Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

নারী ভাষাসংগ্রামীদের স্বীকৃতি কোথায়?


২১ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০৯:০০

‘ভাষাসংগ্রামী হিসেবে স্বীকৃতি দাবি করার ইচ্ছা নাই। দেশের জন্য কাজ করেছি। ছোট্ট বয়সে যতটুকু বুঝেছিলাম, সে অনুযায়ী দেশের ডাকে সাড়া দিয়েছিলাম। জনগণ, আমার শিক্ষার্থী ও পরিবারের লোকজন আমাকে ভালোবাসে— এটাই আমার স্বীকৃতি,’— বলছিলেন ভাষাসংগ্রামী রাজিয়া খাতুন।

রাজিয়া খাতুনের জন্ম নড়াইলে। সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আন্দোলনে নেমে পড়েন। স্কুল থেকে বের হয়ে কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মিছিলে যোগ দেন। বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারিতে সালাম, রফিক, বরকতদের মারা যাওয়ার খবর শোনার পরদিনই আন্দোলনে যোগ দেন। ভাষার জন্য আন্দোলন করতে গিয়ে জীবন দেওয়ার এই দৃষ্টান্ত তার মধ্যে তুমুল আলোড়ন তৈরি করেছিল। তিনিও ঠিক করলেন, ভাষার জন্য লড়ে যাবেন।

বিজ্ঞাপন

রাজিয়া খাতুনের মতো অনেক নারী ভাষাসংগ্রামীর কথা আমরা জানি। মমতাজ বেগম, রওশন আরা বাচ্চু, সুফিয়া আহমেদ, শামসুন্নাহার আহসান, নাদিরা বেগম, হালিমা খাতুন, মাহফিল আরার মতো নারীরাও একুশের দিনে সক্রিয়ভাবে ছিলেন। মিছিলে অংশ নিয়েছিলেন। ১৪৪ ধারা ভাঙার পক্ষে গিয়ে ছেলেদের সঙ্গে অনেক নারী যুক্ত হয়েছিলেন আমতলার সভায়।

ঢাকায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার মিছিলে অংশগ্রহণকারী কিংবা সারাদেশে ভাষার দাবিতে আন্দোলনে ভূমিকা রেখেছেন যে নারীরা, রাষ্ট্র ও সমাজ কীভাবে তাদের মূল্যায়ন করেছে? ভাষা আন্দোলন সম্পর্কিত আলোচনা, গবেষণা, নিবন্ধ ও পাঠ্যপুস্তকে এই নারীদের কথা কতটুকু তুলে ধরা হয়? এই বিষয়গুলো যাচাই করা এখন সময়ের দাবি।

ভাষাসংগ্রামীদের সবাই প্রায় চলে গেছেন। খুব কম ভাষাসংগ্রামীই এখন জীবিত আছেন। যারাও আছেন, বয়সের কারণে সেই দিনগুলোর স্মৃতিচারণা করা তাদের পক্ষে বেশ কঠিন। অনেক চেষ্টার পর আমরা ভাষাসংগ্রামী রাজিয়া খাতুনের সঙ্গে কথা বলতে পেরেছি। সারাবাংলার পাঠকদের জন্য সেই কথোপকথন তুলে ধরা হলো:

বিজ্ঞাপন

সারাবাংলা: ভাষা আন্দোলনে যুক্ত হলেন কীভাবে?

রাজিয়া খাতুন: একুশে ফেব্রুয়ারির ঘটনা আমাকে অত্যন্ত বিক্ষুব্ধ করে। বাইশে ফেব্রুয়ারি স্কুলে গেলাম। আমার স্কুল থেকে বাড়ি প্রায় এক মাইল দূরে। দেখলাম, কলেজের শিক্ষার্থীরা আমাদের স্কুলে এসেছে। তারা আমাদের মিছিলে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছে। আমার এক চাচা তখন স্কুল কমিটিতে ছিলেন। তিনি আমাদের বললেন, তোমরা চাইলে মিছিলে যেতে পার। আমরাও যুক্ত হলাম তাদের সঙ্গে। মাত্র তিন জন মেয়ে ছিলাম। মিছিল শুরু হলো। রাস্তার দুই পাশে পুলিশ দাঁড়িয়ে ছিল। বলা যায়, একরকম পুলিশি পাহারায় আমরা মিছিল করতে লাগলাম। স্কুল থেকে প্রায় ২ মাইল দূরে মিছিল নিয়ে গিয়েছিলাম সেদিন।

মিছিল শেষ করে তৎকালীন কালিদাস ক্যাম্প (বর্তমান নাম পৌরসভা পুকুর) সেখানে পৌঁছালাম। ফুল জোগাড় করলাম আমরা। ইট দিয়ে উঁচু করে একটি জায়গা বানিয়ে তাতে একুশে ফেব্রুয়ারির শহিদদের উদ্দেশে ফুল দিলাম। তারপর রাতে বাসায় না গিয়ে সুফিয়া খাতুনের (নড়াইলের আরেকজন নারী ভাষাসংগ্রামী) বাড়িতে গেলাম। রাতে ওদের বাসায় মিটিং করলাম। পরদিন আবারও মিছিল করলাম। দেশের ওই অবস্থায় প্রত্যেকেই ভয়ে ছিলাম। তবে আমার ভয়টা একটু কমই ছিল।

এরপর থেকে ভাষার দাবিতে নিয়মিত মিছিল-সমাবেশে অংশগ্রহণ করি। গোপনে মিটিং করেছি অনেক। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে যুক্ত করার জন্য কাজ করেছি।

সারাবাংলা: আপনার একাজে পরিবার আপত্তি জানায়নি?

রাজিয়া খাতুন: আমার বাবা কমিউনিস্ট পার্টি করতেন। বাবা দেশের জন্য কাজ করতেন। এটা আমার ভালো লাগত। ফলে পারিবারিক বাধা তেমন ছিল না। তবে মেয়ে বলে একটু টেনশন তো তাদের থাকত-ই।

সারাবাংলা: সেই সময়কার উল্লেখযোগ্য কোনো ঘটনা মনে পড়ে?

রাজিয়া খাতুন: একবার বাবাকে ধরার জন্য বাসায় পুলিশ এসেছিল। তো আমরা আগে থেকেই বুঝতে পেরেছি যে পুলিশ আসবে। তাই ইট-পাটকেল তৈরি করে রেখেছি যে পুলিশ আসলেই আক্রমণ করব। আশপাশের লোকজনকেও বলে রেখেছিলাম আমরা। বাবার পার্টির লোকজনও ছিল। তারপর পুলিশ যখন আসলো, তখন সত্যি সত্যি পুলিশের মাথায় প্রথম ঢিল ছুঁড়লাম আমি। পরে ওই দুই পুলিশকে আটকে রাখা হলো। সারাদিন আটকে রাখার পর সন্ধ্যায় ওদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এই ঘটনাটি এখনও মনে পড়ে মাঝে মাঝে।

সারাবাংলা: মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন?

রাজিয়া খাতুন: আসলে মুক্তিযুদ্ধে আমি তেমন সক্রিয় থাকতে পারিনি। যুদ্ধের অনেক আগেই আমার বিয়ে হয়ে যায়। আমি তখন বাচ্চার মা। বাচ্চারাও খুব ছোট তখন। ফলে যুদ্ধে যেতে পারিনি।

সারাবাংলা: আপনার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে বলুন।

রাজিয়া খাতুন: ’৫৭ সালে ম্যাট্রিক পাশ করি। তারপর বিয়ে হয়ে যায়। বিয়ের পর পড়ালেখা চালিয়ে যাই। ইন্টারমিডিয়েট পাশ করি। সত্তর সালে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চাকরি শুরু করি। এখন আমি চার ছেলে ও দুই মেয়ের মা।

সারাবাংলা: সরকারি স্বীকৃতি পেয়েছেন কি?

রাজিয়া খাতুন: ভাষাসংগ্রামী হিসেবে আমাকে স্বীকৃতি দেয়নি। ফলে সরকার থেকে কোনো সুযোগ-সুবিধা পাই না। তাছাড়া আমি স্বীকৃতি দাবিও করি না। আমি মনে করি, দেশের জন্য কাজ করেছি। দেশ স্বাধীন হয়েছে সেটাই আমার কাছে বড়।

একুশে পদকে নারীর অবস্থান

রিজিয়া খাতুনের মতো অনেক নারী ভাষাসংগ্রামী আজও রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক স্বীকৃতি পাননি। মর্যাদাপূর্ণ একুশে পদকপ্রাপ্তির তালিকাতেও হাতেগোনা কয়েকজন নারীর নাম পাওয়া যায়। ২০০২ সালে সুফিয়া আহমেদ, ২০১৭ সালে শরীফা খাতুন এবং ২০১৯ সালে হালিমা খাতুন পেয়েছিলেন একুশে পদক। আর শহিদ মিনারের নকশাকারী ভাস্কর নভেরা বেগম ও নারায়ণগঞ্জের মরগ্যান হাইস্কুলের শিক্ষক মমতাজ বেগম এর আগে পেয়েছিলেন একুশে পদক। এর বাইরে আর কোনো নারী একুশে পদক পাননি।

শবনম ফেরদৌস ভাষাসংগ্রামী নারীদের নিয়ে ২০০৮ সালে একটি প্রামাণ্যচিত্র ‘ভাষা জয়িতা’ নির্মাণ করেছিলেন। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, “নারীর স্বীকৃতি খুব কম জায়গাতেই আছে। বিশেষ করে রাজনীতিতে নারীকে অত্যন্ত দুর্বল মনে করা হয়। ভাবা হয়, রাজনীতি পুরুষের জায়গা। তাই ‘শহিদ’ হিসেবে ধরা হয় পুরুষদের। ‘নারী শহিদ’ ক’জন বলে! মিছিল মানেই পুরুষ।”

তবে পরিস্থিতি এমন ছিল না উল্লেখ করে শবনম ফেরদৌস বলেন, “একসময় নারীদের সম্মান ছিল। নারীকে ‘নারী’ হিসেবে সম্মান করত সমাজ। কিন্তু এখন এসবের কোনো বালাই নেই। সুযোগ পেলেই নারীকে অপমান করতে চায়। বেশ্যা বলতে চায়।”

কেন নারীরা অবমূল্যায়িত হচ্ছেন?

নারী ভাষাসংগ্রামীদের যথাযথ মূল্যায়ন না করা প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক ও ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘যেহেতু আমরা পিতৃতান্ত্রিক সমাজে বাস করি, ফলে নারীর ভূমিকা প্রায় সবক্ষেত্রেই অবমূল্যায়িত হয়। দ্বিতীয়ত, একুশে ফেব্রুয়ারির আন্দোলনে সরাসরি যুক্ত হওয়া নারীর সংখ্যা তুলনামূলক কম ছিল। তাদের উপস্থিতি কম থাকার কারণে ততটা দৃশ্যমান হয়নি।’

তিনি আরও বলেন, ‘ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে স্বীকৃতির কথায় প্রথমেই আসে শিক্ষিত মধ্যবিত্তের নাম। তারপর আসে পুরুষের নাম। অথচ এই আন্দোলনগুলোতে হাজার হাজার সাধারণ মানুষ জীবন দিয়েছে। অসংখ্য নারীদের আত্মত্যাগ আছে। এগুলো আলোচনায় আসে না।’

অনন্য ভাষাসংগ্রামী ‘মমতাজ বেগম’

নারী ভাষাসংগ্রামীদের মধ্যে উজ্জ্বল হয়ে আছে মমতাজ বেগমের নাম। নারায়ণগঞ্জের মরগ্যান হাইস্কুলের শিক্ষক মমতাজ বেগম ভাষা আন্দোলনের যুক্ত হলে একপর্যায়ে তাকে জেল খাটতে হয়। তখন স্কুলের চাকরিও চলে যায় তার। কারাগারে নির্যাতিত হয়েছিলেন বলে স্বামী তাকে তালাক দেয়। বাকি জীবন অনেক কষ্টে একাই কাটিয়ে দিয়েছেন। এই বিষয়গুলো ইতিহাসে তেমন খুঁজে পাওয়া যায় না।

অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘মমতাজ বেগমের মতো ভাষাসংগ্রামের উজ্জ্বল নক্ষত্র পরবর্তী সময়ে হারিয়ে গেছেন। বিদ্রোহী এই নারীকে নিয়ে আর তেমন আলোচনা হতে দেখা গেল না। পারিবারিক ও ব্যক্তিজীবনে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলেন। স্বামীও তাকে ত্যাগ করে।’

ভাষাসংগ্রামী নারীদের কীভাবে স্মরণ রাখা দরকার?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. সোনিয়া নিশাত আমিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদানের কথা কখনো কখনো উঠে এলেও নারীদের ক্ষেত্রে বলা হয়— নারীরা নির্যাতিত হয়েছে, পুরুষ সৈনিকদের অস্ত্র বহন করেছে, তাদের খাবার দিয়েছে— এমন সব কাজের কথা। এতটুকু জায়গাতেই নারীর অবদান কিন্তু সীমাবদ্ধ নয়। ওই সময় দেশের প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ছেলেরা যত ধরনের সমস্যায় থাকত, মেয়েরাও সেভাবেই থাকত। ২৪ ঘণ্টা ছেলেদের যেমন জীবনের ভয়ে থাকত, একজন নারীরও সেই ভয়-ই থাকত।’

তিনি আরও বলেন, ‘তাই আমি মনে করি, নারীদের অবদানের স্বীকৃতি দিতে হবে। গণ্যমাধ্যম, পাঠ্যপুস্তক ও গবেষণায় বিষয়গুলো তুলে ধরতে হবে। তবে কেবল ‘নারী’ বলেই এই স্বীকৃতি নয়, নারীর যা প্রাপ্য তাকে তাই দিতে হবে।’

ভাষা আন্দোলন ভাষা আন্দোলনে নারী ভাষাসংগ্রামী

বিজ্ঞাপন

খেজুর আমদানিতে শুল্ক কমলো
২২ নভেম্বর ২০২৪ ২১:০৮

আরো

সম্পর্কিত খবর