ভারতবর্ষে প্রথম ডেন্টাল কলেজ খুলেছিলেন ঢাকার ডা. রফিউদ্দিন
১০ জুন ২০২০ ১৬:৩৪
টুথপেস্টের বিজ্ঞাপনে প্রায় শোনা যায় ইন্ডিয়ান ডেন্টাল এসোসিয়েশন কর্তৃক রিকোমন্ডেড। এই এসোসিয়েশনটা করল কে? কে প্রথম ভারতের দাঁতের চিকিৎসা শেখানোর জন্য কলেজ খুলল? রবীন্দ্রনাথেরও নিশ্চয়ই দাঁতের ব্যথা হত। উনি কোন ডাক্তারের কাছে যেতেন?
এইসব প্রশ্নের একটাই উত্তর— ডা. রফিউদ্দিন আহমেদ। যাকে ভারতবর্ষে দন্তচিকিৎসার জনক বলা হয়। তিনি ১৯২০ সালে কলকাতার মৌলালিতে নিজের বাড়িতেই সম্পূর্ণ ব্যক্তি উদ্যোগে উপমহাদেশের প্রথম ডেন্টাল কলেজ খুলেন। তিনিই ভারতীয়দের মধ্যে প্রথম ডেন্টিস্ট। তাঁর হাতেই ভারতে দাঁতের চিকিৎসা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়। আজ ভারতের অন্যতম সেরা ডেন্টাল কলেজ কলকাতার ড. আর আহমেদ ডেন্টাল কলেজ ও হাসপাতাল তাঁর বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত সেই কলেজটির বর্তমান রূপ।
এই র্কীতিমান মানুষটি জন্মেছিলেন ঢাকার নবাবগঞ্জ থানার বর্ধনপাড়া গ্রামে ১৮৯০ সালে। নবাবগঞ্জে স্কুল জীবন শেষ করে আইএসসি পাস করেন উত্তরপ্রদেশের আলিগড় মোহামেডান অ্যাংলো-ওরিয়েন্টাল কলেজ থেকে। এর পর তার বাবা মারা যান। চরম আর্থিক সংকটে জাহাজ কোম্পানিতে চাকরি নেন। জাহাজে জাহাজে ভেসে একসময় পাড়ি জমান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানে গিয়ে ভর্তি হন আইওয়া ডেন্টাল কলেজে। তাঁর অসাধারণ প্রতিভার পরিচয় পান সেখানকার অধ্যাপকরা। তখনই তাঁর মনে সুপ্ত বাসনা ছিল দেশে এসে ডেন্টাল কলেজ খুলবেন। ১৯১৫ সালে স্মাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ভালো ফলাফলের কারণে সহজেই চাকরি মিলে যায়। বছরতিনেক ফোরসিথ ডেন্টাল ইনফারমারী ফর চিলড্রেন ইন বোস্টন, ম্যাসাচুসেটসে চাকরিও করেন। বেশ অর্থ যশ হয় তাঁর।
কিন্তু দেশের জন্য ছটফট করছিল মন। মাথায় বিরাট স্বপ্ন। দেশে ফিরে মৌলালিতে নিজের বাড়িতেই খুলেন ভারতের প্রথম ডেন্টাল কলেজ। কোন সরকারি সাহায্য ছাড়াই নিউইয়র্কের সোডা ফাউন্ডেশনের সহায়তা নিয়ে তিনি কলেজটি স্থাপন করেন। পরবর্তীতে সরকার কলেজটির দায়িত্ব নিলে নিজের ভিটের জায়গা সরকারকে দান করেন এ মহৎপ্রাণ চিকিৎসক।
তিনি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দাঁতের চিকিৎসা করেছিলেন। কবিগুরু ডাক্তার সাহেবকে চিঠি লিখে তাঁর লাগানো নকল দাঁতের পাটি ভালোভাবেই কাজ করছে বলে জানিয়েছিলেন।
তিনি শুধু কলেজ স্থাপন করেই ক্ষান্ত হন নি, কলেজটি কিভাবে ভবিষ্যতে টিকে থাকবে তা নিয়েও তার চিন্তার অন্ত ছিল না। শিক্ষার্থীরা যাতে সহজেই পাঠ্যপুস্তক পায় সেদিক বিবেচনা করেন ১৯২৮ সালে প্রকাশ করেন ‘হ্যান্ডবুক অব অপারেটিভ ডেন্টিস্ট্রি, যা আজও দন্তচিকিৎসার বাইবেল হিসেবে মনে করা হয়। ডেল্টাল কলেজের আয় বৃদ্ধির জন্য তিনি একটি আইসক্রিমের পার্লার খুলেন কলেজ ক্যাম্পাসে।
এ কলেজের প্রথম ব্যাচের ছাত্রী ছিলেন পাকিস্তানের জনক মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ’র ছোটবোন ফাতেমা জিন্নাহ। ডাঃ রফিউদ্দিন আহমেদ কেবল একজন চিকিৎসকই ছিলেন না, ছিলেন একজন সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী ও সমাজসেবক। ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দ হতে চার বৎসর তিনি কলকাতা কর্পোরেশনের নির্বাচিত সদস্য ও ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দ হতে দু-বৎসর অল্ডারম্যান ছিলেন। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে দেশভাগের পর তিনি কংগ্রেসের সক্রিয় রাজনীতিতে যোগদান করেন। বিধানচন্দ্র রায়ের আহ্বানে তাঁর মন্ত্রিসভায় পশ্চিমবঙ্গের কৃষি, ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী ছিলেন। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে এবং ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে দেগঙ্গা থেকে বিধানসভায় নির্বাচিত হয়ে
মন্ত্রিসভায় যোগ দেন। ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে তিনি সরকারের পূর্ণমন্ত্রী পদে ছিলেন । ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত ‘হিন্দু-মুসলমান ঐক্য’ সংস্থার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তিনি ।
দাঁতের চিকিৎসকদের পেশাগত সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির জন্য আজীবন তিনি কাজ করে গেছেন। ১৯২৫ সালে তিনি বেঙ্গল ডেন্টাল এসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠা করেন। ৩ বছর পর তাঁর উদ্যোগে ইন্ডিয়ান ডেন্টাল অ্যাসোসিয়েশনের গঠিত হয়। ১৯৪৫ থেকে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত তিনি এ প্রতিষ্ঠানের সভাপতি ছিলেন। ১৯২৫ সালে তাঁর সম্পাদনায় ইন্ডিয়ান ডেন্টাল জার্নাল প্রকাশিত হয়। ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত তিনি এর সম্পাদক ছিলেন। তিনি ডাঃ রফিউদ্দিন আহমেদকে ভারত সরকার ১৯৬৪ সালে ‘পদ্মভূষণ’ উপাধি প্রদান করে।
১৯৬৫ সালের ৯ ই ফেব্রুয়ারি ডা. আর আহমদ কলকাতায় পরলোকগমন করেন। তাঁর মৃত্যুর পর কলকাতা ডেন্টাল কলেজ ও হাসপাতালের নাম পরিবর্তন করে ডা. আর আহমদ ডেন্টাল কলেজ ও হাসপাতাল রাখা হয়।
সূত্র: literacyparadise.com, banglapedia.org, ida.org.in
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, ঢাকা