‘বিজয় নিশান উড়ছে ওই’ ডিসেম্বর ১২
১২ ডিসেম্বর ২০১৮ ০৮:৫৮
।। ফারুক ওয়াহিদ ।।
বিজয় মাসের ১২ ডিসেম্বর ১৯৭১ দিনটি ছিল রবিবার। মুক্তিবাহিনী ও মিত্র বাহিনীর ব্যাপক প্রতিরোধের মুখে টিকতে না পেরে ভীতসন্ত্রস্ত হানাদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বিভিন্ন এলাকার ঘাঁটি ছেড়ে লেজ গুটিয়ে দ্রুত গতিতে ঢাকার দিকে পালাতে থাকে। এদিন নীলফামারী, গাইবান্ধা, নরসিংদী, সরিষাবাড়ী, ভেড়ামারা, শ্রীপুর মিত্র-মুক্তিবাহিনী মুক্ত করে।
বঙ্গোপসাগর থেকে মাত্র ২৪ ঘণ্টার দূরত্বে মার্কিন সপ্তম নৌবহর। মিত্রবাহিনীর নৌবাহিনী সপ্তম নৌবহরের আসন্ন তৎপরতা সব উপায়ে বিঘ্নিত করার জন্য চালনা থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ছোট বড় অবশিষ্ট সব জাহাজ ও নৌযান, কক্সবাজার বিমানবন্দর প্রভৃতি অকেজো করে ফেলে।
আরও পড়ুন: ‘বিজয় নিশান উড়ছে ওই’ ডিসেম্বর ১১
দিশেহারা হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী তাদের পরাজয় ঠেকানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বারবার অনুরোধ করতে থাকে। ফলে ১২ ডিসেম্বর ১৯৭১ যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব পাস করার আহ্বান জানায়। ১২ ডিসেম্বর ১৯৭১ জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে উত্থাপিত ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধবিরতির মার্কিন প্রস্তাবে ১৩ ডিসেম্বর ১৯৭১ সোভিয়েত ইউনিয়ন আবারো বাংলাদেশের পক্ষ হয়ে ভেটো দেয়। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শ্রীস্বরণ সিং জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ভাষণ দান কালে বলেন- “ভারতকে যুদ্ধবিরতি জন্য আহ্বান জানানোর আগে এই আহ্বান পাকিস্তানের সামরিক সরকারকে জানানো উচিত।”
এদিকে ঢাকায় সামরিক অবস্থানের ওপর মিত্র-মুক্তিবাহিনীর বিমান হামলা অব্যাহত থাকে। আজ ঢাকায় কোনো সংবাদপত্র এদিন প্রকাশিত হয়নি এবং রেডিও পাকিস্তান ঢাকা স্তব্ধ- মনে হচ্ছে ‘রেডিও পাকিস্তান ঢাকা’ কুম্ভকর্ণ নিদ্রায় আচ্ছন্ন। ঢাকায় কারফিউ অব্যাহত রয়েছে এছাড়া ঘরে ঘরে তল্লাশিও চলে।
আরও পড়ুন: ‘বিজয় নিশান উড়ছে ওই’ ডিসেম্বর ১০
রাতে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে পূর্ব-পাকিস্তান প্রাদেশিক সরকারের সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর সভাপতিত্বে আলবদর, আলশামস কেন্দ্রীয় অধিনায়কদের সঙ্গে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশা প্রণয়ন করা হয়। ফরমান আলী তাদের হাতে তুলে দেন বুদ্ধিজীবীসহ বিশেষ বিশেষ নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের নামের তালিকা। সেদিন রাত থেকেই পাকিস্তানিদের দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামস ধর্মান্ধ ফ্যাসিস্ট বাহিনীর হাতে শুরু হয়ে যায় বুদ্ধিজীবী নিধন।
একাত্তরের এই দিনে পাকিস্তানি হানাদারমুক্ত হয় কক্সবাজার এবং মুক্তিযোদ্ধারা শহরের পাবলিক লাইব্রেরি মাঠে জড়ো হয়ে বিজয়ের লাল-সবুজের পতাকা উড়ান। ১২ ডিসেম্বর সকাল ৮টার মধ্যেই নরসিংদী মিত্র ও মুক্তি বাহিনী মুক্ত করে। বিকেলে মিত্রবাহিনীর আরেকটি ইউনিট ডেমরা ঘাট থেকে মাত্র পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে এসে হাজির হয়। সূর্যাস্তের আগে জামালপুর ও ময়মনসিংহের দিক থেকে মিত্র বাহিনীর জেনারেল নাগরার বাহিনী টাঙ্গাইলে প্যারাস্যুট ব্যাটালিয়নের সঙ্গে যোগ দিয়ে শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তোলে। মিত্রবাহিনী টাঙ্গাইলের মির্জাপুর, কালিয়াকৈর ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে ছত্রীসেনা নামিয়ে রাতে পাকিস্তানি বাহিনীর উপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়। তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসে কাদেরিয়া বাহিনী। শুরু হয় তুমুল যুদ্ধ এবং বিজয়ের বেশে মিত্র-মুক্তিবাহিনী ঢাকার দিকে অগ্রসর হতে থাকে।
আরও পড়ুন: ‘বিজয় নিশান উড়ছে ওই’ ডিসেম্বর ৯
একাত্তরের এই দিনে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার আগের দিন ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের বন্ধুরাষ্ট্র রাশিয়ার প্রতিনিধি ভোরেন্টসভকে কঠোর হুঁশিয়ার করে বলেন- পরদিন (১২ ডিসেম্বর ১৯৭১) ঢাকা সময় মধ্যাহ্নের আগে ভারতকে অবশ্যই যুদ্ধ বিরতি মেনে নিতে বাধ্য করতে হবে- অন্যথায় যুক্তরাষ্ট্র নিজেই প্রয়োজনীয় সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। মার্কিন প্রশাসন ওই দিনই কোনো এক সময়ে তাদের আসন্ন হস্তক্ষেপের সিদ্ধান্ত পাকিস্তানকে জানিয়ে দেয় কারন তখন মার্কিন ৭ম নৌবহর বঙ্গোপসাগরের খুবই নিকটে। এই সংবাদ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জেনারেল নিয়াজি অপেক্ষায় থাকেন পরদিন অর্থাৎ ১৩ ডিসেম্বরের মধ্যাহ্নে পাকিস্তানি বাহিনীকে সাহায্য করার জন্য বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত সপ্তম নৌবহর এসে পড়বে। ঢাকার পাকিস্তানি সামরিক কর্তৃপক্ষ মার্কিন সপ্তম নৌবহরের সাহায্যের আশায় নিজেদের প্রতিরক্ষার আয়োজন সুসংঘটিত করতে ঢাকায় চব্বিশ ঘণ্টার জন্য কারফিউ জারি করে ঘরে ঘরে ব্যাপক তল্লাশি শুরু করে।
আরও পড়ুন: ‘বিজয় নিশান উড়ছে ওই’ ডিসেম্বর ৮
অবরুদ্ধ ঢাকাবাসী শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় আশঙ্কার মধ্যে দিন কাটাচ্ছিলেন কারণ যেকোন সময় মুক্তি-মিত্রবাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়বে ঢাকার বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে থাকা পাকিস্তানি সেনাদের ওপর। তাই সুযোগ পেলেই অনেকে ঢাকা ছেড়ে গ্রামের দিকে মুক্ত এলাকায় চলে যেতে শুরু করেছে। এদিকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে রাণাঙ্গনে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের উৎসাহ দেওয়ার জন্য রাণাঙ্গনের বিজয়ের খবর এবং রক্তগরম করা দেশাত্মকবোধক গান অনবরত প্রচার করতে থাকে। [চলবে]
“মাগো ভাবনা কেন
আমরা তোমার শান্তি প্রিয় শান্ত ছেলে
তবু শত্রু এলে অস্ত্র হাতে ধরতে জানি
তোমার ভয় নেই মা
আমরা প্রতিবাদ করতে জানি ।।
আমরা হারবনা, হারবনা
তোমার মাটির একটি কণাও ছাড়বনা ।।
আমরা পাথর দিয়ে দূর্গ ঘাটি গড়তে জানি
তোমার ভয় নেই মা
আমরা প্রতিবাদ করতে জানি
আমরা অপমান সইবনা
ভীরুর মত ঘরের কোণে রইবনা ।।
আমরা আকাশ থেকে বজ্র হয়ে ঝড়তে জানি
তোমার ভয় নেই মা
আমরা প্রতিবাদ করতে জানি
আমরা পরাজয় মানবনা
দূর্বলতায় বাঁচতে শুধু জানবোনা ।।
আমরা চিরদিনই হাসি মুখে মরতে জানি
তোমার ভয় নেই মা
আমরা প্রতিবাদ করতে জানি
মাগো ভাবনা কেন
আমরা তোমার শান্তি প্রিয় শান্ত ছেলে
তবু শত্র এলে অস্ত্র হাতে ধরতে জানি
তোমার ভয় নেই মা
আমরা প্রতিবাদ করতে জানি।”
[একাত্তরের মূল গানটির গীতিকার: গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার; সুরকার: হেমন্ত মুখোপাধ্যায়]
লেখক: ফারুক ওয়াহিদ, যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী ভারতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা; ২ নং সেক্টর বাঞ্ছারামপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।