Tuesday 02 Dec 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

দাসত্বের অন্ধকার থেকে মানবমুক্তির আলোর দিন আজ

ফারহানা নীলা স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
২ ডিসেম্বর ২০২৫ ১৬:৪৬

বিশ্বজুড়ে মানুষ আজ যে স্বাধীনভাবে শ্বাস নেয়, নিজের জীবনকে নিজের মতো করে সাজানোর স্বপ্ন দেখে— তার পেছনে রয়েছে দীর্ঘ সংগ্রাম, ব্যথা আর প্রতিরোধের ইতিহাস। ক্যালেন্ডারের পাতায় ২ ডিসেম্বরকে তাই কেবল আরেকটি তারিখ বলে বিবেচনা করলে ভুল হবে। কারণ ঠিক এই দিনেই, ১৯৪৯ সালে, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ দাসপ্রথা, মানবপাচার, জোরপূর্বক শ্রম ও শোষণের বিরুদ্ধে একটি গুরুত্বপূর্ণ কনভেনশন গ্রহণ করে। মানবমুক্তির এই ঘোষণাপত্রই পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক দাসপ্রথা বিলুপ্তি দিবস পালনের ভিত্তি তৈরি করে।

দাসত্ব: ইতিহাসের সবচেয়ে পুরোনো অপরাধ

দাসত্ব মানবসভ্যতার প্রাচীনতম অন্ধকার। প্রাচীন মিশর থেকে গ্রিস, রোম— সবখানেই মানুষ মানুষকে পণ্য হিসেবে ব্যবহার করেছে। সময় বদলেছে, সমাজ বদলেছে, কিন্তু শোষণের রূপ পাল্টে থেকেছে— কখনো ঔপনিবেশিকতার নামে, কখনো ‘চুক্তিভিত্তিক শ্রম’, আবার কখনো ঋণের বোঝা চাপিয়ে।

বিজ্ঞাপন

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে বিশ্ব যখন ধ্বংসস্তূপ থেকে পুনর্গঠনে ব্যস্ত, তখন মানবাধিকার ইস্যু নতুন করে আন্তর্জাতিক আলোচনার কেন্দ্রে উঠে আসে। সেই প্রেক্ষিতেই ১৯৪৯ সালের সেশন— যেখানে জাতিসংঘ মানবসভ্যতাকে এক নতুন প্রতিশ্রুতি দেয়: মানুষ আর কখনো হবে না আরেক মানুষের সম্পত্তি।

১৯৪৯ সালের কনভেনশনের মাহাত্ম্য

জাতিসংঘের সেই কনভেনশন শুধু দাসপ্রথা নিষিদ্ধ করেনি; মানবপাচার, জোরপূর্বক বিবাহ, শিশু শোষণ, অমানবিক শ্রমপদ্ধতি— সবকিছুকে আধুনিক দাসত্বের অংশ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ঐতিহাসিকভাবে এটি ছিল বিশ্বের সামনে নতুন এক দৃষ্টিভঙ্গি— দাসত্ব শুধু শৃঙ্খল নয়, দাসত্ব মানে মানবমর্যাদা থেকে বঞ্চিত করার যে কোনো পদ্ধতি।

এই ঘোষণার মাধ্যমে প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পেল যে দাসত্ব ছিন্ন করার জন্য শুধু আইন নয়, দরকার শিক্ষার, সচেতনতামূলক উদ্যোগের এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিশ্রুতির।

কিন্তু দাসত্ব কি সত্যিই শেষ হয়েছে?

কাগজে-কলমে দাসপ্রথা নিষিদ্ধ হলেও বাস্তবতা কঠিন। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার পরিসংখ্যান বলছে, আধুনিক সময়ে প্রায় ৫ কোটি মানুষ এখনও কোনো না কোনোভাবে দাসত্বের শিকার— মানবপাচার, যৌন শোষণ, জোরপূর্বক শ্রম, শিশু শ্রম কিংবা বিবাহবদ্ধ দাসত্বের মাধ্যমে।

প্রযুক্তির অগ্রগতি যেমন বিশ্বকে ছুটিয়ে নিয়েছে, তেমনি অপরাধীদের হাতেও তুলে দিয়েছে নতুন অস্ত্র। অনলাইন গ্রুমিং, ভুয়া চাকরির বিজ্ঞাপন, বিদেশে ‘উন্নত ভবিষ্যৎ’-এর প্রলোভন— আধুনিক দাসত্বের নতুন পথ তৈরি করছে। ফলে ১৯৪৯ সালে জাতিসংঘের ঘোষণার গুরুত্ব আজও একটুও কমেনি; বরং আরও বেড়েছে।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট

উন্নয়নশীল দেশের মতো বাংলাদেশেও রয়েছে মানবপাচার ও শ্রমশোষণের বিভিন্ন প্রভাব। দক্ষিণ এশিয়ার অভিবাসী শ্রমিকদের মধ্যে বহু মানুষ বিদেশে ভুয়া এজেন্সির টোপে পড়ে জোরপূর্বক শ্রমে নিযুক্ত হন। border এলাকার নারী-শিশুরা পাচারের ঝুঁকিতে থাকে।

অথচ একই সময়ে বাংলাদেশ মানবপাচার দমনে আইন প্রণয়ন করেছে, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক কনভেনশনে অংশ নিয়েছে এবং জনসচেতনতা বাড়াতে নানা উদ্যোগ নিয়েছে— যা এ অঞ্চলে মানবাধিকারের লড়াইকে আরও শক্তিশালী করছে।

কেন ২ ডিসেম্বর আজও গুরুত্বপূর্ণ?

২ ডিসেম্বর আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে স্বাধীনতা শুধু রাষ্ট্রের নয়— প্রত্যেক মানুষের মৌলিক অধিকার। পৃথিবীর যে প্রান্তেই একজন মানুষ শোষিত হন, পুরো মানবসভ্যতাই ব্যর্থ হয়। তাই এই দিনটি কেবল ইতিহাসের অংশ নয়; এটি এক নৈতিক দায়বদ্ধতা।

এটি মনে করিয়ে দেয়—
মানুষ পণ্য নয়,
শ্রমের বিনিময়ে মর্যাদা থাকা উচিত,
শোষণ প্রতিরোধে সমাজ ও রাষ্ট্র উভয়ের দায়িত্ব রয়েছে,
‘আধুনিক দাসত্ব’ রোধে প্রত্যেক ব্যক্তি সচেতন হওয়া জরুরি।

শেষ কথা

১৯৪৯ সালের ২ ডিসেম্বর ছিল মানবিক জাগরণের দিন— বঞ্চিত মানুষদের দিকে বিশ্ব নজর ফেরানোর দিন। যদিও দাসত্বের রূপ বদলেছে, কিন্তু এর বিরুদ্ধে লড়াই আজও চলমান। তাই এই দিনটি আমাদের শুধু অতীত স্মরণ করায় না— ভবিষ্যতের দায়িত্বও মনে করিয়ে দেয়।

মানুষের স্বাধীনতার জন্য লড়াই কখনো শেষ হয় না। আর তাই, ২ ডিসেম্বর— আজও আমাদের শেখায় এক চিরন্তন সত্য: মানুষের মান-মর্যাদার ওপর কারও মালিকানা নেই, কখনোই থাকবে না।

সারাবাংলা/এফএন/এএসজি
বিজ্ঞাপন

আরো

ফারহানা নীলা - আরো পড়ুন
সম্পর্কিত খবর