হাজার বছরের ইতিহাস… সিলেট শহরের উত্তর প্রান্তে একটি শান্ত টিলার উপর দাঁড়িয়ে আছে এক পবিত্র স্মৃতিস্তম্ভ— ‘শাহ জালালের দরগাহ’।
১৩০৩ খ্রিষ্টাব্দে পাশ্চাত্য থেকে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে বাংলায় আগত দরবেশ শাহ জালাল ইয়েমেনী— এখানেই গড়ে তুলেছিলেন তার আশ্রম, তার তরিকত, আর এখানেই স্থায়ী হয়েছে তার চিরনিদ্রার ঘর।
এই দরগাহ ঘিরেই নাকি সিলেটের মুসলিম সভ্যতা ও ধর্মীয় সংস্কৃতি বিকশিত হয়েছে। প্রাচীন দলিল, ঐতিহাসিক অচ্যুৎচরণ চৌধুরীসহ বিভিন্ন গবেষকের মতে— শাহ জালালের সঙ্গীরা এখান থেকে ছড়িয়ে পড়েছিলেন ঢাকা, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, কুমিল্লা, ত্রিপুরা ও আসামে। তাদের হাত ধরেই প্রতিষ্ঠা পায় বহু মসজিদ, খানকাহ, ও মুসলিম ঐতিহ্য।
সিলেট বিজয়ের পর দিল্লীর সুলতান শামসুদ্দীন ফিরোজ শাহ শাহ জালালকে শাসনভার নিতে অনুরোধ করেছিলেন— কিন্তু দরবেশ রাজত্ব নেননি। তার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সুলতান ঘোষণা করেন— দরগাহ ঘিরে পুরো এলাকা খাজনা-মুক্ত থাকবে। এই ব্যবস্থা আজও বহাল।
সুলতানি আমল থেকে মোগল যুগ— যে শাসকই সিলেটে আসতেন, দরগাহে এসে সংস্কার, নতুন স্থাপনা, মসজিদ, ঘাট, গম্বুজ— কিছু না কিছু নির্মাণ করতেন। ১৪০০ সালের তাম্রফলকে লেখা আছে— এই দরগাহ মসজিদ বাংলার সুলতানদের দ্বারা নির্মিত।
সম্রাট আওরঙ্গজেবের আমলে ফরহাদ খান তৈরি করেছিলেন বিখ্যাত সেই বৃহৎ গম্বুজ— যা এখনো দরগাহর অন্যতম নিদর্শন।
অসম্ভব গভীর শ্রদ্ধার জায়গা ছিল এই দরগাহ। রাজকর্মচারীরা সিলেটের দায়িত্ব নেওয়ার আগে দরগাহে এসে জিয়ারত করতেন— খানকার শেখ তাদের পাগড়ি পরিয়ে আনুষ্ঠানিক অনুমোদন না দিলে— সাধারণ মানুষও তাদের শাসক হিসেবে মেনে নিত না।
দরগাহ টিলার উত্তরে প্রাচীরবেষ্টিত স্থানে রয়েছে শাহ জালালের সমাধি। তার পাশে ইয়ামেনের রাজপুত্র শেখ আলী, গৌড়ের উজির মকবুল খানের কবর। দক্ষিণ দিকে আছে তিন অলির সমাধি— হাজি ইউসুফ, হাজি খলিল ও হাজি দরিয়া।
চত্বরে রয়েছে…
বিশাল দরগাহ মসজিদ,
ঘড়িঘর,
অজুর ঘাট,
মহিলাদের আলাদা জিয়ারতঘর,
বৃহৎ পুকুর,
আর সেই বিখ্যাত গজার মাছ, যাদের নিয়ে আজও ভক্তি-ভরা গল্প প্রচলিত।
২০০৩ সালের বিষপ্রয়োগে শত শত গজার মাছ মারা যায়— কিন্তু ২০০৪ সালে শাহ মোস্তফার মাজার থেকে আনা নতুন মাছ দিয়ে আবার প্রাণ ফিরে পায় দরগাহ পুকুর।
দরগাহ টিলার পশ্চিমে আছে এক অলৌকিক ঝরনা। লোককথা বলে, শাহ জালাল নিজ লাঠি দিয়ে ‘বিসমিল্লাহ’ পড়ে মাটিতে আঘাত করলে এই ঝরনার পানি প্রবাহিত হয়। সোনা–রুপার রঙের ছোট মাছ দেখা যায় এখানে। একসময় ভক্তরা এই পানি পবিত্রতার বিশ্বাসে পান করত— এখন বোতলজাত করেও বিক্রি হয়।
দরগাহে রয়েছে তার ব্যক্তিগত ব্যবহারের উপকরণ…
তলোয়ার,
কাঠের খড়ম,
হরিণের চামড়ার মোসল্লা,
তামার পেয়ালা, যেখানে আরবি কালাম খোদাই করা,
বলা হয়, এই পেয়ালায় পানি পান করলে রোগমুক্তি হয়।
কিংবদন্তি মতে, মুরশীদের দেওয়া একমুঠো মাটি নিয়ে তিনিও যখন সিলেটের মাটির সাথে মিলিয়ে দেখেন— তখনই বুঝতে পারেন, এ ভূমিই তার গন্তব্য। আজও মানুষ বিশ্বাস করে— শাহ জালালের দরগাহে দোয়া করলে মনের বাসনা পূরণ হয়।
বাংলাদেশ ও বিশ্বের যেখানেই বাংলাদেশিরা আছেন— শাহ জালালের নাম, স্মৃতি ও প্রভাব ছড়িয়ে আছে। স্কুল, কলেজ, মসজিদ, রাস্তা, শহরের নাম— অসংখ্য প্রতিষ্ঠানে।
উরসের সময় হাজার হাজার মানুষ আসেন এ দরগাহে। শ্রদ্ধা, ভালোবাসা আর বিশ্বাসে সিলেট যেন আজও শাহ জালালের স্মৃতিতে আলোকিত।