Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

নারীবাদ প্রয়োজন নাকি বিলাসিতা: বৈষম্যের বিরুদ্ধে কথা বলে নারীবাদ


১০ জুলাই ২০২০ ১৭:১৩

আঠারশ শতাব্দীতে নান্দি নামে সাউথ আফ্রিকান একজন অত্যন্ত সাহসী জুলু নারী ছিলেন যিনি আজীবন ক্রীতদাস ব্যবসায়ী ও দস্যুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন। অথচ, ইতিহাসের খুব কম অংশেই তাকে একজন যোদ্ধা হিসেবে পরিচিত করানো হয়েছে। তিনি পরিচিত কিং শাকা জুলুর মা হিসেবে, যেখানে তিনি নিজেই একজন সাহসী যোদ্ধা ছিলেন।

বিজ্ঞানে একটি টার্ম আছে ‘মাটিলডা ইফেক্ট’ নামে। যার সহজ-সরল বাংলা ভাবানুবাদ করলে দাঁড়ায়, কোনো নারী বিজ্ঞানীর করা আবিষ্কার কিংবা গবেষণার ক্রেডিট তার পুরুষ সহকর্মী পাচ্ছে, কিংবা ঐ নারী বিজ্ঞানীর অবদানকে অ্যাকনলেজ বা পরিচিত করানো হচ্ছে না। এই প্রসঙ্গে পড়তে গিয়ে আমি অত্যন্ত চমকপ্রদ কিছু নতুন জিনিস জানতে পেরেছি, আগে যা আমার একটুও জানা ছিলো না।

বিজ্ঞাপন

ডিএনএর ডাবল হেলিক্স গঠন আবিষ্কারক হিসেবে ওয়াটসন-ক্রিকের নাম আমরা অনেকেই জানি। সঙ্গে এটিও জানি যে, এই আবিষ্কারের জন্যে তারা নোবেল পুরষ্কার পেয়েছিলেন। কিন্তু আমরা অধিকাংশ মানুষই এটি জানিনা যে ডিএনএর এই ডাবল হেলিক্স গঠন সম্পর্কে প্রথম ধারণা ও গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার করেছিলেন রোজালিন্ড ফ্র্যাঙ্কলিন নামক একজন নারী। তার এক সহকর্মী তার উদ্ভূত ডাবল হেলিক্সের ইমেজটি ওয়াটসন-ক্রিকের কাছে দেন ও তারপরেই তারা এই যুগান্তকারী আবিষ্কারের পথে হাঁটতে পারেন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে অ্যাটমিক বোমার নিউক্লিয়ার ফিউশন কতটা ভয়ানক হতে পারে, লিজ মিটনার ও তার সহকর্মী অটো হ্যান যৌথভাবে গবেষণা করলেও, নারী বিজ্ঞানী লিজের অবদান উল্লেখ করতে তার সহকর্মী হ্যান সম্পূর্ণভাবে ‘ভুলে যান’। যার কারণে ১৯৪৪ সালে রয়্যাল সুইডিশ অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সেসের কেমিস্ট্রির পুরষ্কারপ্রাপ্তদের মধ্যে লিজ মিটনারের নাম ছিলো না।

বিজ্ঞাপন

‘Big Eyes’ পেইন্টিং নামে পরিচিত যেই চিত্রকর্ম শিল্পবোদ্ধাদের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয়, তার মূল হোতা মার্গারেট কীন নামে এক নারী শিল্পী। অথচ প্রায় ২০ বছর ধরে মার্গারেটের কাজের সম্পূর্ণ ক্রেডিট নিজের বলে চালিয়ে আসছিলো তার জীবনসঙ্গী ওয়াল্টার কীন। পৃথিবী এই চমৎকার শিল্পকর্মের স্রষ্টা হিসেবে ওয়াল্টার কীনকেই চিনতো।

২০১৬ সালের রিও অলিম্পিকে ট্র্যাপ শুটিং এ Corey Cogdell-Unrein নামের একজন নারী ব্রোঞ্জ পদক পান। অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও, শিকাগো ট্রিবিউন পত্রিকাটি তার এই অর্জন নিয়ে টুইট করে ঠিক এইভাবে- “Wife of a Bears’ lineman wins a bronze medal today in Rio Olympics”, অর্থাৎ কোরির এই অসামান্য অর্জন নিয়ে করা একটি খবরে তার নামই উল্লেখ করা হয়নি, অলিম্পিক পদক পেয়েও তার মূখ্য পরিচয় তিনি একজন লাইনম্যানের জীবনসঙ্গী। অর্থাৎ একজন অলিম্পিকজয়ী যদি নারী হন, তার এই অর্জন থেকে জরুরী তার জীবনসঙ্গীর পরিচয় । কী দুঃখজনক একটা ব্যাপার, ভাবতে পারেন?

Ada Hegerberg নামের ব্যালন ডি’অর জেতা ফুটবলারকে পুরষ্কার গ্রহণের সময় স্টেজে যাওয়ার পর জিজ্ঞেস করা হয়, তিনি টুয়ার্ক(নিতম্বের একধরনের নাচ) করতে পারেন কিনা। আপনাকে নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না Ada Hegerberg পুরুষ ফুটবলার ছিলেন নাকি নারী ফুটবলার! এনবিসির নিউ ইয়র্ক শাখা নারীদের অলিম্পিক ভলিবল নিয়ে একটি স্লাইডশো নির্মাণ করে, যার টাইটেল ছিলো “Great Bodies, Bikinis, and More.” জি, অলিম্পিকে যাওয়া নারীদের নিয়ে কথা বলার টপিক হলো তাদের শরীর ও বিকিনি।

বিভিন্ন স্পোর্টস আর্টিকেলের নারী ও পুরুষ অ্যাথলেটদের নিয়ে ব্যবহার করা টার্ম নিয়ে ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটির করা একটি প্রেস স্টাডিতে বলা “Notable terms that cropped up as common word associations or combinations for women, but not men, in sport include ‘aged’, ‘older’, ‘pregnant’ and ‘married’ or ‘unmarried. The top word combinations for men in sport, by contrast, are more likely to be adjectives like ‘fastest’, ‘strong’, ‘big’, ‘real’ and ‘great’. অর্থাৎ, একজন নারী অ্যাথলেটের কাজ থেকে তার ব্যক্তিগত জীবন, বায়োলজিক্যাল বিষয় (শরীর সম্বন্ধীয়) ও তার অ্যাপিয়ারেন্স (চেহারা-বেশভুষা-সাজগোজ) বেশি লোভনীয় খবর পৃথিবীর কাছে। আমাদের দেশের নারী তারকাদের ব্যাপারে কার কী মতামত, সেগুলো তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না। দুই একদিন সোশ্যাল মিডিয়ার নিউজ ফিড স্ক্রল করলেই আমরা বুঝতে পারি নিজ নিজ ক্ষেত্রে তাদের অবদানকে কোন চোখে দেখা হয়।

আরও পড়ুন, নারীবাদ প্রয়োজন নাকি বিলাসিতা: আমার দৃষ্টিতে নারীবাদ

বিশ্বের সবচেয়ে সভ্য দেশ হিসেবে বড়াই করা যুক্তরাষ্ট্রও কিন্তু পিছিয়ে নেই নারীর অবদান ছোট করে দেখানোয়। সেদেশে এখন পর্যন্ত কোন নারী রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হননি। এমনকি হিলারী ক্লিনটন যখন প্রথমবারের মত রাষ্ট্রপতি নির্যাবচনে আমেরিকার কোন মেজর-পার্টি নারী নমিনি হন, পরদিন দ্যা ওয়াশিংটন পোস্টসহ আরও কয়েকটি প্রথম সারির সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় কার ছবি ছিলো জানেন? না, হিলারির না, তার জীবনসঙ্গী সাবেক দুইবারের রাষ্ট্রপতি বিল ক্লিনটনের।

এই যে এই উদাহরণগুলো দিলাম, এগুলো সমুদ্র থেকে তুলে নেওয়া এক বালতি পানির সমান। আমরা বেশিরভাগ নারীই জীবনের কোনো না কোনো ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হই, জেনে-না-জেনে, বুঝে-না-বুঝে। নিজেরা শিকার হই, এমনকি নিজেদের অজান্তেই অন্যদেরও বৈষম্যের শিকার করি। এর উদাহরণ আপনি নিজের চারপাশে তাকালেই দেখতে পাবেন। কোন কোন নারীর পরিচয় মিসেস এক্স ওয়াই জেড, অমুকের স্ত্রী, তমুকের মা, অমুকের মেয়ের আড়ালেই হারিয়ে যায়। এমনকি নারী যদি কর্মক্ষেত্রে সফলও হন, তবুও তার নিজের পরিচয় তৈরি হয় না সহজে। অথচ আমরা সবাই জানি, একজন নারীকে আত্মপরিচয় তৈরি করতে একজন পুরুষের তুলনায় অনেকটা বেশি পথ পাড়ি দিতে হয়। অনেকগুলো বেশি বাঁধা অতিক্রম করতে হয়। আর সেসব বাঁধা মূলত সামাজিক চাহিদার বাধা। নারীকে সমাজকে একটি নির্দিষ্ট চেহারা, আচরণ ও উপস্থিতিতে দেখতে চায় আর চায় তাকে দুর্বল উপাধি দিয়ে নিজেদের সেই ছকে গড়তে। যুগে যুগে এমনটাই হয়েছে। নারীবাদ নারীর প্রতি ঘটে চলা এসব বৈষম্য নিয়ে কথা বলে। কথা বলে এসব বৈষম্যের শেকড় উপড়ে ফেলতে। যেন পৃথিবীর প্রতিটি শিশু সমান অধিকার ও চিন্তা-চেতনা নিয়ে বড় হয়। যেন প্রতিটি মানুষ সমান পরিচিতি ও সম্মান পায়।  (চলবে…)

লেখক- তরুণ উদ্যোক্তা (ডিজাইনার ও ফাউন্ডার, ময়নার গয়না)

আনুশা মেহরিন নারীবাদ নারীবাদী

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর