’অধিকার আদায়ের জন্যে বলতে গেলে যুদ্ধ করতে হয়েছে’
৮ মার্চ ২০১৮ ১২:৩৯
[আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে সারাবাংলার আয়োজনে গত ৬ মার্চ ২০১৮ তে অনুষ্ঠিত হয় বিশেষ আড্ডা ‘আমাদের গল্প’। এতে অংশ নেন বিভিন্ন অঙ্গনে খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠা পাওয়া সাতজন সফল নারী। তাঁরা তাদের পরিবারে বেড়ে ওঠা, পেশাগত জীবনে পদার্পণ, নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে নিষ্ঠা-একাগ্রতার সঙ্গে কাজ করা, পারিবারিক ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিতে পেশা কিংবা ব্যক্তি জীবনের মূল্যায়নসহ নানা বিষয় আড্ডায় তুলে ধরেন। প্রায় চার ঘণ্টার ওই আড্ডায় অংশগ্রহণকারীরা একে অন্যের প্রশ্নের উত্তর দেন প্রাণখুলে। আড্ডায় তাঁদের বক্তব্য আজ সারাবাংলার পাতায় প্রকাশ করা হল]
।। রুবী রহমান।।
এই যে ফাল্গুনের সকালে আমরা আড্ডা দিচ্ছি, এই সুযোগ করে দেবার জন্যে সারাবাংলাকে ধন্যবাদ। এই যে নারীরা তাদের সংগ্রামের গল্প সবাইকে বলার সুযোগ পাচ্ছে, এটাকে আমি মনে করি অনেক বড় একটা পদক্ষেপ। এর মাধ্যমে অনেক মূল্যবান কথা বেরিয়ে আসছে। এই সংগ্রামের গল্পগুলো আমাদের সবার জানার দরকার আছে। এই পৃথিবীতে মেয়েদের টিকে থাকাটাই একটা অস্তিত্ব রক্ষার যুদ্ধের মত। সেখানে নারীর কাজের ক্ষেত্র যদি হয় সাহিত্য তাহলে সেটা আরো বেশি কঠিন হয়ে পড়ে।
আমার মনে আছে আমার প্রকাশকদের কেউ কেউ আমাকে বলতেন, “আপা আপনি কবিতা লেখেন কেন? নোটবুক লেখেন। কবিতার বই তো বিক্রি হয়না। নোটবই তো বিক্রি হবে”। এই যে এত নিরুতসাহিতার মাঝেও লেগে থাকাটা এর জন্যে মানসিকভাবে আমাকে অনেক শক্ত হতে হয়েছে। আমি বলছিনা যে এই সংগ্রাম শেষ হয়েছে এবং আমি সফল হয়েছি। আমি এখনো নিজেকে ব্যর্থই মনে করি। এখনো প্রতিটা কবিতা লেখার পরেই আমার মনে হয় এটা কোন কবিতা হয়নি। আমি ফেলে রাখি, তারপর যদি কেউ একটু সমর্থন করে তাহলে সেটিকে নিয়ে একটু সাহস করে এগিয়ে যাই। এটা হল কবি বা শিল্পী হিসেবে আমার সংগ্রাম।
তো এই শিল্পী হবার সংগ্রামের পাশাপাশি একজন নারীকে আবার নারী হবার জন্যে বাড়তি কিছু সংগ্রাম করতে হয়। যেমন, আমার সন্তান তমোহরকে বাঁচিয়ে রাখতে পারিনি সেটাই আমার কাছে ব্যর্থতা মনে হয়। অনেক বড় কবি হতে না পারার ব্যর্থতাটা আমাকে সেভাবে পোড়ায় না।
সিকি শতাব্দী আগেও মেয়েদেরকে পড়াশুনা করার অধিকার আদায়ের জন্যে বলতে গেলে যুদ্ধ করতে হয়েছে। মেয়েদের জন্যে বিয়ে আর সংসার করাটাকেই জীবনের একমাত্র লক্ষ্য বলে ধরা হত। আমাকেও নবম শ্রেণিতে থাকতেই বিয়ে দিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছিলো। তবে আমি চেয়েছি পড়াশুনা শেষ করে বিয়ে করতে। আমাকে যে সমাজের কথা মেনে ওই বয়সেই বিয়ে দিয়ে দেননি সেই জন্যে আমার বাবার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। তার সাহায্যেই আমি লেখাপড়া শেষ করতে পেরেছি। নারীদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়া খুব প্রয়োজন। আমি পড়াশুনা শেষ করতে পেরেছিলাম বলেই অর্থনৈতিক ভাবে স্বাবলম্বী হতে পেরেছি। আর পড়াশুনা করতে পেরেছি বলেই সাহিত্য অঙ্গনেও লেগে থাকতে পেরেছি।
আমার স্বামী রাজনীতিবিদ ছিলেন। তার মাধ্যমে আমি জেনেছি কীভাবে গ্রামের প্রান্তিক মানুষেরা জীবনযাপন করে। তার সাহায্যও আমার আজকে কবি হিসেবে পরিচিতি লাভের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। সাহিত্য নানানভাবে মানুষকে অনুপ্রাণিত করে। আমি সেই অনুপ্রাণিত করার কাজ করতে পারছি বলে নিজেকে ধন্য মনে করি।
আমাদের আগে এই পৃথিবীতে যে নারীরা এসেছেন তাদের নিরবচ্ছিন্ন আর নীরব চেষ্টার মাধ্যমেই আজকের নারীরা এই পর্যায়ে আসতে পেরেছে। আমি নিজে আমার নানী আর মায়ের কথা সবসময় ভাবি। তারা দুইজনই খুব কবিতা ভালোবাসতেন। সেই সাথে আমার মা আর নানীর কাছেও আমি কৃতজ্ঞ। আমার নানী অবিরাম হেমচন্দ্র নবীনচন্দ্রের কবিতা মুখস্থ আবৃত্তি করতেন। আমার মা’ও মাঝে মাঝে কবিতা লিখতেন, কবিতা ভালোবাসতেন। তারাও হয়তো সুযোগ পেলে অনেক কিছু করতে পারতেন। তারা তাদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ব্যয় করেছেন সন্তান পালনে।
তাই আমি সিকি শতাব্দী আগের এসব নারীদের কথা মনে করি কারন তাদের নীরব সমর্থনেই ধীরে ধীরে আমরা এগিয়ে আসতে পেরেছি। নিঃসন্দেহে এখনকার নারীরা অনেক এগিয়েছে। এখনকার মেয়েরা তাদের প্রতি সহিংসতার বিষয়টা প্রকাশ্যে বলতে পারছেন। কিন্তু কিছু কিছু ব্যাপার এখনো আমাকে প্রচন্ড কষ্ট দেয়। আমি যখন সংসদ সদস্য হিসেবে কাজ করেছি তখন দেখেছি একটা নারী বা শিশু ধর্ষিত হবার পরে যে ভয়ানক ট্রমা তা ভাষায় বুঝিয়ে বলা যাবেনা। আবার সেই নারীটি বা শিশুটির প্রতি তার সমাজ আর পরিবার যে দৃষ্টিতে দেখে সেটি আমাকে ভেতরে ভেতরে প্রচন্ড কুঁকড়ে দেয়। নির্যাতিত হিসেবে সমাজ থেকে যে স্নেহ পাবার কথা তা এই ট্রমাটাইজড নারীরা, শিশুরা পায়না। এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে আমাদেরকে আরো অনেক দূর পথ হাঁটতে হবে। তবে এই পথচলা থামানো যাবেনা। আমাদের আজকের চেষ্টাই আগামীদিনের নারীদের জন্যে একটি সুন্দর পথ তৈরি করে দেবে।
নারীদের এইসব নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রামকে কেউ হয়তো উল্লেখযোগ্য মনে করেনা। সমাজে মানুষের মত মাথা তুলে বেঁচে থাকার জন্যে নারীর এই সংগ্রাম আবশ্যক। আর আমরা সবাই এই সংগ্রামের ধারাটা বজায় রাখবো।
https://youtu.be/Yq-YdIsxpRI
যদি পুরুষ নির্মাতা হতাম, পরিচিতি অনেক বেশি হত
মানুষ হতে পেরেছে এমন পুরুষের সংখ্যা খুবই কম
সবাইকে শেখাই কীভাবে নিজের শরীর পরীক্ষা করতে হবে
লজ্জা তো আমার না, লজ্জা তো তোদের, সমাজের
নারী নয়, নিজেকে মানুষ হিসেবে ভাবতে পারাটা খুব জরুরি
মেয়েরা এখন আর দাঁতে দাঁত চেপে নির্যাতন সহ্য করে না
অনুলিখনঃ জান্নাতুল মাওয়া
সারাবাংলা/এসএস