Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

পরিবার পরিকল্পনা দম্পতির, ঘুম হারাম অন্যদের!


১ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ১৩:৪০

পরিবার পরিকল্পনা দম্পতিরই হওয়া উচিৎ

রাজনীন ফারজানা।।

‘বিয়ে হয়েছে? তাড়াতাড়ি বাচ্চা নাও’।

‘বিয়ে হয়নি? তাড়াতাড়ি বিয়ে কর। এতো দেরী করে বিয়ে করলে বাচ্চা নিবা কবে?’

‘সংসারে অশান্তি? জামাই কথা শোনেনা? শাশুড়ির সাথে বনেনা? বাচ্চা একটা নিয়ে নাও, সব ঠিক হয়ে যাবে।’

এই কথাগুলোর সাথে কমবেশি সবাই পরিচিত আমরা। যেন পরিবার পরিকল্পনা দম্পতির ব্যক্তিগত বিষয় না, যেন তা আত্মীয়, বন্ধু, পাড়াপ্রতিবেশি, সহকর্মী সকলের গভীর চিন্তার বিষয়।

কেস স্টাডি একঃ সাংবাদিক শায়লা পারভীন (ছদ্মনাম) বিয়ের প্রায় ছয় বছর পর চৌত্রিশ বছর বয়সে সন্তান নেন। এই ছয় বছরে শ্বশুরবাড়ি থেকে তো বটেই সহকর্মী, বন্ধু বান্ধব, আত্মীয় প্রায় সবাই বিয়ের এতদিন হয়ে গেলেও বাচ্চা কেন হচ্ছেনা বলে ক্রমাগত চাপ দিয়েছেন তাকে। তিনি স্থির করেছিলেন বাচ্চা নেওয়ার জন্য মানসিক প্রস্তুতি না নিয়ে তিনি কনসিভ করবেন না। যখন তার মনে হয়েছে বাচ্চা নেবেন তখনই নিয়েছেন। ফলে সন্তানকে মনের মত করে মানুষ করতে পারছেন তিনি। কিন্তু বাচ্চা হওয়ার এক সপ্তাহের মাঝেই হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে তাকে দ্বিতীয় বাচ্চা নেওয়ার পরামর্শ শুনতে হয়েছে।

একসাথে দুই বাচ্চা মানুষ হয়ে যাবে বলে এসব যুক্তি দেখায় এসব লোকজন। কিন্তু প্রথম সন্তান কীভাবে সুস্থভাবে মানুষ হবে তা নিয়ে তারা একটুও চিন্তিত না। এই দম্পতি আরও সন্তান নিতে চান কিনা তাও তাঁরা ভেবে দেখেননি। অথচ অনাকাঙ্ক্ষিত পরামর্শ দিয়ে নতুন বাবা-মাকে বিব্রত করতে পিছুপা নন অনেকেই।

পরিবার পরিকল্পনার অংশ হিসেব একসাথে দুই সন্তান নিয়ে নাও, একসাথে মানুষ হয়ে যাবে এরকম কথা অনেকেই শুনে থাকেন। কিন্তু আদৌ কি তা সম্ভব? এভাবে চাপের মুখে বাচ্চা নিলে সেই তাকে কি সুস্থভাবে বড় করে তোলা সম্ভব?

বিজ্ঞাপন

বিয়ে এবং পরিবার পরিকল্পনায় সামাজিক প্রভাবের বিষয়ে কথা হল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহকারি অধ্যাপক রাশেদা রওনক খানের সঙ্গে। তিনি বলেন, একটি দম্পতির ক্যারিয়ার ঠিকঠাক থাকুক না থাকুক, তাদের বাচ্চা পালনের সামর্থ্য থাকুক না থাকুক, পরপর বাচ্চা নিতে সামাজিকভাবে তাদের উপর চাপ দেওয়া হয় আমাদের দেশে। ফলে দেখা যায় সামাজিক পারিবারিক চাপে দ্বিতীয় সন্তান নিলেও বাবা-মায়েরা দ্বিতীয় সন্তানকে ঠিকমত লালনপালন করতে পারেন না। অনেক সময় দুই সন্তানই হেলফেলায় মানুষ হয়।  এতে তারা নানারকম মনোসামাজিক সমস্যা নিয়ে বেড়ে ওঠে।

শুধু দুই সন্তানই নয় একটা মাত্র সন্তান কিংবা সন্তান ছাড়াও যে পরিবার হতে পারে সেটাও অনেকে মানতে চান না।

 

 

কুমুদিনী মেডিকেল কলেজের স্ত্রী রোগ ও প্রসূতিবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক চিকিৎসক বিলকিস বেগম চৌধুরী বলেন, আমাদের দেশে অধিকাংশ মানুষই ভাবে বিয়ে করলেই বাচ্চা নিতে হবে। তাই বেশিরভাগ দম্পতি পরিকল্পনা ছাড়াই বাচ্চা নেন। অথচ বিয়ে মানেই কিন্তু সন্তান না। বরং বিয়ের পর দম্পতির নিজস্বতা থাকা উচিৎ বলে মনে করেন এই চিকিৎসক। তাছাড়া বাচ্চা নেওয়ার আগে একজন নারীর শারীরিক ও মানসিক স্থিতির খুব দরকার। নাহয় গর্ভকালীন সময়সহ জন্মের পর যত্ন নেওয়া, দেখাশনায় শিশুর ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এছাড়া অপরিকল্পিত গর্ভধারণের ফলে গর্ভপাতের ঝুঁকিসহ নানা জটিলতা দেখা যায় বলে জানান তিনি।

কেস স্টাডি দুইঃ ৩১ বছরের নুজহাত এখন বিয়ে করতে চান না। কেরিয়ার গোছানোর ব্যপারেই আগ্রহী তিনি। তাছাড়া মনের মত সঙ্গী না পেলে বিয়ে করবেন না বলে ভেবে রেখেছেন। কিন্তু বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত নিজের পরিবারকে জানানোর সাহস নাই তার। কারণ বাড়ি থেকে বিয়ের জন্য অসম্ভব চাপ দেওয়া হয়। তাকে বলা হয় এখনও না বিয়ে করলে বাচ্চা কবে নেবেন। বাচ্চা নেওয়ার বয়স নাকি পেরিয়ে যাচ্ছে তার। কেউ একবারও জিজ্ঞাসা করেনা তিনি আদৌ বাচ্চা নেওয়ার ব্যপারে আগ্রহী কিনা। স্বাধীন ঝাড়া হাতপা জীবন বেশ উপভোগ করেন তিনি। বরং তার ভাই বোনদের নিজ নিজ বাচ্চার জন্য জীবনের সব শখ আহ্লাদ বাদ দিতে দেখে বাচ্চার ব্যপারে নুজহাতের কিছুটা নেতিবাচকতাই তৈরি হয়েছে। কিন্তু নুজহাতের ব্যক্তিগত পছন্দ অপছন্দ নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। বরং আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী, সহকর্মী,  বন্ধু থেকে শুরু করে নিতান্ত অপরিচিতরাও তাকে বাচ্চা নেওয়ার জন্য দ্রুত বিয়ে করতে বলেন। এসব নিয়ে এতটাই বিরক্ত যে তিনি আত্মীয়স্বজনের বাড়ি কিংবা বিয়ে বাড়ি যাওয়া ছেড়েই দিয়েছেন বলতে গেলে।

বিজ্ঞাপন

কেস স্টাডি তিনঃ নুজহাতের মত একইরকম যন্ত্রণা ভোগ করতে হয় সাংবাদিক আরমান পারভেজকে (ছন্দনাম)। পঁয়ত্রিশ বছরের আরমান বিয়ে করতে ততটা আগ্রহী নন। কিন্তু তাকে মাঝেমধ্যেই শুনতে হয় এখনও বিয়ে করে বাচ্চা না নিলে কবে আর বাচ্চা মানুষ করে যেতে পারবেন। বয়স তো কম হল না। যেন বিয়ের একমাত্র উদ্দেশ্যই বাচ্চা নেওয়া ও তাদের মানুষ করা। ব্যক্তিগত পছন্দ অপছন্দ তো দূরের কথা দম্পতির নিজস্ব চাহিদাও যেন কোন ব্যপারই না।

বাচ্চা নেওয়ার ক্ষেত্রে বয়স কতটা জরুরি জানতে চাইলে স্ত্রী রোগ বিশেষজ্ঞ বিলকিস বেগম বলেন, ছেলেদের ক্ষেত্রে ছত্রিশ থেকে সাঁইত্রিশ আর মেয়েদের ক্ষেত্রে বিশ থেকে উনত্রিশ বছর বয়সের মধ্যে বাচ্চা নেওয়া ভালো কিন্তু তা বাধ্যতামূলক নয়। এরপর ডায়বেটিস, উচ্চ রক্তচাপসহ নানা ধরণের রোগব্যাধি দেখা দিতে পারে যা গর্ভধারণে জটিলতা তৈরি করে। তিনি বলেন, কেউ ফিট থাকলে বাচ্চা নেওয়ার জন্য বয়স কোন বাধা নয়।

রাশেদা রওনক খান বলেন, আমাদের দেশে একটা শিশু নানারকম মানসিক ও সামাজিক চাপ নিয়েই জন্মগ্রহণ করে। তার জন্মগ্রহন, বেড়ে ওঠা, জীবনধারণ, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে নানামুখী চাপের মুখে থাকতে হয় তাকে। আর বিয়ে এবং সন্তান সম্পর্কিত চাপটা পুরুষের তুলনায় মেয়েদেরকেই বেশি সইতে হয়। আমাদের দেশে সামাজিক বন্ধনের কারণেই আত্মীয় প্রতিবেশীরা নিতান্ত ব্যক্তিগত বিষয়ে এমন চাপ দেওয়ার সুযোগ পান বলে মনে করেন রাশেদা রওনক খান।

অন্যদিকে আমাদের দেশে সন্তান নেয়ার আগে দম্পতিরা স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞের সাথে যোগাযোগ করেন না বললেই চলে বলে অভিযোগ করেন চিকিৎসক বিলকিস বেগম। তাই গর্ভধারণের সময় নানারকম জটিলতা দেখা দেয় বলে জানান তিনি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী নারী সন্তান নেওয়ার বিষয়ে নিজস্ব মতামত জানাতে পারলেও অল্পবয়সী ও অর্থনৈতিকভাবে পরনির্ভরশীল নারীদের এ ব্যপারে তেমন কোন ভূমিকা থাকে না বললেই চলে। স্বামী কিংবা শ্বশুরবাড়ির ইচ্ছাতেই বাচ্চা নিতে বাধ্য হয় মেয়েরা। আবার অনেকসময় দেখা যায় মেয়ের নিজের পরিবার থেকেও চাপ দেয় দ্রুত বিয়ে করে বাচ্চা নিতে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের কারণেই নারীর উপর সন্তাধারণের চাপ বেশি থাকে বলে জানান বিলকিস বেগম চৌধুরী।

উন্নত বিশ্বে বাচ্চা নেওয়ার আগে দম্পতিকে নানারকম প্রস্তুতি নিতে দেখা গেলেও আমাদের দেশে তা বিরল। এই জন্য দেখা যায় লালনপালনসহ তার মৌলিক চাহিদা পূরণের সামর্থ্য না থাকলেও একজন দম্পতিকে সামাজিক চাপের মুখে পড়ে এক বা একের বেশি সন্তান নিতে হয়।

কিছুদিন আগে চট্টগ্রামে দুই সন্তান ও স্ত্রীসহ এক যুবকের আত্মহত্যার ঘটনা দেশব্যাপী আলোড়ন তোলে। ঘটনার নেপথ্যে লোকটির বেকারত্ব ও স্ত্রী সন্তানের ভরণপোষণ করতে না পারার ব্যর্থতা সামনে আসে। রাশেদা রওনক খান বলেন, উন্নত বিশ্বে সন্তান নেওয়ার আগে দম্পতির অর্থনৈতিক অবস্থান, বাচ্চা মানুষ করার বাস্তবতা মাথায় রেখে পরিবার পরিকল্পনা সাজান দম্পতিরা। সঠিক পরিকল্পনা ছাড়া বাচ্চা নিলে Quality সম্পন্ন সন্তান তৈরি হয়না বলে জানান তিনি।

অনেকসময়ই দেখা যায় কোন কোন নারীকে প্রথম সন্তান হতে না হতে দ্বিতীয় সন্তানের ব্যপারে চাপ দেওয়া হয়।

তাছাড়া আজকাল যৌথ পরিবার ভেঙে শহুরে একক পরিবার বেড়ে যাওয়ায় শিশু দেখাশোনার লোক পাওয়াই যায়না বলতে গেলে। দেশে ভালোমানের ও নিরাপদ ডে কেয়ার সেন্টারেরও অভাব আছে। অনেকেই কাজের লোকের কাছে বাচ্চা রেখে কাজে যেতে বাধ্য হন। কিন্তু সেক্ষেত্রে বাচ্চার ঠিকমত যত্ন হয়না। এসব কারণে অনেকসময় মাকে চাকরি ছাড়তে হয়। এভাবে কেরিয়ার থেকে পিছিয়ে যান এসব মায়েরা। সঠিক পরিবার পরিকল্পনার অভাবেই এমনটা ঘটে বলে জানান রাশেদা রওনক খান।

আগের তুলনায় বেশি সংখ্যক মেয়ে কর্মজীবনে প্রবেশ করায় এই জায়গায় কিছুটা পরিবর্তন হলেও পরিবার পরিকল্পনা সম্পূর্ণ দম্পতির হাতেই থাকা উচিৎ বলে মনে করেন তিনি।

অনেকসময় পারিবারিক অশান্তি দূর করতে দম্পতিকে সন্তান নিতে বলা হয়। এতে নাকি সন্তানের মায়ায় স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক ঠিক হয়ে যায়। কিন্তু সন্তানই যদি সব সমস্যার সমাধান হত তাহলে কিছুদিন আগে অভিনেত্রী শ্রাবন্তিকে সংসার টেকাতে প্রধানমন্ত্রী বরাবর সামাজিক মাধ্যমে আবেদন জানাতে হত না। স্বামী স্ত্রীর মধ্যে সমস্যা মেটাতে সন্তান জন্ম দিলে বরং তা মায়ের জন্য বেশি চাপের হয়ে দাঁড়ায় বলে জানান রাশেদা রওনক খান। এরকম পারিবারিক পরিবেশে সন্তানের বেড়ে ওঠার জন্য একটা সুস্থ পরিবেশ নিশ্চিত করতে হিমশিম খেতে হয় মাকে বলে জানান তিনি।

আবার অনেকসময় বয়স্ক আত্মীয়ের মনবাসনা পূরণ করতে, মাদকাসক্ত, অসামাজিক কার্যকলাপে জড়িত ছেলেকে সুস্থ করতে তাকে বিয়ে দেওয়া হয়। এবং বলা হয় বাচ্চার মুখ দেখলে চরিত্র ঠিক হয়ে যাবে। আসলে কি তা হয়?

রাশেদা রওনক খান বলেন, অশান্তি বা তাড়াহুড়ার মধ্যে বাচ্চা আসলে বরং তার ক্ষতিই হয়। এতে করে শিুরর মনোসামাজিক বৃদ্ধিতে প্রভাব পড়ে। তাই অসুস্থ পারিবারিক পরিবেশে কখনই বাচ্চা নেওয়া ঠিক না বলে জানান তিনি।

একটি সন্তান মানে সে শুধু একটা পরিবারের সদস্যই নয়, সে দেশের ও বিশ্বের নাগরিক। একসময় মানুষ বংশ বাড়াতে একের অধিক সন্তান জন্ম দিত। সেই সন্তান কীভাবে বড় হবে তা একদমই গুরুত্ব পেত না। ‘রাখে আল্লাহ মারে কে’ ধরণের চিন্তা করে বাচ্চার ভরণপোষণের ভার অদৃষ্টের হাতে ছেড়ে দিত মানুষ। কিন্তু আধুনিক সময়ে বংশ বাড়ানো থেকেও সন্তানকে যোগ্য ও সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা জরুরি। একটা বাচ্চার মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার সুযোগ নিশ্চিত করেই তবে একটি দম্পতির পরিবার পরিকল্পনা সাজানো উচিৎ।

 

অলঙ্করণ- আবু হাসান

 

সারাবাংলা/আরএফ/ এসএস

কনসিভ করা গর্ভধারণ পরিবার পরিকল্পনা বাচ্চা বাচ্চা নেয়া সন্তান নেয়া

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর