বাগেরহাট… ইতিহাসের স্তর জমে থাকা এক শান্ত শহর। আর সেই শহরের বুকেই দাঁড়িয়ে আছে— বাংলাদেশের সবচেয়ে বিস্ময়কর স্থাপত্যগুলোর একটি… ‘ষাট গম্বুজ মসজিদ’।
ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্য। বাংলার সুলতানি আমলের সর্ববৃহৎ প্রস্তরনির্মিত মসজিদ। আর দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসে এক অনন্য শিল্পকীর্তি।
খুলনা বিভাগের বাগেরহাট শহর থেকে মাত্র ৪–৫ কিলোমিটার দূরে, সবুজ গাছপালার মাঝে অবাক করা এক স্থাপত্য… একদিকে নিস্তব্ধতা, অন্যদিকে ইতিহাসের ভার। ১৫ শতকের মাঝামাঝি সময়, সুলতান নসিরউদ্দিন মাহমুদ শাহের আমলে সুন্দরবন অঞ্চল শাসন করতে এসে খান জাহান আলী গড়ে তুলেছিলেন খলিফাবাদ। আর বৈঠকখানা হিসেবে যে স্থাপনার নির্মাণ শুরু হয়েছিল— পরে সেটিই পরিণত হয় আজকের ষাট গম্বুজ মসজিদে।
ইট-চুনা-চুনাপাথরের এ বিশাল মসজিদ নির্মাণে লেগেছিল বহু বছর। মসজিদের পাথর আনা হয়েছিল দূর রাজমহল থেকে। তুঘলকি ও জৌনপুরী স্থাপত্যশৈলীর মিশেলে তৈরি এই মসজিদ যেন সময়ের পরীক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকা এক নীরব মহাকাব্য।
মসজিদের নাম যদিও ‘ষাট’ গম্বুজ— বাস্তবে গম্বুজের সংখ্যা ৮১টি! ভেতরে আছে ৭৭টি আর চার কোণে আছে ৪টি মিনার-গম্বুজ। ভেতরের ৬ সারিতে থাকা ৬০টি প্রস্তর স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে আছে এই বিশাল গম্বুজরাজি। অনেকে বলেন— এই ৬০ স্তম্ভ থেকেই নাম হয়েছে ষাট গম্বুজ।
মসজিদের অভ্যন্তরে পশ্চিম দেয়ালে রয়েছে ১০টি মিহরাব। মাঝের মিহরাবটি কারুকার্য আর স্থাপত্যে সবচেয়ে মনোমুগ্ধকর। বিশ্বাস করা হয়— খান জাহান আলী এই স্থানটিকে শুধু ibadah–ই নয়, দরবার হল বা শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবেও ব্যবহার করতেন।
মসজিদের বাইরে পূর্ব দেয়ালে আছে ১১টি খিলান দরজা। তারপর ৭ + ৭ করে উত্তর–দক্ষিণে আরও ১৪টি দরজা। বিশাল দেয়াল, মোটা ইট, আর গম্বুজের নিচে এক অদ্ভুত শীতলতা— যেন সময়ের কোনো ঘড়ি এখানে থেমে গেছে।
পুকুর, কুমির আর কিংবদন্তি… আর মসজিদের পাশেই নির্জন অথচ রহস্যময় একটি পুকুর— খানজাহানের দিঘি। এই দিঘিতেই আছে প্রায় শত বছর বয়সী কুমির। স্থানীয়রা যাকে এখনো সম্মান আর ভক্তির চোখে দেখে। বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠানে আজও খাবার দিয়ে কুমির ডেকে তোলার রীতি চলে। অনেকে বিশ্বাস করেন— এই কুমিররা খান জাহান আলীর আমল থেকেই এলাকার রক্ষক হিসেবে বিবেচিত।
সূর্য ডুবে গেলে মসজিদের ইটের গায়ে লেগে থাকা লাল আলো, দিঘির জলে ঢেউয়ের শব্দ… সব মিলিয়ে ষাট গম্বুজ যেন জেগে ওঠে অন্য এক আবেশে।
ষাট গম্বুজ মসজিদ শুধু ইট-পাথরের স্থাপনা নয়— এটা বাংলাদেশের স্থাপত্য ঐতিহ্যের সবচেয়ে বড় গর্ব। ইতিহাস, ধর্ম, সংস্কৃতি আর শিল্প— সব মিলিয়ে এটি যেন এক জীবন্ত জাদুঘর।
যে কেউ বাগেরহাটে এলে, এই মসজিদের শান্তি, স্থিরতা আর অলৌকিক সৌন্দর্য
তার মন ছুঁয়েই যাবে। কারণ, ষাট গম্বুজ শুধু অতীতের গল্প নয়… এটা বাংলার গভীর শেকড়, অবিস্মরণীয় ঐতিহ্য, আর আমাদের প্রজন্মের জন্য রেখে যাওয়া চিরন্তন নিদর্শন।