‘বিজয় নিশান উড়ছে ওই’ ডিসেম্বর ১৭
১৭ ডিসেম্বর ২০১৮ ০৮:৪০
।।ফারুক ওয়াহিদ ।।
মহান বিজয় মাসের ঐতিহাসিক ১৭ ডিসেম্বর, ১৯৭১ মুক্তবাংলার রাঙাপ্রভাতের প্রথম দিনটি ছিল শীতার্ত পৌষের রোদমাখা শুক্রবার। আজ জয়বাংলা স্লোগানে মুখরিত হওয়ার দিন। আজকের রক্তিম সূর্যোদয় বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে মুক্ত স্বাধীন দেশের প্রথম সূর্যোদয়। হানাদার বর্বর পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে একাত্তরে নয় মাসের সশস্ত্র মহান মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লক্ষ তাজা প্রাণের বিনিময়ে ও ৪ লক্ষাধিক মা-বোনের লাঞ্ছিত হওয়ার বিনিময়ে অনেক সংগ্রাম আর ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে এ রক্তিম সূর্যটাকে আমরা ছিনিয়ে এনেছি। আজকের মুক্ত বাংলার প্রথম সূর্যোদয় অন্য যে কোন দিনের সূর্যোদয় থেকে আলাদা- এ সূর্যোদয়ে ছিল হৃদয়ের উষ্ণতা ও আবেগ জড়িত। ১৭ ডিসেম্বরের ১৯৭১-এর সূর্যোদয়ে যারা রক্তস্নাত ভোরের সূর্য প্রথম দেখেছেন তারা সত্যই সৌভাগ্যবান- আর যারা ১৭ ডিসেম্বরের ১৯৭১-এ মুক্ত স্বাধীন দেশের প্রথম সূর্যোদয় দেখেননি বা দেখেও দেখতে পারেননি তারা আমার মতো দুর্ভাগ্যবান- কারণ আমি তখনও রণাঙ্গনে- ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুরের হানাদার পাকিস্তানি আর্মি তখনও সারেন্ডার করেনি- ১৪ ডিসেম্বর ভোর থেকে চলছে বিরতিহীন তুমল যুদ্ধ- হ্যাঁ আমিও ১৭ ডিসেম্বরের কুয়াশাচ্ছন্ন বাংলার স্বাধীনতার প্রথম সূর্যোদয় দেখেছি তিতাস নদীর তীরে বাঙ্কারে বসে- তবে সে সূর্যোদয়ের রক্তিম সূর্যটাকে আমার কাছে ঢাকার মুক্ত মানুষদের মতো হৃদয়ের উষ্ণতা ও আবেগ দিয়ে ততোটা অনুভব করতে পারিনি- তখনও মুক্ত বাংলার বাতাসে নিঃশ্বাস নিতে পারিনি- বাতাসে ছিল বারুদের ঝাঁজালো তীব্র গন্ধ- শান্ত তিতাসের বয়ে যাওয়া কাজলকালো জলের কলকল রব আর পানকৌড়ি ও মাছরাঙার ডাকের বদলে শুনছি গোলাগুলির শব্দ। ডিসেম্বরের ১৭ তারিখেও পাকিস্তানি সৈন্যদের সারেন্ডারের কোনো লক্ষণই দেখছি না। যুদ্ধরত অবস্থায় বাঙ্কারে বসেই রেডিওতে আকাশবাণী থেকে বার বার শুনেছি যৌথকমান্ড প্রধান জেনারেল মানেকশ’র পাকিস্তানিদের প্রতি নির্দেশ ‘হাতিয়ার ঢাল দো’- কিন্ত আমাদের ধাওয়া খেয়ে ঘাঘটিয়া নামক স্থানে একটি পাকা মসজিদে আশ্রয় নেওয়া বাঞ্ছারামপুরের পাকিস্তানি সৈন্যদের আমরা ঘেরাও করে রাখা সত্ত্বেও ‘হাতিয়ার ঢাল দো’-এর উত্তরে আসছে প্রচন্ড গোলাগুলি। মসজিদ আল্লাহর ঘর শুধু পবিত্র মসজিদের কথা চিন্তা করেই আমরা পাকিস্তানিদের দিকে গোলাগুলি করলেও আমরা আত্মসমর্পণ করানোর জন্য ধৈর্য সহকারে অপেক্ষা করছি- অথচ মসজিদটি তখন গুড়িয়ে দিলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যেতো সেই ক্ষমতা আমাদের ছিল- অথচ সাচ্চা মুসলমান দাবীদার পাকিস্তানিরা কি অপবিত্র, কি অমর্যাদা ও কি অপমানই না করছে আল্লাহর ঘর পবিত্র মসজিদটির!
আরও পড়ুন: ‘বিজয় নিশান উড়ছে ওই’ ডিসেম্বর ১৬
স্বাধীনতার কয়েক বছর পরে সনটা মনে আসছে না সৌদি আরবের রাজপরিবার বা সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা বিদ্রোহীরা যখন মক্কার পবিত্র কাবা শরীফ দখল করে রাখে এবং মক্কা শরীফের সুউচ্চ মিনারে আশ্রয় নিয়ে সারেন্ডার দূরের কথা সেখান থেকে গুলিবর্ষণ করতে থাকে- সৌদি আরবের সরকার দেশের স্বার্থে, দেশের প্রয়োজনে, ইসলামের স্বার্থে এবং সরকারের প্রয়োজনে বিদ্রোহীদের দমন করার জন্য পবিত্র মক্কা শরীফের সুউচ্চ মিনারটি কামান দিযে উড়িয়ে দেয়- অথচ সৌদি আরবে এর কোনো প্রতিক্রিয়াই হয়নি। ঘটনার আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে হঠাৎ সৌদি আবরের এই ঘটনাটির কথা মনে পড়ে গেলো- তাই স্বাধীনতার ৪৭ বছর পর ভাবছি একাত্তরে যুদ্ধের মধ্যে হানাদার পাকিস্তানিদের আশ্রয় নেওয়া সেই আল্লাহর ঘর এই মসজিদটি গুড়িয়ে দিলে কি আমরা অপরাধী হতাম? স্বাধীনতার এতোবছর পর আজ বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা যদি সৌদি আরবের মতো কোনো ঘটনায় দেশের প্রয়োজনে বায়তুল মোকারাম মসজিদের কোনো মিনার কামান দিয়ে উড়িয়ে দিতেন তাহলে মসজিদটি ভাঙ্গার জন্য দেশে কি প্রতিক্রিয়া হতো! চিন্তা করলে শরীর শিহরিত হয়ে উঠে- বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার গদি নিয়ে টানাটানি হতো। যাক এবার মূল আলোচনায় ফিরে আসা যাক।
আরও পড়ুন: ‘বিজয় নিশান উড়ছে ওই’ ডিসেম্বর ১৫
একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর রাতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত এম. আর আখতার মুকুল রচিত ও পঠিত ব্যঙ্গ রসাত্নক কথিকা ‘চরমপত্র’-এর শেষ পর্বটি অর্থাৎ ১১৭ নং পর্বটি রণাঙ্গনের বাঙ্কারে বসে ট্রানজিস্টারের মাধ্যমে শুনেছিলাম এবং ১৭ ডিসেম্বর সকালের অনুষ্ঠানেও পুনরায় শুনেছিলাম। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত রাতের সব অনুষ্ঠান পুনরায় সকালের অনুষ্ঠানেও প্রচারিত হতো। ১৬ ও ১৭ ডিসেম্বর প্রচারিত ও পঠিত এম. আর আখতার মুকুল-এর শেষ পর্ব অর্থাৎ ১১৭ নং পর্ব চরমপত্রটি এখানে দেওয়া হলো:
https://www.youtube.com/watch?v=B-kdxpkRyd4&feature=youtu.be
“কি পোলারে বাঘে খাইলো? শ্যাষ। আইজ থাইক্যা বঙ্গাল মুলুকে মছুয়াগো রাজত্ব শ্যাষ। ঠাস্ কইর্যা একটা আওয়াজ হইলো। ডরাইয়েন না ডরাইয়েন না- ঢাকার কুর্মিটোলায় পিঁয়াজী ছাবে চেয়ার থনে পইড়া গেছিলো। আর এইদিকে রাওয়ালপিন্ডিতে আয় মেরি জান পেয়ারি তমান নূরে জমান আসমান কি চাঁন আঁখুকি তারা আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান সাবে অক্করে চিত্তর হইয়া রইছে। আট হাজার আষ্টশ চওরাশি দিন আগে ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট তারিখে মুছলমান-মুছলমান ভাই-ভাই কইয়া, করাচি-লাহুর-পিন্ডির মছুয়া মহারাজরা বঙ্গাল মুলুকে যে রাজত্ব কায়েম করছিল, আইজ তার খতম্ তারাবী হইয়া গেল।
আরও পড়ুন:‘বিজয় নিশান উড়ছে ওই’ ডিসেম্বর ১৪
বাঙালি পোলাপান বিচ্চুরা দুইশ পঁয়ষট্টি দিন ধইর্যা বঙ্গাল মুলুকের ক্যাদো আর প্যাকের মইদ্দে ওয়ার্ল্ড-এর বেস্ট পাইটিং ফোর্সগো পাইয়া, আরে বাড়িরে বাড়ি। ভোমা ভোমা সাইজের মছুয়াগুলা ঘঁত্ ঘঁত্ কইরা দম ফ্যালাইলো। ‘ইরাবতীতে জনম যার ইছামতীতে মরণ’ আত্কা আমাগো বকশি বাজারের ছক্কু মিয়া ফাল্ পাইড়্যা উঠলো, ‘ভাইসা’ব, আমাগো চক বাচারের চৌ-রাস্তার মাইদ্দে পাথর দিয়া একটা সাইনবোর্ড বানামু হেইডার মাইদ্দে কাউলারে দিয়া লেখাইয়া লমু, ‘১৯৭১ সাল পর্যন্ত বঙ্গাল মুলুকে মছুয়া নামে এক কিছিমের মাল আছিলো। হেগো চোটপাট বাইড়্যা যাওনের গতিকে হাজারে হাজার বাঙালি বিচ্ছু… হেগো চুটিয়া মানে কিনা পিঁপড়ার মতো ডউল্যা শেষ করছিল।’ এই কিছিমের গেনজামরে কেতাবের মাইদ্দে লিইখ্যা থুইছে, ‘পিপীলিকার পাখা উঠে মরিবার তরে।’ টিক্কা মালেক্যা, গেল তল, পিঁয়াজি বলে কত জল।
২৫ শা মার্চ তারিখে সেনাপতি ইয়াহিয়া খান বাঙ্গালিগো বেশুমার মার্ডার করনের আর্ডার দিয়া কি চোটপাট। জেনারেল টিক্কা খান হেই আর্ডার পাইয়া ৩০ লাখ বাঙালির খুন দিয়া গোসল করলো। তারপর… বঙ্গাল মুলুকের খাল-খন্দক, দরিয়া-পাহাড়, গেরাম-বন্দরের মাইধ্যে তৈরি হইলো যিনিস বিচ্চু। ‘যেই রকম বুনো ওল, সেইরকম বাঘা তেঁতুল।’ গেরামের পোলাপান যেমতে কইর্যা বদমাইশ লোকের গতরের মাইধ্যে চোত্রা পাতা ঘইস্যা দেয়, বিচ্চুগো হেই রকম কাম শুরু হইয়া গেল। হেই কাম বিগিন। ঢাঁই-ই-ই-ই। কি হইলো কি হইলো? ঢাকার মতিঝিলে বিচ্চুগো কারবার হইলো। ঘেটাঘ্যাট, ঘেটাঘ্যাট। ঘেটাঘ্যাট, ঘেটাঘ্যাট। কি হইলো? কি হইলো? অংপুরের ভুরুঙ্গামারীতে ভোমা ভোমা সাইজের মছুয়ারা হালাক হইলো। কেইসটা কি? কই না তো? আমাগো মানিকগঞ্জে কোনো টাইমেই মছুয়া আছিলো না তো? মেরামত মিয়া অক্করে চিক্কুর পাইড়া উঠলো, ‘বুঝছি, বুঝছি, পুরা মছুয়া রেজিমেন্টরে আলাদা না পাইয়া প্যাক আর দরিয়ার মাইদ্দে গায়েব কইরা, কী সোন্দর দুই হাত ঝাইড়া বিচ্চুরা কইতাছে, কই না তো? এইদিকে কোনোদিন মছুয়ারা আহে নাই তো?’
ব্যাস, মেসিন গানের লগে মেসিন গান; মর্টারের লগে মর্টারের বাইড়া-বাইড়ি শুরু হইয়া গেল। গাবুর বাড়ির চোটে জেনারেল টিক্কা খান পশ্চিম পাকিস্তানে ভাগোয়াট্ হইলেন। লগে লগে ছদর ইয়াহিয়া নতুন টিরিক্স কইর্যা কয়েকটা বাঙ্গালি হারু মালের মুখে লাগাল লাগাইয়া ‘ক্ষেমতা হস্তান্তর করছি’, বইল্যা চিল্লাইতে শুরু করলো। ঠ্যাটা মালেক্যা গবর্ণর, ওয়ান ম্যান পার্টির ছল্লু মিয়া, মাইনকার চরের আবুল কাসেম, খুলনার খবরের কাগজের হকার এজেন্ট মওলানা ইউসুপ্যা, জয়পুরহাটের মওলানা আব্বাস, ফেনীর ওবায়দুল্লা মজুমদার আর বরিশালের আখতারউদ্দিন মিনিস্টার হইলেন। হবুচন্দ্র রাজার গবুচন্দ্র মন্ত্রী। পালের গোদা ছিয়াত্তর বচ্ছর বয়সের বুড়া বিল্লি অস্তে কইর্যা ছালার মাইধ্যের থনে বাইর অইলো। স-অ-ব কামই হিসাব মতো চলতাছে। সাতটা হারু পাট্টিরে এক গোয়ালে তুইল্যা মওলবী সাবের পেরধান মন্ত্রী হওনের চিরকিত্ হইলো। কার নাম লইতাচি বুঝতে পারতাছেন? হেই যে নুরুল আমিন সাবের- পুরানা তবনের ন্যাকড়া দিয়া উরা বাইনদ্যা বেডায় হাওয়াই জাহাজে পিন্ডি যাইয়া ছদর ইয়াহিয়া খানের অক্করে কোলের মাইধ্যে বইস্যা পড়লো।
আরও পড়ুন: ‘বিজয় নিশান উড়ছে ওই’ ডিসেম্বর ১৩
সেনাপতি আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান যখন আন্তাজ করতে পারলেন যে, কোনো টিরিক্সসেই আর কাম হইতাছে না, তখন পাকিস্তান আর বঙ্গাল মুলুকের লাড়াইডারে ইন্ডিয়া-পাকিস্তানের গেনজাম বইল্যা চালু করণের লাইগ্যা ভট্ কইরা কইয়া বইলো, ‘আমি কিন্তু আর নিজের আটকাইয়া রাখতে পারতাছি না, আমার লগে নতুন মামু রইছে, বুড়া চাচা রইছে। আমি ইন্ডিয়া Attack করমু। দিনা দশেকের মাইধ্যে আমি এই কারবার কইরা বমু। এইবার আমি নিজেই পিন্ডির থনে বর্ডারে যামুগা।’ যেই কাথা, হেই কাম। মাথার আপার চ্যামবার খালি ছদর ইয়াহিয়া- যা থাকে ডুঙ্গির কপালে কইয়া কারবার কইর্যা বইলো। কিন্তু মওলবী সাবরে আর বর্ডার-এ যাইতে হইলো না। আতকা শরাবন তহুরার গিলাস টেবিলের উপর ঠক কইরা থুইয়া দ্যাখে কী? লাড়াই রাওয়ালপিণ্ডির দরজায় আইস্যা হাজির হইছে। পাশে আজরাইল ফেরেশতা খাতা হাতে খাড়াইয়া রইছে। খাতায় লেখা সাদাপাকা মোটা মোটা ভুরু-ওয়ালা আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান, পিতা আননোন।
হ-অ-অ-অ এইদিককার কারবার হুনছেন নি? সবই হবুর কারবার। হবু পেরধান মন্ত্রী চুরুল আমীন, হবু দেশরক্ষা মন্ত্রী মিয়া মোমতাজ মোহাম্মদ দৌলতানা, হবু যোগাযোগমন্ত্রী আগায় খান পাছায় খান খান আব্দুল কাইয়ুম খান, হবু পোস্টঅপিসের মন্ত্রী ইসলামের যম গোলাম আজম আর হবু ফরিন মিনিস্টার মদারু ভুট্টো। কেউই শপথ লইতে পারে নাইকা-টাইম শর্ট। বঙ্গাল মুলুকে বিচ্চুগো গাজুরিয়া আর কাদেরিয়া মাইর শুরু হইয়া গেছে। ঠ্যাটা ম্যালেক্যার কী কাঁপন! মওলবী সাবে বাঙ্কারের মাইধ্যে বইস্যা বল পয়েন্ট পেনসিল দিয়া গবর্ণরের পদ থাইক্যা ইসতফা দিছে। এরেই কয় ঠ্যালার নাম জশমত আলী মোল্লা। বেডায় তার স্যাঙ্গাতগো লইয়া কী সোন্দর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল -এর মাইধ্যে হান্দাইছে। কিন্তু মওলবী সাব বহুত লেইট কইর্যা ফেলাইছেন। আপনার ঘেটুগো খবর কি?
ছহি আজাদ পত্রিকার হরলিকের বোতল ছৈয়দ ছাহাদত্ হোসেন, উনি সিলট্ট নিবাসী মর্নিং নিউজের এসজিএম বদরুদ্দিন, ছালাউদ্দিন মোহাম্মদ সংগ্রাম পত্রিকার মাওলানা আখতার ফারুক্ক্যা, দৈনিক পাকিস্তানের আহসান আহম্মদ আশক, পাকিস্তান অবজার্ভারের খাসির গুর্দার শুরুয়া খাওইন্যা মাহবুবুল হাক, নেশন্যাল ব্যুরোর দাড়ি নাই মাওলানা ডা: হাসান জামান- এসব মালেরা অখন কি করবো? প্রাক্তন ফরিন মিনিস্টার হরিবল হাক্ চৌধুরীর কোনো খবর নাইক্যা- সিলেটের হারু মাল চুষ পাজামা মাহমুদ আলীর কোনো আও-শব্দ পাওয়া যাইতাছে না। কি হইলো? এদ্দিন তো শাহ্ মোহাম্মদ আজিজুর রহমান আর দরদী সংঘের দালাল সম্রাট এ.টি. সাদ’দীরে লইয়া খুবই তো ফাল্ পাড়তাছিলা-মাল-পানি জিন্দাবাদ। মাল-পানি জিন্দাবাদ। এলায় করবা কি?
আরও পড়ুন: ‘বিজয় নিশান উড়ছে ওই’ ডিসেম্বর ১২
আমার সাজানো বাগান হুকাইয়া গেল। অ্যা: এ্যা: একটিং- জাতিসংঘে মদারু ভুট্টো জেনারেল পিঁয়াজীর ছারেন্ডারের খবর পাইয়া একটিং করছে। পয়লা গরম, তারপর নরম হেরপর আরে কান্দনরে কান্দন! পকেটের রুমাল বাইর কইর্যা চোখ মুইচ্ছ্যা নাক ক্লিয়ার কইরা লইলো। চিল্লাইয়া কইলো, ‘ছারেন্ডার-ছারেন্ডার তো’ ইমপস- মানে কিনা অসম্ভব। আমরা ছারেন্ডার করমু না। আমরা পাইট করমু, আমরা পাইট করমু। এই না কইয়া মদারু মহারাজ আত্কা গতরের জামাকাপড় থুড়ি-ফ্রান্স-বৃটেনের খসড়া প্রস্তাব টুকরা টুকরা কইর্যা ছিইড়্যা ফেলাইয়া ঘেটমেট কইর্যা বাইরঅইয়া গেল। বাইরঅয়নের টাইমে ইন্ডিয়া-রাশিয়ার লগে ফ্রান্স-বৃটেনরে তুফান গাইল। সাদা চামড়ার জেন্টেলম্যানরা খালি কইলো, ‘যার লাইগ্যা চুরি করি, হেই কয় চুর।’
জাতিসংঘ থাইক্যা আগাশাহীর রুমে আহনের লগে লগে ‘মওলবী সাব-এ খবর পাইলো, ‘খেইল খতম, পয়সা হজম।’ আট হাজার আষ্টশ চুওরাশী দিনের সোনার হাঁস, মানে কিনা বঙ্গাল মুলুকসহ পাকিস্তান নামে দেশটা শ্যাষ হইয়া গেছে। আমাগো বকশিবাজারের ছক্কু মিয়া একটা গুয়ামরি হাসি দিয়া গালাটা খ্যাকরানি মারলো। ‘ভাই সাব ২৬ শা মার্চ এই মদারু ভুট্টো ঢাকার থনে করাচীতে ভাগোয়াট্ হইয়া কইছিল, ‘আল্লায় সারাইছে, ছদর ইয়াহিয়া বেশুমার বাঙালি মার্ডারের অর্ডার দেওনের গতিকে পাকিস্তানটা বাঁইচ্যা গেল।
আরও পড়ুন: ‘বিজয় নিশান উড়ছে ওই’ ডিসেম্বর ১১
কেমন বুঝতাছেন? বিচ্চুগো গাবর বাড়ির চোটে হেই পাকিস্তানটা কেমতে জানি ফাঁকিস্তান হইয়া গেল? হেইর লাইগ্যাই কইছিলাম, কি পোলারে বাঘে খাইলো? শ্যাষ। আইজ থাইক্যা বঙ্গাল মুলুকে মছুয়াগো রাজত্ব শ্যাষ। আইজ ১৬ই ডিসেম্বর। চরমপত্রের শ্যাষের দিন আপনাগো বান্দার নামটা কইয়া যাই। বান্দার নাম এম. আর আখতার মুকুল। জয় বাংলা। খোদা হাফেজ।”
এবার রণাঙ্গনের খবর: ১৭ ডিসেম্বর বাগেরহাট মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিন রাজাকারদের ক্যাম্প বাগেরহাট ডাকবাংলো দখল করে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে দেয়। রাজাকাররা আত্মসমর্পণ করে- মুক্ত হয় বাগেরহাট।
১৪ ডিসেম্বর সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রাম মুক্তাঞ্চলে পরিণত হলেও রাঙামাটিতে বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা উড়ে ১৭ ডিসেম্বর। ১৯৭১-এর এর ১৪ ডিসেম্বর রাঙামাটির বরকলে বাংলাদেশ বিমানবাহিনী দুটি বিমানযোগে পাকিস্তান সেনা বাহিনীর শক্ত ঘাঁটিতে আক্রমণ চালায়। এতে টিকতে না পেরে সেখানে অবস্থানরত প্রায় সাতশ পাকিস্তানি সৈন্য মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে।
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয় শেষে রাঙামাটিতে স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উড়ানো হয় ১৭ ডিসেম্বর। কিন্তু তার তিনদিন আগে অর্থ্যাৎ বিজয় মুহূর্তে জেলা কমান্ড ইউনিট কমান্ডার রোবার্ট রোনাল্ড পিন্টু একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের পটভূমি বর্ণনা করে বলেন, পরদিন ১৫ ডিসেম্বর মিত্রবাহিনী রাঙামাটি দখলে নেয়। কিন্তু ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হলেও পশ্চাৎপদ অঞ্চল হওয়ার কারণে রাঙামাটিতে স্বাধীন বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক পতাকা উড়ে বিজয়ের পরদিন ১৭ ডিসেম্বর। সেইদিন রাঙামাটির শহীদ আব্দুস শুক্কুর মাঠে আনুষ্ঠানিকভাবে পতাকা উত্তোলন করেন বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত) মনীষ দেওয়ান। সেই অনুষ্ঠানে তৎকালীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক এইচটি ইমাম উপস্থিত ছিলেন।
আরও পড়ুন: ‘বিজয় নিশান উড়ছে ওই’ ডিসেম্বর ১০
১৭ ডিসেম্বর শুক্রবার কিশোরগঞ্জ মুক্ত হয়। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কিশোরগঞ্জ ছেড়ে পালিয়ে যায় ১২ ডিসেম্বর কিন্তু শহরে শক্ত ঘাঁটি তৈরি করে অবস্থান নেয় রাজাকার-আলবদর বাহিনী এবং শহরের নিয়ন্ত্রণ ছিল রাজাকার-আলবদরদের হাতে। মুক্তিযোদ্ধরা কিশোরগঞ্জকে মুক্ত করার জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়ে শহরকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে সামনে অগ্রসর হতে থাকে- অবশেষে মুক্তিযোদ্ধারের প্রতিরোধের মুখে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয় স্বাধীনতা বিরোধীরা। ১৭ ডিসেম্বর সকালে একটি খোলা জিপে করে মুক্তিযোদ্ধা কবির উদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি সশস্ত্র দল কিশোরগঞ্জ শহরে প্রবেশ করে। শহরের পুরান থানা শহীদি মসজিদ সংলগ্ন ইসলামিয়া ছাত্রাবাস মাঠে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে অস্ত্র জমা দিয়ে আত্মসমর্পণ করে রাজাকার-আলবদর বাহিনী। একই সময়ে শহরের চারদিকে অবস্থানকারী অন্য মুক্তিযোদ্ধারা শহরে এসে প্রবেশ করে। এ সময় জয়বাংলা ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠে পুরো শহর।
১৭ ডিসেম্বর শুক্রবার ফরিদপুর মুক্ত হয় এবং বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা উড়ে। যশোর ক্যান্টনমেন্টের প্রায় সব পাকিস্তানি সৈন্য তখন তাদের অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে ফরিদপুরে অবস্থান করছিল। যশোর সেনা অঞ্চলের প্রধান ব্রিগেডিয়ার আবরার প্রথমে ওয়্যারলেস মেসেজের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের সাবসেক্টর কমান্ডার ফ্লাইট লে. জামাল চৌধুরীর কাছে আত্মসমর্পণের অনুমতি চান এবং পরে ফরিদপুর থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেজর সাদেককে দিয়ে আত্মসমর্পণের চিঠি পাঠানো হলো বোয়ালমারী জর্জ একাডেমিতে অবস্থানরত ফ্লাইট লে. জামাল চৌধুরীর কাছে। জামাল চৌধুরী মেজর সাদেকের কাছ থেকে আত্মসমর্পণপত্র গ্রহণ করেন ১৭ ডিসেম্বর সকাল ৯টায় বোয়ালমারী জর্জ একাডেমিতে। বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহ মোহাম্মদ আবু জাফর বেলা ২টায় স্বাধীন ফরিদপুরের মাটিতে সর্বপ্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন।
আরও পড়ুন: ‘বিজয় নিশান উড়ছে ওই’ ডিসেম্বর ৯
এদিকে ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ মুক্ত মহানগরী ঢাকা ছিল আনন্দ মিছিলে প্লাবিত- মুক্ত জনতা জয়বাংলা বিজয়ধ্বনিতে কাঁপিযে তুলছে ঢাকার আকাশ বাতাস- ঢাকার আনন্দের জোয়ারের প্লাবন ‘বাড়ির কাছে আরশিনগর’ আগরতলাকেও প্লাবিত করে ফেলে। জয়বাংলা জয়ধ্বনি দিয়ে আগরতলায় বাঁধ ভাঙ্গা উচ্ছ্বসিত আনন্দের জোয়ারে ভাসছে মানুষ- এই আনন্দ মিছিলের সাথে শরণার্থীরাও যোগ দিয়েছে। ১৭ ডিসেম্বর ভারতের পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে নতুন বাংলাদেশকে স্বাগত জানান ভারতনেত্রী বাংলাদেশের বিপদের অন্তরঙ্গ বন্ধু ইন্দিরা গান্ধি। [চলবে]
লেখক: ফারুক ওয়াহিদ, যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী ভারতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা; ২ নং সেক্টর বাঞ্ছারামপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।