প্রশান্ত মহাসাগরের মাঝখানে ভেসে থাকা একটি ছোট্ট দ্বীপ। আয়তন মাত্র ২১ বর্গ কিলোমিটার। চারপাশে নীল জলরাশি, মাঝখানে একফালি দেশ— নাম নাউরু।
এই দ্বীপটিকে ঘিরে তৈরি একটি রিং রোড আছে। গাড়িতে উঠুন, একটু গান চালান, জানালার বাইরে তাকান— ঠিক ২০ মিনিট পর দেখবেন, যেখান থেকে যাত্রা শুরু করেছিলেন, সেখানেই আবার ফিরে এসেছেন! পৃথিবীর খুব কম দেশই আছে, যাদের পুরো ভূগোল এমন ‘ফাস্ট ফরোয়ার্ড’ অভিজ্ঞতা দেয়।
কিন্তু নাউরুর গল্পটা মোটেও এত দ্রুত শেষ হওয়ার কথা ছিল না।
হাজার বছরের ধীর জীবন
নাউরুতে মানুষের বসবাস খ্রিস্টপূর্ব ১,০০০ সালেরও আগে থেকে। তারা ছিল বাইরের দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন, কিন্তু মোটেও অসহায় নয়। বরং নিজেদের মতো করে তারা ছিল সম্পূর্ণ স্বনির্ভর।
এই দ্বীপে বড় কোনো কৃষিজমি ছিল না। কর্পোরেট কৃষি, ট্রাক্টর, বিশাল ধানক্ষেত— এগুলোর কোনো ধারণাই নাউরুর মানুষ জানত না। কিন্তু তাই বলে তারা না খেয়ে থাকত? একদমই না।
তাদের খাদ্যচক্র ছিল প্রকৃতির স্বাভাবিক ছন্দে গড়া। সমুদ্র থেকে আসত টুনা, রীফ ফিশ, অক্টোপাস, কাঁকড়া, কচ্ছপ, শামুক। ভেতরভাগে সামান্য উর্বর জমিতে জন্মাত নারকেল, পান্ডানাস, ব্রেডফ্রুট, কলা, এরোরুট। যা পাওয়া যেত, সেটাই খাওয়া হতো। যা খাওয়া হতো, সেটাই ছিল স্থানীয়, মৌসুমি আর তাজা। খাবার নিয়ে দুশ্চিন্তা ছিল না। খাদ্য নিরাপত্তা ছিল কোনো সরকারি নীতিমালা নয়, ছিল দৈনন্দিন বাস্তবতা।
এই ধীর, সরল, প্রকৃতিনির্ভর জীবনই নাউরুকে টিকিয়ে রেখেছিল হাজার বছর।
এক টুকরো পাথরের গল্প
সবকিছু বদলে যায় ১৮৯৯ সালে। এক ইউরোপীয় নাবিক নাউরু থেকে কিছু সাদা-হলদে রঙের পাথর নিয়ে যান অস্ট্রেলিয়ায়। সেগুলো গিয়ে পড়ে নিউ সাউথ ওয়েলসের ভূতাত্ত্বিক ড. অ্যালবার্ট এলিসের হাতে। পরীক্ষা করে তিনি চমকে ওঠেন।
এই পাথর সাধারণ চুনাপাথর নয়। এতে রয়েছে অত্যন্ত উচ্চমাত্রার ফসফেট— যা কৃষিতে সার হিসেবে সরাসরি ব্যবহারযোগ্য।
এই ফসফেটের উৎস ছিল আরও বিস্ময়কর। হাজার হাজার বছর ধরে সামুদ্রিক পাখিরা নাউরুতে এসে বাসা বেঁধেছে। মাছ খেয়ে দ্বীপের মাটিতে মলত্যাগ করেছে। এই পাখির মল—গুয়ানো—বছরের পর বছর জমে, রোদ-বৃষ্টি-অণুজীবের প্রভাবে ধীরে ধীরে রূপ নিয়েছে কঠিন ফসফেট শিলায়। প্রকৃতি নিজের গতিতে যা বানিয়েছিল হাজার বছরে, মানুষ সেটাকে তুলে নিতে শুরু করল কয়েক দশকে।
হঠাৎ ধনী, হঠাৎ উধাও
১৯০৬ সালের পর জার্মান, পরে ব্রিটিশরা নাউরুতে বিশাল যন্ত্র বসিয়ে ফসফেট উত্তোলন শুরু করে। দ্বীপবাসীরা পায় সামান্য অংশ, কিন্তু মাটি কাটা পড়ে নির্বিচারে।
১৯৬৮ সালে স্বাধীনতার পর নাউরু পুরো ফসফেটের মালিকানা পায়। শুরু হয় সোনালি সময়। ১৯৭০–৮০-এর দশকে নাউরুর মাথাপিছু আয় ছিল বিশ্বের অন্যতম সর্বোচ্চ!
ছোট্ট দ্বীপ, বড় গাড়ি। কাজ কম, আমদানি বেশি। মাছ ধরা ছেড়ে দেওয়া হলো, মাঠে যাওয়ার দরকার রইল না। খাবার এল প্যাকেটে, জীবন এল বিলাসে। কিন্তু ফসফেট তো অসীম নয়।
১৯৯০-এর দশকে এসে ভান্ডার প্রায় শেষ। রপ্তানি বন্ধ। সরকার ভাবল— আগের জমা অর্থ বিদেশে বিনিয়োগ করে চলবে দেশ। কিন্তু দুর্নীতি, ভুল সিদ্ধান্ত আর দুর্বল ব্যবস্থাপনায় সেই অর্থও উধাও হয়ে গেল। হঠাৎ ধনী হওয়া রাষ্ট্রটি হঠাৎ করেই হয়ে গেল দরিদ্র।
মাটি গেল, সাগর গেল, দক্ষতাও গেল
ফসফেট উত্তোলন থামার পর দেখা গেল আসল ক্ষতি তখনই ধরা পড়ছে। দ্বীপের ৮০ শতাংশ জমি এখন অনুর্বর। টপসয়েল নেই। পানি ধরে রাখার ক্ষমতা নেই। ফসল ফলানোর জায়গা নেই।
আরও ভয়াবহ— বছরের পর বছর ফসফেট প্রক্রিয়াজাত করার বর্জ্য ফেলা হয়েছে সমুদ্রে। রীফ ধ্বংস হয়েছে, মাছের আবাস নষ্ট হয়েছে। যে সাগর ছিল অফুরন্ত খাদ্যভাণ্ডার, সেটাই হয়ে গেল শূন্য। নতুন প্রজন্ম আর মাছ ধরতে জানে না। কারণ শেখার প্রয়োজনই তো পড়েনি!
প্যাকেটের দেশ
আজ নাউরু প্রায় পুরোপুরি পরনির্ভর। খাবার আসে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড থেকে—সবই প্রসেসড, প্যাকেটজাত, ইনস্ট্যান্ট।
এর ফল ভয়াবহ। নাউরু এখন বিশ্বের সবচেয়ে স্থূল জনগোষ্ঠীর দেশ। ৯৫ শতাংশের বেশি মানুষ অতিরিক্ত ওজনের। প্রায় অর্ধেক মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত।
এক সময় যে দেশ খাদ্য নিয়ে ভাবতই না, আজ সেই দেশ খাবারের কারণেই অসুস্থ।
নাউরু শুধু নাউরু নয়
নাউরুর গল্প কোনো বিচ্ছিন্ন দুর্ঘটনা নয়। এটা আধুনিক দুনিয়ার একটি আয়না। প্রকৃতির ওপর মাতবরি করে, স্বনির্ভরতা ভুলে গিয়ে, হঠাৎ পাওয়া সম্পদের মোহে পড়ে— একটি সমাজ কত দ্রুত নিজের পা কেটে ফেলতে পারে, নাউরু তার পারফেক্ট উদাহরণ।
নাউরু মাত্র কয়েক দশকে ধ্বংস হয়েছে বলেই আমরা এই গল্পটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশই এই পথে হাঁটছে— শুধু কারও গতি দ্রুত, কারও ধীর।
এখন প্রশ্ন হলো, আমরা নাউরু থেকে শিখব— নাকি একদিন নিজেরাই আরেকটি নাউরু হয়ে উঠব?