Wednesday 10 Dec 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

কাকাপো: পৃথিবীর সবচেয়ে ভারী তোতা!

ফারহানা নীলা স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
১০ ডিসেম্বর ২০২৫ ১৪:৩১

নিউজিল্যান্ডের সবুজে ঢাকা পাহাড়ি বনভূমিতে এমন এক পাখির বাস, যার অস্তিত্ব শুনলেই বিস্ময়ের তরঙ্গ দোলা দেয় মনজুড়ে। নাম তার কাকাপো— পৃথিবীর সবচেয়ে ভারী তোতা, সবচেয়ে অদ্ভুত স্বভাবের এক নিশাচর পাখি, আর প্রকৃতির নীরব বিস্ময়ের এক জীবন্ত প্রতীক।

অদ্ভুত এই পাখির ওজনই তার পরিচয়

তোতা মানেই আমরা ভাবি আকাশে ডানা মেলে উড়তে থাকা রঙিন পাখি। কিন্তু কাকাপো যেন এ নিয়ম ভেঙে তৈরি নিজের আলাদা দুনিয়া। সবুজের মোলায়েম ছায়ায় ঢাকা এই পাখিটির ওজন হতে পারে ৪ কেজি পর্যন্ত— তোতা পরিবারের বাকি সদস্যদের তুলনায় যা আশ্চর্যজনকভাবে বেশি। তার বড়, ভারী দেহই তাকে অন্য তোতাদের মতো আকাশে উড়তে দেয় না। তাই বিশাল ডানা থাকা সত্ত্বেও কাকাপো উড়তে পারে না।

বিজ্ঞাপন

কিন্তু এই সীমাবদ্ধতার মধ্যেও তার চলাফেরায় আছে এক ধরনের মায়াবী ধীরতা। শক্ত পা দিয়ে বনভূমির নরম মাটিতে সে হেঁটে কিংবা লাফিয়ে চলাচল করে। পাহাড়ি ঢালে কখনও কখনও পা দিয়ে ঠেলে নিচে নেমে যেতেও দেখা যায়— যেন প্রকৃতির নিজস্ব ‘স্লাইডিং উইংস’!

নিশাচর স্বভাব: অন্ধকারে তার রাজত্ব

কাকাপো দিনের বেলায় প্রায় অদৃশ্য। ঘন জঙ্গলের একেকটি গাছের ছায়া যেন তার নিরাপদ আশ্রয়। রাতে যখন বনভূমি ঘুমিয়ে পড়ে, তখনই জীবন্ত হয়ে ওঠে কাকাপো। তার বড়, গোল চোখ অন্ধকারে দেখার উপযোগী, আর ধীর গতির চলাফেরা তাকে শিকারিদের চোখ থেকে বাঁচিয়ে রাখে।

সবচেয়ে মজার বিষয়— কাকাপোর পালক। এ পালকের রঙ ঘন সবুজের সঙ্গে বাদামি-হলুদ মিশ্রণ। ফলে জঙ্গলের পাতার ভিড়ে তাকে আলাদা করে চেনাই কঠিন। প্রকৃতির দিয়েছে এমন এক নিখুঁত ছদ্মবেশ, যা তাকে করে তুলেছে নিশাচরের প্রকৃত লুকানো শিল্পী।

যে তোতা কথা বলে না, কিন্তু অনুভব ছড়ায়

তোতা পরিবার মানেই মানুষ ভাবে— তারা বুঝি কথা বলে। কিন্তু কাকাপো তেমন নয়। এই পাখি শান্ত, লাজুক প্রকৃতির। মানুষের সামনে খুব কমই আসে। তবে তার আছে এক বিশেষ ধ্বনি—‘বুম কল’। প্রজনন মৌসুমে পুরুষ কাকাপো পাহাড়ের ওপর বসে গভীর, থরথর করা বুম শব্দে মেয়েদের ডাকতে থাকে। শব্দটি কখনও কখনও কয়েক কিলোমিটার দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। অন্ধকারে এই ডাক এক অদ্ভুত রহস্যময় পরিবেশ তৈরি করে।

বিলুপ্তির দ্বার থেকে ফিরিয়ে আনার সংগ্রাম

কাকাপো পৃথিবীতে যত বিরল পাখি আছে, তাদের শীর্ষেই অবস্থান তার। নিউজিল্যান্ডে বহু বছর আগে এই পাখির সংখ্যা ভয়াবহভাবে কমে যায়— নতুন আগত শিকারি প্রাণী (বিড়াল, ইঁদুর, স্টোট), বাসস্থান ধ্বংসসহ নানা কারণে। একসময়ে তো ভাবা হয়েছিল— হয়তো কাকাপো আর নেই।

কিন্তু দীর্ঘদিনের কঠিন সংরক্ষণ প্রচেষ্টায় আজও কাকাপো টিকে আছে, যদিও সংখ্যা খুবই সীমিত। প্রতিটি কাকাপোর স্বাস্থ্য, খাদ্যাভ্যাস, চলাচল— সবকিছু বিজ্ঞানীরা পর্যবেক্ষণ করেন। যেন এই অদ্ভুত সুন্দর প্রাণটি আবারও নিজের জগৎকে সম্পূর্ণভাবে হারিয়ে না ফেলে।

অদ্ভুততাতেও আকর্ষণ— প্রকৃতির নিঃশব্দ বার্তা

কাকাপো হয়তো চিৎকার করে দৃষ্টি আকর্ষণ করে না, উড়তে পারে না, কিংবা রঙিন ডানার ঝলক দেখায় না। তবু তার অস্তিত্বে আছে এক ধরনের শান্ত সৌন্দর্য, এক উপলব্ধি— প্রকৃতি কত অদ্ভুত, কত বৈচিত্র্যময়, আর কত সংবেদনশীল।

কাকাপো আমাদের শেখায়— প্রতিটি জীব তার ভিন্নতা নিয়ে বিশেষ, আর পৃথিবীর প্রতিটি প্রাণই নিজের মতো করে মূল্যবান। সবুজের মাঝে এই ভারীতোতা নিশাচরের সরল জীবন যেন নীরবে বলে যায়, ‘সংরক্ষণ মানে শুধু প্রাণী বাঁচানো নয়, মানে পৃথিবীকে বাঁচানো।’

শেষকথা

কাকাপো শুধু একটি তোতা নয়— সে নিউজিল্যান্ডের ইতিহাস, প্রকৃতির রহস্য, আর পৃথিবীর জীববৈচিত্র্যের এক মুগ্ধকর প্রতীক। তার গল্প আমাদের মনে করিয়ে দেয়, জীবনের বৈচিত্র্য যে কত বড় এক আশ্চর্য— যা আমরা সংরক্ষণ করতে পারলে ধরণীও আরও কিছুটা সুন্দর হয়ে থাকে।

সারাবাংলা/এফএন/এএসজি
বিজ্ঞাপন

আরো

ফারহানা নীলা - আরো পড়ুন
সম্পর্কিত খবর