টেলিভিশনের কথা
২৯ মে ২০২০ ২০:৫৬
১৮৮৪ সালে জার্মান টেকনিশিইয়ান পল নিপকভ ছবির মাত্রা বিভাজন বা ক্যাথোড রে টিউবের (CRT) প্রাথমিক ধারণা প্যাটেন্ট করেন। এরপর অনেকেই ছবিকে দূরে পাঠানোর চেষ্টা করেছেন। তবে সফল হয়েছেন স্কটিশ প্রকৌশলী জন লগি বেয়ার্ড ১৯২৫ সালে, বিলাতে। ১৯২৯ সালে ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন (BBC) সর্বপ্রথম পরীক্ষামূলক টিভির সম্প্রচার করে। জার্মানির বার্লিনে ১৯৩৫ সালে প্রথম টিভি স্টেশনের নাম ‘পল নিপকভের’ নামে রাখা হয়। ১৯৩৬ সালের বার্লিন অলিম্পিক ছিলো পৃথিবীর প্রথম কোন বড় ইভেন্ট যা টিভিতে দেখানো হয়েছিলো।
CRT টিভি ছিলো ঢাউস আকৃতির। কারণ এর ভেতরে ছিলো ইলেকট্রন গান, ফসপোরেন্ট পর্দা ও নানা ধরণের কলকব্জা। তাই গবেষকরা প্রানান্ত চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন এই মেদবহুল টিভিকে স্লিম বানানোর উপায় খুঁজতে। কারণ, সিআরটি টিভি জায়গা নেয় প্রচুর, ওজনে ভারি (ফলে পোর্টেবিলিটি কঠিন) এবং চালাতে প্রচুর বিদ্যুৎ খরচ হয়। তাই এর বিকল্প টেকনোলজির গবেষণা চলছিলো প্রায় ১০০ বছর ধরে।
অবশেষে দীর্ঘদিনের সাধনার পর জাপানিজ Hattori & Seiko R&D Group সর্বপ্রথম LCD TV বাজারজাত করে ১৯৮২ সালে। এই কোম্পানি কিন্তু আপনার আমার হাতের যে সিকো ঘড়ি আছে সেটাই। মজার বিষয় হলো প্রথম LCD TV কিন্তু Seiko Watch এর ভেতরেই তৈরি করে! LCD টেকনোলজি হলো Liquid Crystal Display এর সংক্ষিপ্ত রূপ। এ প্রযুক্তিতে ছবি ভেসে ওঠে বৈদ্যুতিক ক্ষেত্রের প্রভাবে ক্রিস্টাল মলিকুলগুলোর অরিয়েন্টেশনকে কাজে লাগিয়ে। CRT দিয়ে ছবি আঁকা হতো ইলেকট্রন দিয়ে, LCD তে ইলেকট্রন গানের আর দরকার রইলোনা। ফলে টিভি হয়ে গেলো পাতলা। লেগে গেলো দেয়ালে। শুধু তাই নয় এই প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে ছোট বড় সব যন্ত্রে ডিসপ্লে যুক্ত হতে লাগলো যেমন ক্যালকুলেটর, হাতঘড়ি, ইলেকট্রনিক বিলবোর্ড, মুঠোফোন ইত্যাদি।
আমাদের দেশে LCD টিভি সহজলভ্য হয়ে উঠেছে গত ১০ বছরে। এমনকি ২০০৭ সাল পর্যন্তও সারা দুনিয়ায় CRT টিভির মার্কেট শেয়ার বেশি ছিলো। এর মুল কারণ হলো দাম বেশি থাকা। পরে বিপুল উৎপাদনের কারণে LCD টিভি সহজলভ্য হয়ে উঠছে।
LCDর প্রতিদ্বন্ধী আরেকটি টেক ছিলো PDP (Plasma Display Panel)। শুরুতে PDP ও LCDর মধ্যে ভালোই প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছিলো। কিন্তু পরে পিডিপি আর LCDর সঙ্গে পেরে ওঠেনি। এর কারণ, PDP তে প্রচুর বার্ন আউট সমস্যা তৈরি হয়।
এক একটি প্রযুক্তির উপাদান গবেষণা করে মার্কেটে নিয়ে আসতে শত বছরেরও বেশি সময় লাগতে পারে। অন্তত LCD এর ক্ষেত্রে তাই হয়েছে।
ডিসপ্লেতে এর পরের সবচেয়ে বড় বেকথ্রু ছিলো OLEDর আবিষ্কার ও প্রয়োগ। Eastman Kodak কোম্পানির তাইওয়ানিজ প্রফেসর তাং এবং স্টিভ ভ্যান স্লেক ১৯৮৭ সালে কার্যকর OLED ডিভাইস আবিষ্কার করে তাক লাগিয়ে দেন। আজকে আমাদের সবার হাতে হাতে যে স্মার্টফোন তার প্রায় সবই এই OLED ডিসপ্লে। Organic Light Emitting Diode ডিসপ্লেতে LCD এর পরিবর্তে OLED ডায়োড ব্যবহার করা হয়। এটি অর্গানিক বা জৈব ম্যাটেরেয়াল বলে হাই কোয়ালিটির কালার সেন্স হয়। ব্যবহারকারি সত্যিকারের হাই রেজুলেশন রং অনুভব করে। আর এর বৈদ্যুতিক খরচ ও অনেক কম। ২০০৭ সালে জাপানিজ সনি কোম্পানি সর্বপ্রথম OLED টিভি বাজারে নিয়ে আসে। এখন LG বা SAMSUNG অনেক ভালো কোয়ালিটির OLED টিভি বাজারজাত করছে। তবে এগুলো এখনো অনেক ব্যয়বহুল। বাংলাদেশের বাজারে সহজলভ্য হতে আরও অনেক সময় লাগবে।
নতুন আরেকটি প্রযুক্তি হল QLED টিভি বা Quantum dot LED. কোয়ান্টাম ডট হলো অতি ক্ষুদ্র কণার তৈরি ম্যাটেরিয়াল। এ কণাগুলো প্রতিটি ১০ ন্যানোমিটারের মতোও হতে পারে।
বর্তমানে ডিসপ্লে প্রযুক্তি শুধু পাতলা বা দৃঢ় ভিত্তির কাঁচের উপর নয় বরং নমনীয় ফ্লেক্সিবল বেসমেন্টের উপাদানেও তৈরি হচ্ছে। হুয়াওয়ের Mate X বা স্যামসাং এর Galaxy Fold এমন বাঁকানো বা ভাঁজ করা পর্দার ফোন। আর গত বছর থেকেই এগুলো বাজারে পাওয়া যাচ্ছে। সেদিন বেশি দূরে নয় যখন বড় পর্দার টিভি পরতে পরতে ভাঁজ করে পকেটে পুরে এক জায়গায় থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়া যাবে। ডিসপ্লে প্রযুক্তির গবেষণা কিন্তু ওদিকেই যাচ্ছে!
লেখক: পিএইচডি গবেষক, এডভান্সড ডিসপ্লে রিসার্চ সেন্টার, কিয়ংহি বিশ্ববিদ্যালয়, সিউল, কোরিয়া এবং সহকারী অধ্যাপক (শিক্ষা ছুটি) ইনফরমেশন এন্ড কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।