Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

স্টিফেন হকিংয়ের ধর্মচিন্তায় ছিলো মানুষেরই জয়


১৬ মার্চ ২০১৮ ১১:০৮

জান্নাতুল মাওয়া, ফিচার রাইটার

আমাদের অনেকেই যখন প্রার্থনা করি, খুব মন দিয়ে যখন কিছু চাই সৃষ্টিকর্তার কাছে; তখন নিজের অজান্তেই তাকাই আকাশের দিকে। আমাদের অবচেতন মনে একটা ধারণা জন্মেছে যে সৃষ্টিকর্তা থাকেন আকাশে। হতে পারে আকাশের ব্যাপ্তি এবং আকাশ নিয়ে খুব সহজে জানতে না পারার বাঁধা থেকেই মানুষ ধরে নিয়েছে ঈশ্বর ওখানে থাকেন!

সেদিন (১৪ মার্চ) চলে গেলেন এই সময়ের সবচেয়ে স্মার্ট একজন মানুষ, মহাবিশ্বতত্ত্ববিদ এবং পদার্থবিদ স্টিফেন হকিং।

হকিং তার সন্তানদেরকে সবসময় উৎসাহ দিতেন, পায়ের দিকে না তাকিয়ে আকাশের তারাদের দিকে তাকাতে। এই কথার মাধ্যমে হয়তো মানুষকে তার সীমাবদ্ধতার দিকে না তাকিয়ে অসীমের দিকে তাকাতে বলছেন। তার দৃষ্টি সবসময় ছিল অসীমের দিকে, মহাকাশের দিকে। অথচ মাত্র ২১ বছর বয়সে যখন তার মটর নিউরন অসুখ ধরা পড়লো চিকিৎসকরা তাকে বলে দিলো হয়তো আর বড়জোর দুই বছর তিনি বাঁচবেন! তার বয়েসী ছেলে মেয়েরা যখন বাস্কেটবল খেলছে, ফুটবল মাঠে দৌড়ে বেড়াচ্ছে, জীবনকে উপভোগ করছে, সেখানে তার জীবন সীমাবদ্ধ হয়ে পড়লো হুইলচেয়ারের চাকায়।

আমরা সবাই মনে করি ঈশ্বরকে সবচেয়ে বেশি মনে করে দুর্বল মানুষেরা। যাদের কোন সহায় নেই, যাদের মাথার উপর মৃত্যুর পরোয়ানা ঝুলছে। আমাদের দেশে তো অনেক এমন দেখা যায়। তরুণ বয়সে ছিলেন নাস্তিক, সারাক্ষণ ধর্ম নিয়ে হাস্যরস করতেন। তারপর একটু বয়স বাড়লে যখন ডায়বেটিস ধরল, হাই প্রেশার কাবু করলো তখন আস্তে আস্তে পরনের প্যান্ট টাখনু গিরার উপরে উঠতে লাগলো। পরের দিকে ধর্ম তাদের বাড়াবাড়ি রকমের আচরণও দেখা যায়। সেইদিক থেকে ভাবলে, স্টিফেন হকিং এর ২১ বছর বয়সে যখন ভয়ানক অসুখটা ধরা পড়লো তখনই তার ধার্মিক হয়ে যাবার কথা। কারন মাথায় তার মৃত্যু পরোয়ানা ঝুলতে শুরু করেছিলো ওই বয়স থেকেই! তার যে অসুখ ছিলো তাতে, মস্তিষ্কের যে নার্ভগুলো আমাদের শরীরের মাসলগুলোকে পরিচালিত করে সেই নার্ভগুলো সব একসময় অকেজো হয়ে যায়। সুতরাং যে কোন সাধারণ ধার্মিক এমন মুহূর্তে হকিংকে দেখেলে মনে মনে ভাবতেই পারতেন যে, এতদিন তিনি যদিও নাস্তিক ছিলেন এখন এমন একটা বিপদের সামনে পড়ে হকিং অবশ্যই প্রচণ্ড ঈশ্বর ভক্ত হয়ে যাবেন। কিছু মিরাকলেও বিশ্বাস করতে শুরু করবেন। সত্যিই বিস্ময়করভাবে এরপর তিনি বেঁচেছিলেন আরও ৫৫ বছর! জীবনিশক্তিতে ভরপুর এই বিজ্ঞানী বলতেন, জীবনে যত খারাপ সময়ই আসুক না কেন, কিছু না কিছু তুমি করতে পারবেই এবং সফল হবে। যেখানে জীবন আছে সেখানেই আশা আছে। এই মন্ত্রে বিশ্বাসী হকিং প্রায় পঙ্গু হবার পরেও যথাসম্ভব স্বাভাবিক জীবন যাপন করবার চেষ্টা করে গিয়েছেন। পারিবারিক জীবনে তিনি তিন সন্তানের জনক ছিলেন, প্রথম স্ত্রী এবং প্রথম জীবনের বান্ধবী জেইনের সাথে বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে গেলে তিনি ১৯৯৫ সালে আবার বিয়ে করেন তার নার্স ম্যানসনকে। এছাড়া মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি শিক্ষকতা, গবেষণা, লেখালেখি চালিয়ে গিয়েছেন। শেষদিকে তিনি শুধু তার ডান গালের মাসল নাড়াতে পারতেন। আর সেই মাসলের ইশারাতেই কম্পিউটার স্পিচ সিন্থেসাইজারের সাহায্যে কথা বলতেন এই বিস্ময়মানব।

বিজ্ঞাপন

যার জীবনটা আমাদের কাছে মিরাকল, সেই আজব মানুষটা নিজে মিরাকলে বিশ্বাস করতেন না এতটুকুও! তিনি বলতেন, ধর্ম মিরাকলে বিশ্বাস করে, কিন্তু বিজ্ঞানের সাথে মিরাকল বিষয়টি ঠিক সঙ্গতিপূর্ণ নয়। তার মতে, সবকিছুই পদার্থবিজ্ঞানের অথবা প্রকৃতির নিয়মে হয়। এমন কি যদি কোন ঈশ্বর থেকেও থাকেন তিনিও সেই নিয়মের বাইরে গিয়ে কিছু করতে পারবেন না! স্টিফেন হকিং মানুষের বিশেষত্বেও বিশ্বাসী ছিলেন না। তার মতে, আমরা একটা খুব সাধারণ নক্ষত্রের চারপাশে ঘোরা একটি ক্ষুদ্র গ্রহের প্রাণী বানরের উন্নত সংস্করণ মাত্র। তবে আমরা বিশ্বকে বুঝতে পারি, আর এটাই আমাদেরকে বিশেষত্ব দিয়েছে।

এটি একটি লক্ষ্য করার মত বিষয় যে বেশিরভাগ বিজ্ঞানীরাই সাধারণত ঈশ্বরে অবিশ্বাসী হন। একটি জরিপে দেখা যায় ৯৩ ভাগ বিজ্ঞানীই ইশ্বরে বিশ্বাস করেন না, অন্যদিকে ৮৩ ভাগ সাধারণ আমেরিকান ইশ্বরে বিশ্বাসী। তেমনি ব্রিটিশদের মধ্যে ৪২ ভাগ ঈশ্বরে বিশ্বাস করলেও বিজ্ঞানীদের মধ্যে মাত্র ৫ ভাগ ইশ্বরে বিশ্বাস রাখেন। ১৯৯৮ সালে ন্যাচার ম্যাগাজিন শীর্ষ বিজ্ঞানীদের সংগঠন ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্সেস এর সদস্যদের নিয়ে একটি জরিপ চালায়। সেই জরিপে দেখা যায় বিশ্বে মাত্র সাত ভাগ বিজ্ঞানী ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন।

হকিং নিজে ঈশ্বরে বিশ্বাস না করলেও অপরের বিশ্বাসে কখনো আঘাত করেননি। তিনি বলতেন, আমাদের সবারই বিশ্বাসের স্বাধীনতা রয়েছে। আমরা যা চাই তাই বিশ্বাস করতে পারি। অর্থাৎ কেউ যদি বিশ্বাস করে শান্তি পায় তাতে তার কোন সমস্যাই নেই। ২০১৬ সালের ২৮ নভেম্বর বিজ্ঞানের প্রতিনিধি স্টিফেন হকিং আর ধর্মের প্রতিনিধি পোপ ফ্রান্সিস মুখোমুখি হয়েছিলেন। ইশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে এই দুই ব্যাক্তি সম্পূর্ণ বিপরীত বিশ্বাস পোষণ করলেও, তারা বেশ হাসিমুখেই একে অপরকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। পোপ ফ্রান্সিসের মতে ইশ্বর দয়াশীল এবং এই বিশ্বের চেয়েও বড়। পোপ ফ্রান্সিসের মতে বিজ্ঞান এবং এর আবিষ্কারগুলো ইশ্বরের অনস্তিত্ব প্রমাণ করতে পারেনা বা করে না। বরং বিবর্তনবাদসহ সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে বিজ্ঞানের সব থিওরিই মূলত ইশ্বরের বিশাল সৃষ্টিযজ্ঞেরই একটা অংশ। পোপ ফ্রান্সিস এও বলেন, ঈশ্বর কোন যাদুকর নয়, তাই তিনি এই বিশ্ব অনেক অনেক সময় নিয়েই তৈরি করেছেন। অর্থাৎ পোপ ফ্রান্সিস বিজ্ঞানের সাথে ধর্মের দ্বন্ধে আগ্রহী নন। যুক্তরাজ্যের প্রধান রাব্বাই (ইহুদি নেতা) বলেন, বিজ্ঞান সব কিছুর ব্যখ্যা খোঁজে আর ধর্ম খোঁজে সবকিছুর অর্থ। এই বিশ্ব কীভাবে তৈরি হল সেটি নিয়ে আসলে ধর্মের মাথা ব্যাথা নেই। অন্যদিকে, স্টিফেন হকিং ধর্ম আর বিজ্ঞানের মধ্যে সবসময় বিজ্ঞানকেই এগিয়ে রেখেছেন। তিনি বলেন, ধর্ম আর বিজ্ঞানের মধ্যে মূলগত পার্থক্য রয়েছে। ধর্ম দাঁড়িয়ে আছে কর্তৃত্বের উপর ভিত্তি করে। অন্যদিকে বিজ্ঞান দাঁড়িয়ে আছে পর্যবেক্ষণ আর যুক্তির উপর! শেষ পর্যন্ত বিজ্ঞানই জয়ী হবে। কারণ, এটি কার্যকর। আর্চবিশপ অফ ক্যান্টারবারি ডঃ রোয়ান উইলিয়ামস বলেছেন, ইশ্বরে বিশ্বাস হল এমন একটি বিশ্বাস যেটি মনে করে এই বিশ্বের সমস্ত কিছুর অস্তিত্বের পেছনে একজন বিশেষ বুদ্ধিমান কেউ আছেন। তার কাজের মাধ্যমেই সমস্ত কিছু অস্তিত্বমান হচ্ছে। অন্যদিকে হকিং বলতেন, প্রকৃতির নিয়মকে আমরা ইশ্বরের অবস্থানের প্রতিমূর্তি হিসেবে ধরে নিতে পারি। কিন্তু বেশিরভাগ মানুষ ইশ্বরকে শুধু সেই নিয়ম হিসেবে দেখেনা, বরং ইশ্বরকে তারা তাদের রুপে কল্পনা করে। যার সাথে তারা ব্যক্তিগত সম্পর্কও খোঁজে। অথচ এই বিশ্বের বিশালতার মাঝে মানুষের অস্তিত্ব একদমই নগণ্য। তাই এত বিপুল বিশ্বের যে ঈশ্বর, মানুষের সাথে তার এত গভীর সম্পর্ক থাকার বিষয়টি তিনি অসম্ভব মনে করেন।
স্টিফেন হকিং মৃত্যুর পরের জীবনে বিশ্বাস করতেন না। তাই তিনি বলতেন, বিশ্বের এই বিশালতাকে উপভোগ করার জন্যে আমাদের এই একটাই জীবন আছে। এই জন্যে আমি এই জীবনের প্রতি অত্যন্ত কৃতজ্ঞ। তিনি আরও বলেন যারা মৃত্যুকে ভয় পায় তারাই স্বর্গ আর মৃত্যুর পরের জীবনের এই কাল্পনিক গল্পে বিশ্বাস রাখে। আমি মনে করি ব্রেইন হল কম্পিউটারের মত। যার পার্টসগুলো অকেজো হয়ে গেলে এটির জীবনিশক্তি শেষ হয়ে যায়। একটা ভাঙা কম্পিউটারের যেমন কোন পরের জীবন নেই তেমনি মানুষেরও পরের জীবন নেই। আমি গত ৫০ বছর ধরেই জানি যে আমি খুব তাড়াতাড়ি মারা যাবো। তাই আমি আর মৃত্যুকে ভয় পাইনা। তবে আমার মরে যাবার জন্যে কোন তাড়াহুড়াও নেই। কারণ আমার অনেক কাজ বাকি রয়ে গিয়েছে। দীর্ঘ ৫৫ বছর ধরে তিনি জানতেন যে কোন সময় তিনি মারা যাবেন। আর তাই, তিনি জীবনকে উপভোগ করতেন তার সমস্ত প্রাণশক্তি দিয়ে। মোটরচালিত হুইলচেয়ারে চড়ে তিনি সানফ্রান্সিস্কোর সবচেয়ে বড় পাহাড়ের উপর থেকে নেমেছেন! এন্টার্কটিকায় গিয়েছেন, সাবমেরিনে চড়েছেন। ২০০৭ সালে বিশেষ একটি জেট প্লেনে চড়ে তিনি ওজনশূন্যতার অভিজ্ঞতা নেন। তার খুব শখ ছিলো মহাকাশে বেড়াতে যাবেন। ২০১৭ সালে একবার সেই সম্ভাবনা দেখা যাওয়ায় তিনি শিশুর মত আনন্দিত হয়ে উঠেছিলেন। সাধারণত বিজ্ঞানীরা অপ্রমাণিত কোন বিষয়ে বিশ্বাস করতে চাননা। কিন্তু স্টিফেন হকিংস ঈশ্বরে অবিশ্বাসী হলেও তিনি মহাকাশ নিয়ে বলতে গেলে একরকম ফ্যান্টাসিতেই বাস করতেন। তিনি বলতেন, এত বড় বিশ্বের কোথাও না কোথাও অন্য কোন নক্ষত্রের চারপাশে ঘুরতে থাকা কোন গ্রহে হয়তো আমাদের চেয়েও উন্নত কোন প্রাণি থাকে। এই সম্ভাবনাটাকে তিনি খুব বেশিই আগ্রহের সাথে বিশ্বাস করতেন! এছাড়াও তিনি খুব শক্তভাবে বিশ্বাস করতেন যে মানুষ যদি তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে চায় তাহলে তাকে খুব দ্রুত মহাকাশের অন্য কোনো গ্রহে বসত গড়ে তুলতে হবে।

বিজ্ঞাপন

২০১০ সালে এবিসি নিউজকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে হকিং বলেছিলেন, তিনি জানতে চান কেন এই বিশ্ব সৃষ্টি হয়েছে? এই বিশ্ব সৃষ্টির কারণ খুঁজতে গিয়েই পৃথিবীতে এসেছে নানান বিশ্বাস আর সেই বিশ্বাসগুলো মিলে মিশে সৃষ্টি হয়েছে অনেক ধর্মের। যেদিন বিজ্ঞান সত্যিই উত্তর দিতে পারবে যে, কেন এই বিশ্ব সৃষ্টি হয়েছে, সেদিন হয়তো ধর্মের উপযোগিতা থাকবে না। কিন্তু তার আগ পর্যন্ত ধর্ম আর বিজ্ঞান হয়তো সমান্তরালে চলবে।

ধর্ম, ঈশ্বর আর পরকালে অবিশ্বাসী স্টিফেন হকিং তার সন্তানদেরকে তিনটি উপদেশ দিয়েছিলেন;
প্রথমত, মনে রেখো সবসময় আকাশের তারাদের দিকে তাকাবে, নিজের পায়ের দিকে তাকিয়ো না।

দ্বিতীয়ত, কখনো কাজ করা ছেড়ে দিয়োনা, কাজ তোমার জীবনকে অর্থপূর্ণ করে তোলে। কাজ ছাড়া তোমার জীবন আসলে শূন্য।

তৃতীয়ত, যদি কখনো ভালাবাসা পাবার মত ভাগ্যবান হও তাহলে সেটাকে কখনো ছুঁড়ে ফেলোনা।

আকাশের দিকে তাকানো, কাজের জন্যে নিজেকে বিলিয়ে দেয়া আর ভালোবাসার প্রতি আন্তরিক হওয়া; এই তিনটি বিষয়ে ধর্ম আর বিজ্ঞানের কোন বিরোধ নেই তো! ধর্ম আর বিজ্ঞানকে সমান্তরালে চলতে দিয়ে তাই আমরা যদি বলি- ‘মানুষ জিতবে’; খুব ভুল হবে কি কথাটা?

সারাবাংলা/জেএম/এমএম

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর