকীয় আয়োজন।
দুর্গজুড়ে ছিল ফোয়ারা, ছাদবাগান, আস্তাবল, প্রশাসনিক ভবন, ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গ— একই সারিতে স্থাপনা তিনটি সংযুক্ত ছিল পানির নালা দিয়ে। চারকোণা বিশাল পানির ট্যাংক, বুরুজ— সবই জানান দেয়— এটি কেবল বসবাসের জায়গা নয়, বরং একটি সুপরিকল্পিত সামরিক দুর্গ।
লালবাগ কেল্লা শুধু ইট-পাথরের জমায়েত নয়— এটি অসমাপ্ত রাজনীতি, এক পিতার শোক, এক শহরের স্মৃতি, আর এক প্রেমহীন সমাধির দীর্ঘশ্বাস।
প্রতিদিন হাজারো মানুষ আসে— কেউ ছবি তুলতে, কেউ তাজা বাতাসে হাঁটতে, আবার কেউ ইতিহাস ছুঁতে। কিন্তু কেল্লা চুপচাপ তাকিয়ে থাকে… যেন এখনো অপেক্ষা করছে— তার অসমাপ্ত গল্পের শেষ লাইনটির জন্য।