Saturday 07 Jun 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

মাথা উঁচু রাজকন্যা, নয়তো মুকুট পড়বে খসে


৯ অক্টোবর ২০২০ ১৩:৩৫ | আপডেট: ৯ অক্টোবর ২০২০ ১৬:০০
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

অন্ধকারে ঢেকে গেছে ‘মুখপুস্তক’। মনে হচ্ছে যেন কালো বোরকায় ঢাকা নারীমুখ, সেই চিরচেনা নিরাপত্তা বেষ্টনী। এভাবেই স্বেচ্ছায় আলো থেকে নিজেদের আড়াল করেই কি চলবে মেয়েদের চিরকালের মুক্তিযুদ্ধ?

আমাদের স্কুলে শেখানো হয়েছিল, ‘মেয়েরা তোমরা মাথা উঁচু করে ঘাড় সোজা করে হাঁটবে। রাস্তার বেশিরভাগ মেয়েদের দেখি কুঁজা হয়ে মাটির দিকে তাকায় হাঁটে, রাগে গা জ্বলে যায়। মাথা থাকবে সোজা, দৃষ্টি থাকবে সামনে, কান আর কাঁধের মাঝে পাঁচ আঙুল ফাঁক থাকবে। হাঁটা দেখলে দূর থেকে মনে হবে স্ট্রং এন্ড কনফিডেন্ট।’ (সিফাত ই সাইদের ফেইসবুকের স্মৃতিকথা থেকে নেওয়া)

কি অদ্ভুত এক জাতি! এমন শক্তিশালী লড়াকু ইতিহাস থেকে জন্ম নেওয়া এই জাতিকে হাত ধোয়া শেখাতে হয়, হাঁটা শেখাতে হয়, মানুষ হতে শেখাতে হয়।

বিজ্ঞাপন

হঠাৎ ‘নাকি’ বেড়েছে ধর্ষণ। এর জন্য শাহবাগ দখল, দেওয়ালে গ্রাফিতি, ফেইসবুকে কালোমুখ। অভিনেত্রী প্রভার কথা মনে আছে? আমার জানা নেই কি বিচার হয়েছিল ছেলেটার, যে তাদের স্পর্শকাতর ভিডিও ভাইরাল করে ব্যাপকভাবে নিপীড়িত করতে পেরেছিল প্রভাকে। ছেলে নিজেও ছিল ভিডিওতে। আমরা সবাই দেখেছি সেই ভিডিও/ছবি। ব্যাপক বিনোদনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল আমাদের। ছেলেটি, ছেলেটির পরিবারের কি হয়েছিল? জানি না। তবে মেয়েটি ফিরে এসেছিল।

ডা. আব্দুর নুর তুষারের ‘জয়তু’ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে কয়েক বছর পর প্রভা প্রত্যাবর্তন করেছিল হেলাল হাফিজের কবিতার মতো,

‘প্রত্যাবর্তনের পথে
কিছু কিছু ‘কস্ট্‌লি’ অতীত থেকে যায়
কেউ ফেরে, কেউ কেউ কখনো ফেরে না।
… তবু ফেরে, কেউ তো ফেরেই,
আর জীবনের পক্ষে দাঁড়ায়’

ফুলন দেবীও ফিরে এসেছিলেন। লেখক নুরুদ্দিন জাহাঙ্গীর নিজেকে ফুলন দেবীর আসনে বসিয়ে উত্তর খুঁজেছেন- ‘ধর্ষিতা হওয়ার মতো আমার রূপ কোনো কালেই ছিল না। নিম্নবর্ণের আর নিম্নবর্গের একটি মেয়েকে কারো খায়েশ হবে আমি ভাবতাম না। আমার হাড্ডিসার দেহে মজা লোটার মতো কীই-বা থাকবে? তুমি জানতে চাইছো তারপরেও কেন আমি ধর্ষিত হলাম।’

হ্যা। আপনি তো তারপর ক্ষমতার সর্বোচ্চ পর্যায়েও আরোহন করেছেন। ক্ষমতার শিখরে পৌঁছেও অসংখ্য নারী ধর্ষিত হতে দেখেছেন, আপনার কাছে আমার শেষ প্রশ্ন, কারা ধর্ষণ করে?

ফুলন দেবী উত্তর দিলেন, ‘ক্ষমতা, আর কেউ নয়। ‘

উনার এই লেখার নীচের একটা মন্তব্য আমার আরও মন কেড়েছে, একজন পাঠক লিখেছেন, ‘যারা ক্ষমতার যোগ্য নয়, তারা ক্ষমতা পেলে ভার লইতে পারে না। টেস্টোস্টেরন হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে মস্তিস্কে বিকৃত কমান্ড আসে।’

কিন্তু লেখাটা পড়ে মনে হল তাহলে হাড্ডিসার মজনু কেন ধর্ষক? রোগা পটকা মজনু এতই অথর্ব দেখতে যে আমরা ধর্ষক বলতেই যেই ‘মিশা সওদাগরের’ মতো শক্তিমান মুখটাকে কল্পনা করি তার সাথে সে বড়ই বিসদৃশ। একজন পাঠক মন্তব্য করেছিল যে ‘আজকাল মেয়েদের সম্পর্কে কোন আইডিয়াই নাই। এরা টাকার জন্য করতে পারে না এমন কোন কাজ নাই। মজনুর মতো ছেলেকে এক ধাক্কা দিয়েই তো উড়ায় দিতে পারে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া একজন স্মার্ট মেয়ে।’

কিছু বলার নাই। আমি কমেন্ট সেকশনটা সবসময় খুব মন দিয়ে পড়ি। অনেকটা সুনীলের সেই কবিতার মতো, ‘আমি মানুষের পায়ের কাছে কুকুর হয়ে বসে থাকি, তার ভেতরের কুকুরটাকে দেখবো বলে।’ ক্ষমতার অভাবে অনেকেই ধর্ষণের স্বাদ নেভান ফেইক/অরিজিনাল একাউন্ট থেকে অন্যের শ্লীলতাহানি করে। সেই তালিকায় শুধু নারী না, আছেন ব্রিটিশের চাটুকার ও পরকীয়া আসক্ত রবীন্দ্রনাথ, নাস্তিক আনিসুজ্জামান স্যার, দালাল জাফর ইকবাল স্যার, স্খলিত সাকিব আল হাসান- ‘যে নিজেই নৈতিক স্খলনের জন্য এক বছর ক্রিকেট খেলতে পারেননি তিনি আর ধর্ষণের বিপক্ষে কি নৈতিক অবস্থান নিবেন?’

বেশ আগের কথা। সম্ভবত টানবাজার থেকে ব্রথেল উচ্ছেদ করা হচ্ছিল। পত্রিকায় একজন কর্মী বলেছিলেন, ‘আমাদের যদি উচ্ছেদ করা হয় তাহলে শহরের মোড়ে মোড়ে মেয়েরা প্রতিদিন ধর্ষিত হবে।’ খুবই গা জ্বালা করেছিল কথাটা শুনে। কিন্তু হয়ত সত্যি কথা হচ্ছে, ওরাই জানে শহরটার আসল রূপ।

কয়েকবছর আগে নেদারল্যান্ডস গিয়ে দেখি রাজকীয় গির্জালয়ের খরচ আর পোষানো যাচ্ছে না। তাই সেখানে গড়ে উঠেছে সবচেয়ে লাভজনক আইনগতভাবে বৈধ ব্রথেল। রাষ্ট্র ট্যাক্স কামাচ্ছে, ট্যুরিস্ট তৃপ্ত, রাষ্ট্র নিরাপদ। সবাই যেসব রাষ্ট্রকে নিরাপদ বলে বাহবা দিচ্ছে মূলত সেইসব দেশে এত আমোদ প্রমোদের বৈধ ব্যবস্থা যে ওনাদের আর হেঁটে যাওয়া মেয়েদের দিকে লোলুপ দৃষ্টি দেওয়ার অবকাশ নাই।

‘মহিলা তেঁতুলের মতো-তেঁতুলের মতো-তেঁতুলের মতো। ছোট্ট একটা ছেলে তেঁতুল খাইতেসে, আপনে দেখতেছেন, আপনার মুখ দিয়া লালা বাইর হবে। সত্য না মিথ্যা বলেন তো?’ হুজুর আমাকে খুব সরল ভাষায় বুঝিয়ে দিয়েছেন কেন এই অনাচার। উনি সম্মানিত ব্যক্তি। সম্প্রতি উনার মৃত্যুতে প্রধানমন্ত্রী এবং রাষ্ট্রপতি গভীর সমবেদনা জানিয়েছেন।

এইবার শুনি কার্পেটের নিচে ধূলো জমা বিবস্ত্র সমাজের গল্প। বাবার মতো ভালবাসি, দেবতার মতো সম্মান করি, যাকে আলো ভেবে অনুসরণ করি আশৈশব- আপনি যদি পহেলা বৈশাখে লাল সাদা শাড়ি পরে সেই প্রিয়ংবদা শিক্ষকের সামনে গান ধরেন, ‘একি অপরূপ রূপে মা তোমার হেরিনু পল্লী জননী,’ আশির বাঁশিতে ফুঁকেও তাঁর কি মনে হবে জানেন?

‘শরীরকে যতটুকু অনাবৃত রাখলে তা সবচেয়ে রহস্যচকিত হয়ে ওঠে, পোশাক হিসেবে শাড়ি তারই উপমা।… আধুনিক শাড়ি পরায় নারীর উঁচু-নিচু ঢেউগুলো এমন অনবদ্যভাবে ফুটে ওঠে, যা নারীকে করে তোলে একই সঙ্গে রমনীয় ও অপরূপ। শাড়ি তার রূপের শরীরে বইয়ে দেয় এক অলৌকিক বিদ্যুৎ হিল্লোল।’

পোকা ঘিরে ধরবে বলে আলো দেওয়া বন্ধ করেনি বাতি। আমাদের শিখাও অনির্বাণ। ত্রিশ বছর আগে আমাদের শিক্ষক যে কথা বলেছিলেন, সেই কথাটাই হঠাৎ একজনের কভার ফটোতে দেখে ভাল্লাগলো, ‘Chin up princess or the crown slips।’ কিছু কথা কালোত্তীর্ণ। ভাল থাকুক বাংলাদেশ।

টপ নিউজ নারী নির্যাতন

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর