ঘর হতে দুই পা ফেলা এক এলিজা
২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ২০:৫৩
নিজেকে ট্রাভেলার ভাবতেই ভালোবাসেন এলিজা বিনতে এলাহী। ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব প্রেমী এলিজা তার অনুরাগের জায়গা থেকেই দেশে পর্যটনের সম্ভাবনাময় এক খাত হেরিটেজ ট্যুরিজম গড়ে তুলতে উদ্যোগী হয়েছেন। এর অংশ হিসেবে ঘুরে বেরিয়েছেন দেশের ৬৪ টি জেলা। হেঁটেছেন ইতিহাসের পথে। ঐতিহ্যের পথে। বিশ্ব পর্যটন দিবসে এই খাতের সম্ভাবনা নিয়ে এলিজা কথা বলেছেন পার্থ সনজয়’র সাথে।
প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা আমাকে মানুষের সীমাহীন ক্ষমতার কথা মনে করিয়ে দেয়…
আমার গ্র্যাজুয়েশন ইংরেজি সাহিত্যে। গ্রিক, রোমান আর ইজিপশিয়ান মিথ আমাকে টেনেছে প্রবলভাবে। গেল বিশ বছর ধরে আমি পৃথিবী ঘুরে বেরিয়েছি। ইউরোপে পথে পথে হেঁটে দেখেছি, তারা কিভাবে নিজেদের ঐতিহ্যকে বিপনন করেছে। ইউরোপের সেই হেরিটেজ পর্যটনই আমাকে আগ্রহী করেছে। আমাদের কী আছে, সেই খোঁজ থেকেই শুরু আমার হেরিটেজ জার্নি।
প্রকৃতি তো অনেক বিশাল। প্রকৃতির মাঝখানে আমি নিজেকে খুঁজে পাই না। বরং ইতিহাস, প্রত্নতত্ত্ব স্থাপনা আমাকে মানুষের সীমাহীন ক্ষমতার কথা মনে করিয়ে দেয়। এই যে ধরুন, শের শাহ’র সৃষ্টি গ্র্যান্ড ট্রাংক রোড-এটি আমাকে আকর্ষণ করে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ঘুরতে ঘুরতে আমার মনে হলো, আমাদেরও কত সমৃদ্ধ ইতিহাস। এখানে এসেছেন বিশ্ব বিখ্যাত ট্রাভেলাররা। এসেছেন ইবনে বতুতা, হিউয়েন সাং, ফা হিয়েন, ভাস্কো দা গামা-এরা সবাই ভারতবর্ষে এসেছেন। আমাদের ইতিহাস তারাই লিপিবদ্ধ করেছেন। সেই ইতিহাস, স্থাপনা আমরা কেন ব্যবহার করছি না?
সেই খোঁজ, সেই আকর্ষণেই বেরিয়ে পড়া ঘর হতে দুই পা ফেলে!
প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা শুধু নয়, পেছনের ইতিহাসটাও ট্যুরিজমের অংশ…
দেশজুড়ে অবহেলায় ধুঁকতে থাকা হাজারো স্থাপনা আর ঐতিহ্য ঘুরে আমার মনে হয়েছে, ইউরোপের মতোই সমৃদ্ধ সম্ভার আমাদের। অথচ আমাদের ঐতিহ্যগুলো দেখার উপযোগী নয়। অবকাঠামো গড়ে তোলা যায় নি। প্রচার নেই। ডিজাটাইজেশনের সুবিধা আমরা নিতে পারি নি। কোন অংশেই ইউরোপ থেকে পিছিয়ে নেই আমরা। আমাদের নেই সমন্বয়। পর্যটনের সাথে হেরিটেজ ট্যুরিজমের সমন্বয়, মেলবন্ধন-কোনটাই আমাদের নেই।
শুধু প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা নয়, এর পেছনের ইতিহাসটাও এই ট্যুরিজমের অংশ। কোন এলাকার পোশাক, খাবার, মিষ্টি, পার্বত্য অঞ্চলের গয়না-এগুলোও হেরিটেজের অংশ। আমি কুড়িগ্রামের একটা অঞ্চলে দেখেছি, সেখানকার মেয়েরা নাকে পাঁচটা ফুটো করে। তার একটাতে হয়তো তার শ্বাশুড়ি নথ পরিয়ে দিচ্ছে, অন্যটাতে স্বামী দিচ্ছে কিংবা ভাসুর দিচ্ছে। তো এগুলো কত মজার! এগুলোকেই সামনে তুলে ধরতে হবে।
আমাদের বৈচিত্র্য আছে। বৈচিত্র্য, সমৃদ্ধি, প্রাচীনত্ব-যাই বলি না কেন কোন অংশেই কম নেই। এগুলোকে গোছাতে হবে। গোছানোর কথা বলতেই, সম্ভাবনা আর চ্যালেঞ্জ খুঁজতেই আমার এই হেরিটেজ ভ্রমণ।
হেরিটেজ ট্যুরিজম ধারণাটাই গড়ে ওঠেনি….
আমি সরেজমিন ভ্রমণ করতে গিয়ে যে সমস্যাগুলো পেয়েছি, তাতে সব থেকে বড় সমস্যা আবাসন। নিরাপত্তা সমস্যা আছে। আছে তথ্যের অপ্রতুলতা। প্রত্নতত্ত্ব স্থাপনাগুলো দেখার উপযোগী করতে হবে। কারন এক একটা রাজবাড়ির এতই ভগ্নদশা! শুধু রাজবাড়ি কেন, অর্ধ খননকৃত বেশ কিছু বৌদ্ধ বিহার দেখেছি আমি। বৌদ্ধ বিহার বললেই শুধু পাহাড়পুরের কথা আমরা বলি। তার চেয়েও প্রাচীন সীতাকোট বিহার, যেটি পাঁচ শতকে তৈরি। আরো প্রাচীন ভাতের ভিটা বৌদ্ধ বিহার আমি পেয়েছি মাগুড়ায়। অল্প কিছু খনন করা হয়েছে এই বিহার। এরপর ঢেকে দেয়া হয়েছে। গাইবান্ধায় আরেক প্রাচীন বৌদ্ধ বিহার দেখেছি, যার খবর স্থানীয়রা জানেনই না। এটি ১৯৫৯ সালে খনন করা হয়েছিল। এই সব এলাকায় গিয়ে আমি দেখেছি, ঐতিহ্য যে পর্যটনের অংশ হতে পারে তার ধারণাই স্থানীয় প্রশাসনের নেই।
ঘোষণা করা হোক হেরিটেজ ট্যুরিজম ডে
আমি দেশজুড়ে ঘুরেছি, হেরিটেজ ট্যুরিজম ধারনাটাকে প্রতিষ্ঠিত করতে। আমার পুরো ভ্রমণ, আমি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছবি, ভিডিও আকারে দিয়েছি। আগামীতে একটা হেরিটেজ ফেয়ার করতে চাই। যেখানে এই খাত নিয়ে বিশেষজ্ঞরা কথা বলবেন। আলোকচিত্রে তুলে ধরা হবে হেরিটেজ ট্যুরিজম। আরো নানা কিছু।
আমি চাই, পর্যটন দিবসের মতোই একটা হেরিটেজ ট্যুরিজম ডে ঘোষণা করা হোক। প্রতিবছর যদি দিনটি পালিত হয় তবে তা দেশের পর্যটনকে নতুন দিশা দেবে, বিশ্বাস করি।