Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

শখের সাজগোজ থেকে পেশাদার রূপসজ্জা শিল্পী সুমাইয়া খাদিজা


৩ মার্চ ২০২০ ১৩:৪৯

ঢাকা: গোটা বিশ্বে সাজগোজের ধারায় এখন চলছে ‘ন্যাচারাল লুক’ এর প্রাধান্য। এই ন্যাচারাল লুক মানে কিন্তু মেকআপ বিহীন চেহারা নয়। বরং সব ধরনের মেকআপ সামগ্রী ব্যবহার করেও কিভাবে চেহারাটাকে স্বাভাবিক রাখা যায় সেই বিশেষ কৌশল।

পার্টি মেকআপের ক্ষেত্রে তো বটেই এমনকি বিয়ের সাজের জন্যও কনেরা চাইছেন এমনভাবে সাজতে যেন সেটা খুব চড়া না হয়। ফলে সাজগোজের কৌশলে এসেছে অসংখ্য পরিবর্তন।

কিছুদিন আগেও বাংলাদেশে সাজগোজের ক্ষেত্রে বেস মেকাপের জন্য পুরু লেয়ারের কেইকি ধারা খুব জনপ্রিয় ছিল। এখন কিন্তু সেসব আর দেখা যায় না। ফলে মানুষের রুচির সঙ্গে তালমিলিয়ে কৌশল বদলাতে হয় পেশাদার রূপসজ্জা শিল্পীদের। সেইসঙ্গে করতে হয় নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা, রপ্ত করতে হয় সাজের নতুন নতুন কলাকৌশল। সবচেয়ে বড় কথা নিজেকে সময়োপযোগী রাখতে হয়।

সুমাইয়া খাদিজার কথা রূপসজ্জা

ঢাকাসহ সারাদেশে বেশ কয়েকজন রূপসজ্জা শিল্পী আছেন যারা ফ্রিল্যান্সার হিসেবে চুটিয়ে কাজ করছেন। রীতিমতো পাল্লা দিচ্ছেন বিখ্যাত বিউটি স্যালনগুলোর সঙ্গে।

তেমনই একজন সুমাইয়া খাদিজা। বিশেষ করে ন্যাচারাল লুক মেকআপের জন্য এই জগতে আলাদা জায়গা করে নিয়েছেন তিনি। সেইসঙ্গে বিভিন্ন রকমের পরীক্ষা-নিরীক্ষায় তার সুনাম রয়েছে। শুরুতে নিজেই শিখেছেন, কখনো নিজের চেহারার ওপর কখনো বন্ধু-বোনদের চেহারার ওপর পরীক্ষা চালিয়ে রপ্ত করেছেন কৌশল। ইউটিউবের ভিডিও দেখে শিখেছেন নিত্য নতুন সব কৌশল, জেনেছেন বিখ্যাত সব মেকআপ ব্র্যান্ড সম্পর্কে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রশিক্ষকদের কর্মশালায় যোগ দিয়েছেন নিজের কৌশলগুলোকে ঝালিয়ে নিতে।

আর এখন তো নিজেই মেকআপের সংক্ষিপ্ত কোর্স পরিচালনা করেন। সেইসঙ্গে পার্টি মেকআপ আর ব্রাইডাল মেকআপ তো আছেই।

বিজ্ঞাপন

সুমাইয়া খাদিজার সাজানো কনে

সুমাইয়ার সঙ্গে কথা হয় সারাবাংলার। জানতে চাই, কেন এই পেশায় আগ্রহী হলেন?

জবাবে এই শিল্পী বলেন, ‘মেকআপের প্রতি আগ্রহ কবে থেকে নিজেও ঠিক জানিনা। ওভাবে ভেবে দেখিনি কখনও। বিভিন্ন ধারার শৈল্পিক কাজ ও ক্রাফটসের প্রতি ছোটবেলা থেকেই আগ্রহ ছিল। কিশোর বয়সে বিভিন্ন ফ্যাশন ম্যাগাজিনের পাতায় গৃহসজ্জা, রান্না-বান্না ইত্যাদি যেমন দেখতাম তেমনি বিভিন্ন মানুষের রুচিসম্মত পোশাক, এক্সেসরিজ বা মুখ ও চুলের সাজগুলোও খেয়াল করতে ভাল লাগত। শুধু পত্রিকার পাতাতেই নয় বরং আশেপাশেও নান্দনিক শিল্পসম্মত কিছু দেখলেও চোখ আটকে যেত। জানতে ইচ্ছা করত কিভাবে এসব করা হয়। সে বয়সটা ঠিক নিজে সাজার জন্য জানতে চাইতাম তা না, বরং বলতে পারেন বিভিন্ন ধারার শিল্পের বিষয়ে অনুসন্ধিৎসা থাকায় জানতে চাওয়া ছিল আর কি।

তবে ছোটবেলায় সাজগোজের ওপর বাড়ির কড়া বিধিনিষেধ ছিল বলে জানালেন সুমাইয়া। মা-বাবা সাজগোজ করা পছন্দ করতেন না। তাকে শেখানো হয়েছিল যে সাজগোজ করা জরুরি না বরং পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি বিভিন্ন ধারার বই পড়া জরুরি। এজন্য সেদিকে উৎসাহ দিতেন তারা।

সুমাইয়া খাদিজার সাজানো কনে

সেই ধারা এখনো অব্যাহত আছে জানিয়ে সুমাইয়া বলেন, ব্যক্তি জীবনে তেমন মেকআপ করেন না তিনি। তবে অন্যকে সাজিয়ে ভীষণ আনন্দ পান। বলেন, ‘ব্যাপারটা খুব বিপরীতমুখী শোনায় হয়ত। আসলে শিল্পচর্চার মাঝে আনন্দ পাই বলেই মেকআপ করতে মজা পাই।’

ছোটবেলা থেকেই বিদেশি ফ্যাশন ম্যাগাজিন বা পত্রিকার লাইফস্টাইল পাতা থেকে বিভিন্ন মেকআপ উপকরণের নাম পড়ে বুঝতে চেষ্টা করতেন সুমাইয়া। ফাউন্ডেশন, কনসিলার, প্রেসড পাউডার, মাশকারা, আই লাইনার এগুলো কি তা ছবি দেখে আর পড়ে বোঝার চেষ্টা করতেন। কখনো ভাবেননি যে, একসময় এগুলোই হবে তার নিত্যদিনের কাজের সঙ্গী।

বিজ্ঞাপন

সুমাইয়া বলেন, ‘মেকআপ করানোকে পেশা হিসেবে নেব সেটা কয়েকবছর আগেও ভাবিনি। কারণ এটাই আমার সবচেয়ে বড় প্যাশন ছিল তা নয়। বলতে পারেন আমি গাইতে গাইতে গায়েন হয়েছি। কিভাবে যেন সব স্বয়ংক্রিয়ভাবে হতে থাকল। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় বা তার পরেও বিভিন্ন উপলক্ষে নিজে নিজেই সাজতাম, খুব বেশি উপকরণ দিয়ে সাজতাম তাও নয়। অল্প স্বল্প কাজ চালানোর উপযোগী কিছু উপাদান উপহার পেয়েছিলাম বিদেশ ফেরত আত্মীয়-বন্ধুদের কাছ থেকে। কিছু নিজে কিনেছিলাম। আর তা দিয়েই নিজের সাজগোজের কাজটা চলে যেত। তবে বরাবরই খেয়াল করতাম আমি ওই আনাড়ি দক্ষতা ও সীমিত জ্ঞান নিয়েও যা সাজতাম আশপাশের মানুষ খুব প্রসংশা করত। অনেকেই বলত আমাকে একটু সাজিয়ে দাও। এভাবে টুকিটাকি সাজতাম ও সাজাতাম। তবে রূপসজ্জা শিল্পী হওয়ার জন্য যে চর্চা সেটা তখনো করতাম না।’

সাজাচ্ছেন সুমাইয়া খাদিজা, ডানে নিজের রূপসজ্জা নিজেই করেছেন

কখন ভাবলেন যে পেশাদার রূপসজ্জা শিল্পী হবেন?

জবাবটা সুমাইয়া দিলেন গুছিয়ে। বললেন, ‘রূপসজ্জা শিল্পী হওয়ার পেছনে নিজের বিয়ের সাজ মনমতো না হওয়াটা একটা ভূমিকা রেখেছিল। যখন বিয়ে করলাম তখন আমি মোটামুটি কাজ চালানোর মত সাজতে পারলেও বিয়ের মেকআপ করার মত কনফিডেন্স রাখতাম না। ফলস্বরূপ পেশাদার রুপসজ্জা শিল্পীর সাহায্য নিয়েছিলাম। সত্যি বলতে নিজেকে ওই সাজে আয়নায় দেখে বড় অচেনা ও পুরু মুখোশ পরা একজন মানুষ মনে হচ্ছিল। দুঃখে চোখে পানি এসে যাওয়ার অবস্থা। আমি নিজেই তো নিজেকে চিনছি না, অন্যরা কিভাবে চিনবে? আমার রুচিবোধের পুরো উল্টো ছিল সেই মেকআপ। তখন মনে মনে ভেবেছিলাম, নিজেই শিখে নেব, যেন কখনো আর কারও মুখাপেক্ষী হতে না হয়।’

এরপর থেকে টুকটাক করে বিভিন্ন উপকরণ কিনে চর্চা শুরু করেন সুমাইয়া খাদিজা। ইন্টারনেট সহজলভ্য থাকায় তথ্য পাওয়াও সহজ ছিল। বিভিন্ন বিদেশি শিল্পীদের ভিডিও টিউটোরিয়াল দেখে শিখেছেন খুঁটিনাটি। তার এই শেখাগুলো যখন কাজে লাগাচ্ছিলেন তখন আশপাশের মানুষের প্রশংসা পাচ্ছিলেন। অনেকেই তার কাছে সাজতে আগ্রহ প্রকাশ করছিলেন। কেউ কেউ তো তার কাছে মেকআপ শিখতেও আগ্রহ দেখাচ্ছিলেন।

সুমাইয়া বলেন, ‘একসময় কবে যেন নিজের অজান্তেই পেশাগতভাবে সাজাতে শুরু করলাম। নিজেকে আরও যোগ্য করে গড়ে তুলতে তাই নিজে নিজে হাতে কলমে চর্চা ও নিরীক্ষার পাশাপাশি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মেকআপ ও সৌন্দর্য বিশেষজ্ঞদের কর্মশালাতেও অংশ নিতাম। এর মাধ্যমে ঝালিয়ে নিতাম নিজের জ্ঞান ও দক্ষতাকে।’

পেশাগত রূপসজ্জা শিল্পী হিসেবে সুমাইয়ার পথচলা ২০১৭ সাল থেকে। এরমধ্যেই এই পেশায় শক্ত অবস্থানে চলে গেছেন তিনি। গ্রাহকের পছন্দ আর নিজের রুচি মিলিয়ে সাজান, তবে একদিনে দুটোর বেশি কাজ সাধারণত হাতে রাখেন না এই শিল্পী। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, যেহেতু মন দিয়ে সাজানোর কাজটি করেন তাই একদিনে বেশি মানুষকে সাজালে মনমতো কাজ করা যায় না। তাছাড়া সুমাইয়া শুধু যে বিয়ের কনেদের সাজান তাই নয়, বরং বিয়ের আগে কোন রুটিনে চললে কনের চেহারায় উজ্জলতা বাড়বে, ক্লান্ত দেখাবে না, কেমন খাবার খেলে ত্বক সুস্থ থাকবে এসবও আলাপ করে নেন। কোনো কনে চাইলে তার পোশাক ও গহনার নকশার বিষয়েও পরামর্শ দেন।

মূলত পশ্চিমা মেকআপ আর্টিস্টদের কাজ থেকে অনুপ্রেরণা নেন সুমাইয়া। তাদের কাছ থেকেই শেখেন খুঁটিনাটি। ফলে তার ব্যবহৃত মেকাপের উপকরণগুলোও হয় বিখ্যাত ব্র্যান্ডের। কাজের বেলায় খুঁতখুঁতে সুমাইয়া মেকআপ পণ্যের দামের চেয়ে মানের ওপর বেশি গুরুত্ব দেন। তিনি বলেন, ‘আমি যে শুধু কাজের জন্য বিখ্যাত ব্র্যান্ডের পণ্য সংগ্রহ করি তা নয় বরং নিত্য নতুন মেকআপ পণ্য নিয়ে ধারণা পেতে ও গবেষণা করতেও আমি বিভিন্ন পণ্য সংগ্রহ করে থাকি। মেকআপ বিশ্ব প্রতিনিয়ত আপডেট হচ্ছে আর তাই আমাদেরকেও সে সঙ্গে নিজেদের জ্ঞান বাড়িয়ে নিতে হয় চর্চার মাধ্যমে, গবেষণার মাধ্যমে আর অবশ্যই পড়ার মাধ্যমে। আমি সবসময়ই বলি যে, কোনো কাজেই হাতে কলমে করার পাশাপাশি পড়ার বিকল্প নেই।’

সুমাইয়া খাদিজার সাজানো বিয়ের কনে

সুমাইয়া মূলত একজন ‘ব্রাইডাল মেকাপ আর্টিস্ট’, তাই তাকে দেশীয় বিয়ের কনেদেরকেই সাজাতে হয়। অন্যদিকে তার মেকআপের অনুপ্রেরণা বিভিন্ন বিদেশি রূপসজ্জা শিল্পীরা। তাই সাজানোর সময় ফিউশন করেন বলে জানালেন। তিনি বলেন, ‘আজকাল বাংলাদেশের শহুরে কনেরাও এইটাই বেশি চাইছেন। একেবারে পুরু মেকআপের লেয়ারের মুখোশ পরা ধারার সাজ আজকালকার আধুনিক ও রুচিশীল মেয়েদের পছন্দ না। কারণ, এখন মেয়েরা তাদের নিজেদের চেহারা ও গায়ের রঙ নিয়ে ভীষণ আত্মবিশ্বাসী। তারা চেহারার স্বকীয়তা বজায় রেখে মেকআপ করতে বেশি পছন্দ করেন। সেকারণে ন্যাচারাল লুক বেশি প্রাধান্য পায়।’

এমনকি ড্রামাটিক মেকআপ দিলেও মূল চেহারা যেন হারিয়ে না যায় সেদিকে সতর্ক থাকেন সুমাইয়া। ব্যক্তির চাহিদা, প্রোগ্রামের পরিবেশ, তার ব্যাক্তিত্ব, চেহারার গড়ন, পোশাক, গয়না সব বুঝে মানুষ ভেদে বিভিন্ন সাজ দেন তিনি।

কারা মূলত তার কাছে সাজতে আসেন, জানতে চাই সুমাইয়ার কাছে। তিনি বলেন, ‘আমার ক্লায়েন্ট মূলত তারাই যারা আমাকে নিজ তাগিদে খুঁজে নিয়েছেন। সত্যি বলতে আমি কিছুটা প্রচারবিমুখ। সেভাবে বড় আকারে কাজের বিজ্ঞাপন দেওয়া কখনো হয়ে ওঠেনি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমার কাজ দেখে বেশিরভাগ মানুষ আসেন। সেই তিন গোয়েন্দার ভুত থেকে ভুতে পদ্ধতি বলতে পারেন। আসলে মানুষের মুখে মুখেই আমার কাজের পরিচিতি বেড়েছে। যারা আমার কাছে মেকআপ করেছেন বা শিখেছেন তারা আমার প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন।’

সুমাইয়া খাদিজা

সুমাইয়ার ফেসবুক পেইজের নাম সাজকথা। এই পেইজের মাধ্যমেই গ্রাহকরা অ্যাপয়েনমেন্ট নেন। সেখানেই কে কেমন সাজতে চান সেসব আনুষাঙ্গিক বিষয়ে কথা হয় সুমাইয়ার।

এছাড়া সাজকথা নামে একটি ফেসবুক ক্লোজড গ্রুপে বিভিন্ন রকম সৌন্দর্য পরামর্শ, মেকআপ সামগ্রীর রিভিউও দেন সুমাইয়া। গ্রুপের সদস্যদের সাজগোজের ছবি দেখে মন্তব্য করেন, আরেকটু ভালো কীভাবে করা যেত সে পরামর্শও দেন তিনি।

কতদিন এ শিল্পচর্চার মাঝে থাকবেন তা এখনও নিশ্চিত নন সুমাইয়া। তবে এ পর্যন্ত আসার পেছনে তার গ্রাহক ও অনুরাগীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানালেন। বলেন, ‘যতদিন এ পেশায় আছি যেন সুনাম অক্ষুণ্ন রাখতে পারি সেটাই আমার চেষ্টা।’

ব্রাইডাল মেকআপ মেকআপ সাজকথা সুমাইয়া খাদিজা

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর