স্বাধীনতা, অধিকার ও নিরাপত্তার ভাগ চাই
২ অক্টোবর ২০২০ ১৯:১৭
“সাত কোটি বাঙালিরে হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করনি”
—কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
নির্লজ্জ জাতি আমরা। ঘৃণা লাগে তখনই, যখন এই স্বাধীন বাংলাদেশের স্বাধীন নাগরিক হয়ে আজও নারীদের হতে হয় ধর্ষিত, হতে হয় ভীতসন্ত্রস্ত সেই সকল হায়েনাদের চোখ দেখে। দাঁড়িয়ে থাকতে হয় এককোণে শুধু সেই ভয়ানক দৃষ্টি থেকে নিজেকে আড়াল করতে। কবি নজরুলের ভাষায় যে নারীদের ছাড়া কোনো কালে পুরুষরা জয়ী হয়নি আজ সেই নারীরাই ধর্ষক নামক হায়েনাদের শিকার।
নেপোলিয়ন বলেছিলেন,“আমাকে শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাদের শিক্ষিত জাতি উপহার দেব”। যেই মা-রা একটি শিক্ষিত জাতি উপহার দেওয়ার ক্ষমতা রাখে সেই মাকেই আজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্ষণ করা হয়। মায়ের ধর্ষণ হওয়াটা এখন আর অস্বাভাবিক কিছু নয়। ধর্ষণ নামক এই মারাত্মক ব্যাধিটি আজ মা জাতির ক্ষমতাটুকুও ছিনিয়ে নিতে চলেছে।ধর্ষণ আজ এমন এক মারাত্মক ব্যাধি হয়ে দাঁড়িয়েছে যা সমগ্র বাংলাদেশে নিজের রাজ্য তৈরি করে নিয়েছে এবং সেই রাজ্যের রাণী বানিয়েছে স্বাধীন দেশের অসহায় নারীদের। যা থেকে উঠে আসে হাজারও ধর্ষণের গল্প। আজ আমাদের স্বাধীন দেশের সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হলো ধর্ষণ। যা এই দেশের ধর্ষক নামক হায়েনাদের কাছে ফ্যাশন ছাড়া আর কিছুই নয়।
১৪টি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে করা বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের পরিসংখ্যান বলছে, ২০০৮ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ৮ বছরে ধর্ষণের শিকার ৪ হাজার ৩০৪ জনের ভেতর ৭৪০ জনকে ধর্ষণ করে হত্যা করা হয়েছে।
বছরভিত্তিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০০৮ সালে ধর্ষণের শিকার ৩০৭ জনের ভেতর ধর্ষণ করে হত্যা করা হয় ১১৪ জনকে। ২০০৯ সালে ধর্ষণের শিকার ৩৯৩ জনের ভেতর ১৩০ জন, ২০১০ সালে ধর্ষণের শিকার ৫৯৩ জনের ভেতর ৬৬ জন, ২০১১ সালে ধর্ষণের শিকার ৬৩৫ জনের ভেতর ৯৬ জন, ২০১২ সালে ধর্ষণের শিকার ৫০৮ জনের ভেতর ১০৬ জন, ২০১৩ সালে ধর্ষণের শিকার ৫১৬ জনের ভেতর ৬৪ জন, ২০১৪ সালে ধর্ষণের শিকার ৫৪৪ জনের ভেতর ৭৮ জন এবং ২০১৫ সালে ধর্ষণের শিকার ৮০৮ জনের ভেতর ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় ৮৫ জনকে।
ধর্ষণের এই পরিসংখ্যান শুধু ই সংখ্যা মনে হলেও ভুক্তভোগীর পরিবার জানে এই পরিসংখ্যান এর মানে কী। এ থেকে অনায়াসেই বুঝা যাচ্ছে যে, অনেক তনু, সোহাগীকে এই পৃথিবী ছাড়তে হয়েছে ধর্ষণের শিকার হয়ে। দেশে যে হারে ধর্ষণ ও ধর্ষণের পর হত্যা করার ঘটনা ঘটেছে তাতে নারী জাতি ভীষণ উদ্বিগ্ন ও আতঙ্কিত। তনু হত্যা, নুসরাত হত্যা, খাদিজা হত্যা, সোহাগী হত্যা, যুবক ছেলের সামনে মা-কে ধর্ষণ, স্বামীকে বেঁধে রেখে স্ত্রীকে ধর্ষণ, আমাদের বারবার চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে নারীর নিরাপত্তা রক্ষার্থে আমাদের রাষ্ট্র ও প্রশাসনের অবস্থান কতটুকু নিচে।
আমরা হয়ত এই কঠিন পরিসংখ্যান এর মুখোমুখি হতাম না যদি এসব ধর্ষণের যথাযথ বিচার আমরা পেতাম। বিচারহীন এই অপসংস্কৃতির ভয়াল থাবায় আজ আমরা নারীরা সহিংসতা ও শ্লীলতাহানির শিকার হচ্ছি। তাই ধর্ষণের শাস্তিসমূহ যদি আমাদের দেশে প্রশাসন কর্তৃক কার্যকর করা হয় তবেই আমাদের ভেতর লুকিয়ে থাকা কিংবা বসবাস করা অসভ্য, বর্বর মানুষগুলোকে খুব দ্রুতই দেশের মাটি থেকে ছাটাই করতে পারবো।
এই দেশ স্বাধীন, আমি স্বাধীন, আপনি স্বাধীন। আমরা সকলেই স্বাধীন। এই দেশ আমার, এই দেশ আপনার। আমাদের সকলেরই। আর আমরাই পারবো ধর্ষকদের প্রতিরোধ করতে। যদি তা সম্ভব না হয়, তাহলে হয়তো সকল নারীকে একত্রিত হয়ে বলতে হবে— নিজস্ব স্বাধীনতার, নিজস্ব অধিকারের, নিজস্ব নিরাপত্তার “ভাগ দে হারামজাদা, নইলে মানচিত্র খাবো”। সর্বোপরি বলতে চাই যে, ধর্ষণের মতো এই ভয়াবহ ব্যাধিকে নির্মূল করতে হলে প্রথমে আমাদের মন ও মননকে পরিবর্তন করতে হবে। নারীর প্রতি শ্রদ্ধা জাগ্রত করতে হবে। তবেই পারবো এই ব্যাধিকে নির্মূল করতে।
লেখক: শিক্ষার্থী, এইচএসসি পরীক্ষার্থী, ফেনী সরকারি কলেজ