করোনাকালে বিশ্বে আলোচিত নারীরা (পর্ব-২)
৩১ ডিসেম্বর ২০২০ ১২:০০
বিশ্ব পরিস্থিতি এলোমেলো হয়ে যায় গত ডিসেম্বরে চিনে কোভিড-১৯ নামের এক নতুন ধরণের করোনাভাইরাসের আবির্ভাবের পর। অতিদ্রুত ছড়াতে সক্ষম এই ভাইরাস চোখের পলকেই ছড়িয়ে যায় দুনিয়ার এপাশ থেকে ওপাশ। ভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে দেশে দেশে লক ডাউন দিয়ে জন মানুষের চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এর মধ্যেই আস্তে আস্তে শুরু হয় বৈশ্বিক কার্যক্রম। অন্যান্য বছরের মত স্বাভাবিকভাবে না হলেও নিউ নরমাল নাম দিয়ে নতুন বাস্তবতায় জীবনযাপন শুরু করে বিশ্ববাসী। জীবাণু সংক্রমণ রোধে মাস্ক পরা, হাত ধোয়া ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখায় কড়াকড়ি আরোপ করা হয় বিভিন্ন দেশে। আর সেসব মেনেই বিশ্বের অধিকাংশ জায়গায় অর্থনৈতিক কর্মকান্ড থেকে শুরু করে খেলাধুলা ও বিনোদনের কার্যক্রম শুরু হয় স্বল্প পরিসরে। স্বল্প পরিসরে হলেও এদের মধ্যে দৃষ্টি কেড়ে নিয়েছেন অসংখ্য নারী। তবে আমরা আজ বিশ্বজুড়ে আলোচনায় আসা এমন বিশজন নারীর কথা তুলে ধরব যাদের অবদান বিশ্ব পরিস্থিতি বদলে দিতে ভূমিকা রেখেছে বছরজুড়ে।
বছরজুড়ে বিশ্বে আলোচিত নারীরা (পর্ব-১
১১. সান্না মারিন
মাত্র একবছর আগে ফিনল্যান্ড সরকারের দায়িত্ব নিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেন বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ প্রধানমন্ত্রী সান্না মারিন। এই এক বছরে করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে ওলটপালট হয়ে গেছে বিশ্ব পরিস্থিতি। ৩৪ বছর বয়সে সরকারের দায়িত্ব নিয়েও ভালোভাবে করোনাভাইরাস পরিস্থিতি সামাল দিতে পারায় বছরজুড়েই আলোচনায় সান্না মারিন। বেশ অল্প বয়স থেকেই রাজনৈতিক পদ-প্রতিষ্ঠা পাওয়া মারিন ছিলেন ফিনল্যান্ডের পূর্ববর্তী সরকারের যোগাযোগ মন্ত্রী। ডাক বিষয়ক এক গণবিক্ষোভের মুখে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করতে বাধ্য হলে সর্বাধিক ভোটে তার স্থলাভিষিক্ত হন সান্না মারিন। যে পাঁচদলীয় কোয়ালিশন সরকারের অংশ তিনি, প্রতিটি দলের প্রাধান নারী এবং একজন বাদে সবাই ত্রিশোর্দ্ধ। নভেম্বরে প্রকাশিত বিবিসি ১০০ প্রভাবশালী নারীর তালিকায় জায়গা করে নেন সান্না মারিন। ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে করোনাভাইরাস পরিস্থিতি সামলানোর জন্য তার প্রশংসা করা হয়। শুধু অতিমারিই নয়, জলবায়ু পরিবর্তন, শিক্ষাখাতে বিনিয়োগ এবং সম অধিকারভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠায়ও ভূমিকা রেখে চলেন তিনি।
১২. লালে ওসমানী
আফগানিস্তানের হেরাত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামিন আইনে ডিগ্রি নেওয়া লালে মাত্র ২৮ বছর বয়সেই জায়গা করে নিয়েছেন বিবিসির ১০০ প্রভাবশালী নারীর তালিকায়। তালিকায় লালেকে একজন নারী অধিকারকর্মী হিসেবে পরিচিত করানো হয়েছে।
পেশায় আইনজীবী লালে তিন বছর আগে থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘হ্যাশট্যাগ হোয়ার ইজ মাই নেম’ ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে একটি আন্দোলন শুরু করেন। আফগানিস্তানের কোথাও অফিসিয়ালি নারীর নিজের নাম ব্যবহারের সুযোগ নাই। যেকোন নথি, বার্থ বা ডেথ সার্টিফিকেট থেকে শুরু করে কবরের স্তম্ভেও নারীর নিজের নাম দেওয়া থাকে না, বাবার নাম দেওয়া থাকে। এমনকি বিয়ের সময় বা হাসপাতালে ভর্তি হতে গেলেও নারীর নিজের নামে কোন রেকর্ড রাখা হয়না।
সেই বৈষম্যমূলক ব্যবস্থার বিরুদ্ধেই সচেতনতা গড়ে তুলে আলোচনায় আসেন এই তরুণী। এই আন্দোলনের সহ প্রতিষ্ঠাতা আরেক নারী তাহমিনা রাশিক। তিনবছরের লড়াই শেষে আফগান সরকার সন্তানের জাতীয় পরিচয়পত্রে মায়ের নাম যোগ করতে সম্মত হয়।
বিবিসিকে লালে বলেন, ‘পৃথিবীকে আরেকটু বাসযোগ্য বানাতে সবারই কিছু না কিছু করার আছে। পরিবর্তন কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। আফগানিস্তানের মত এমন রক্ষণশীল দেশেও নারীরা নিজের পরিচিতির জন্য লড়াই করে সাফল্য পেয়েছে।’ যদিও তালিবানরা এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে বলছে আফগান সরকার মার্কিনদের সন্তুষ্ট করতেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
১৩. কমলা হ্যারিস
যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট প্রার্থি জো বাইডেন মনোনয়ন পাওয়ার পর থেকেই তার রানিংমেট হিসেবে একজন নারীকেই নেওয়ার সম্ভাবনার কথা বলছিলেন সবাই। অবশেষে সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে গত আগস্টে তিনি ভারতীয় ও জ্যামাইকান বংশদ্ভুত কমলা হ্যারিসকে তার রানিংমেট হিসেবে বেছে নেন। সেই থেকেই আলোচনায় কমলা।
জানুয়ারিতে দায়িত্ব নিতে যাওয়া ডেমোক্র্যাট সরকারের তিনি হবেন উপ-রাষ্ট্রপতি। তিনিই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের প্রথম নারী উপ-রাষ্ট্রপতি। আবার একইসঙ্গে প্রথম কৃষাঙ্গ ও প্রথম দক্ষিণ এশীয় বংশোদ্ভূত হিসেবেও তিনি এই পদে স্থলাভিষিক্ত হওয়া প্রথম। আজীবন বর্ণবৈষম্য মোকাবিলা করে গিয়ে চলা কমলার কর্মজীবন জনসেবায় নিয়োজিত। তিনি প্রায় চার বছর ক্যালিফোর্নিয়ার জুনিয়র সিনেটর এবং বিচার ও গোয়েন্দা বিভাগের ‘কমিটি সদস্য’ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। সিনেটর হওয়ার আগে কামালা ক্যালিফোর্নিয়ার অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে ছয় বছর এবং সানফ্রান্সিসকো ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি হিসেবে দুই মেয়াদে দায়িত্ব পালন করেন।
বাইডেন তার নির্বাচনী সঙ্গী হিসেবে বাছাই করার আগে কামালা ডেমোক্র্যাটিক পার্টি থেকে নিজেই প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন। প্রাথমিক বাছাইয়ের সময় বর্ষীয়ান জো বাইডেনকে সমর্থন জানিয়ে সরে দাঁড়ান তিনি।
১৪. অ্যাঙ্গেলা মেরকেল
‘বিশ্বনেতাদের মধ্যে জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেল অবস্থান কিছুটা ভিন্ন। বেশিরভাগ নেতাই যেখানে ভিড়কে খুশি রাখার মত কথা বলেন বা কাজ করেন সেখানে মার্কেল কিছুটা জটিল সমস্যার সমাধান করতে পছন্দ করেন। কোন সমস্যার সমাধানের ক্ষেত্রে দেশের অভ্যন্তরের ও আন্তর্জাতিক উভয় দিকই মাথায় রাখেন তিনি। সাধারণত দূরদর্শী সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে খ্যাতি আছে তার। এবং যেখানে সম্ভব সেখানে আগেভাগে কিছু বলা বা করা এড়িয়ে চলেন।’ তাকে নিয়ে টাইম সাময়িকীতে লিখেছেন ইউরোপিয়ান কমিশনের সভাপতি উরসুলা ভন ডার লেন।
বছরজুড়ে আলোচিত ৭ নারী– দেশে
টাইমের বিশ্বসেরা একশ প্রভাবশালীর তালিকায় আছেন অ্যাঙ্গেলা মেরকেল। সমগ্র ইউরোপ যখন করোনাভাইরাস পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম তখন সফলতার সঙ্গে সংক্রমণ ও মৃত্যুসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে দিয়ে আলোচনায় ছিলেন এই উন্নত বিশ্বের প্রতিনিধি একমাত্র এই নারী নেত্রী।
বিশ্ব রাজনীতি ছাড়াও ব্যবসা, নীতি-নির্ধারণ, বিনোদন, প্রযুক্তি, গণমাধ্যম ও অলাভজনক সংস্থায় সফলতার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন অ্যাঙ্গেলা। সদা মিষ্টভাষী এ জার্মান নেত্রীর কাছে গণমানুষ এবং সামাজিক কল্যাণই প্রাধান্য পায়। নারী অধিকার আদায়ে সোচ্চার এ নেত্রী রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় নারী নেতৃত্বকে উৎসাহিত করেন। তবে দক্ষতা আর নেতৃত্ব গুণ- এ দুই বিষয়ে তিনি আপোষহীন। সব মিলিয়ে বৈশ্বিক ক্ষমতায়ন আর সামাজিক গুণে অ্যাঙ্গেলা মার্কেল বিশ্ব নারী নেত্রীদের ইতিহাসে এক অনন্য দৃষ্টান্ত।
১৫. ক্রিস্টাইন লাগারদে
কেন্দ্রীয় ইউরোপিয়ান ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ক্রিস্টাইন লাগারদে যিনি প্রথম নারী হিসেবে এই পদে স্থলাভিষিক্ত হন। গত বছর নভেম্বরে দায়িত্ব পাওয়ার পরই বিশ্বজুড়ে প্যানডেমিকের কারণে নতুন ধরণের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হন তিনি। ২০২০ এর নভেম্বরে তিনি আগামী বছরের প্রথম ছয় মাস দারুণ চ্যালেঞ্জের বলে ভবিষ্যৎবাণী করেছেন।
এর আগে ২০১১ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত আন্তর্জাতিক অর্থ সংস্থা (আইএমএফ) এর প্রধান হিসেবে সারাবিশ্বের অর্থব্যবস্থা সাফল্যের সঙ্গে সামলান তিনি। আইএমএফেও প্রথম নারী হিসেবে ওই পদে বসেন তিনি। ২০০৮ এর ব্যাংক ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার দশ বছর পূর্তিতে তিনি ব্যাংক ও অর্থ ব্যবস্থায় পুরুষদের প্রাধান্য ও তাদের দলবেঁধে চলার নীতিকে দায়ী করেন এবং লিঙ্গ বৈষম্য কমানোর দাবি করেন।
১৬. জেসিন্ডা আর্ডেন
নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আর্ডেন দ্রুততম সময়ের মধ্যে করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে প্রশংসা কুড়ান বিশ্বজুড়ে। বিশ্বে করোনা ছড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে মার্চের ১৯ তারিখ দেশের সীমানা বন্ধ করে দেন ও ২৩ মার্চ থেকে দেশব্যাপি চার সপ্তাহের কঠোর লক ডাউন জারি করেন। জরুরি সেবা ছাড়া সবই পায় বন্ধ হয়ে যায়। ফলাফল হিসেবে জুনের ৮ তারিখ সর্বশেষ করোনা রোগী সুস্থ হয়ে উঠেছেন বলে ঘোষণা দেয় নিউজিল্যান্ড এবং তুলে নেওয়া হয় লক ডাউন। আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি সর্বশেষ রোগী সুস্থ হয়ে ওঠার দিন আনন্দে নাচার কথা জানান জেসিন্ডা।
অন্যদিকে সম্প্রতি ৩২তম দেশ হিসেবে পরিবেশগত জরুরি অবস্থা জারি হয়েছে নিউজিল্যান্ডে। ২০২৫ সালের মধ্যে কার্বন নিরপেক্ষ দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশের লক্ষ্যকে সামনে রেখে, বুধবার (২ ডিসেম্বর) নিউজিল্যান্ডের পার্লামেন্টে বিলটি ৭৬-৪৩ ভোটে পাস হয়। সেদিন পার্লামেন্টে প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আর্ডেন আইন প্রণেতাদের উদ্দেশে বলেছেন, ‘এই জরুরি অবস্থা জারি পরবর্তী প্রজন্মের জন্য একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে। তাদের কথা বিবেচনা করে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’
এই জরুরি অবস্থা বিলের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা জানিয়েছেন, যেহেতু জলবায়ু পরিবর্তন নিউজিল্যান্ডের মানুষের জীবনকে ঝুঁকির মুখে ফেলছে তাই জরুরি অবস্থা জারি করা ছাড়া আর কোন বিকল্প ছিল না।
১৭. উরসুলা ভন ডার লেন
২০১৯ সালের পহেলা ডিসেম্বর ইউরোপীয় ইউনিয়নের ইতিহাসে প্রথম নারী হিসেবে ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন তৎকালীন জার্মান প্রতিরক্ষামন্ত্রী উরসুলা ভন ডার লেন। এর আগে ৬২ বছর বয়সী এই রাজনীতিক ২০১০ সাল থেকে জার্মানির ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাট দলের সহসভাপতির দায়িত্ব পালন করছিলেন। এর আগে তিনি নিদারসাক্সেন রাজ্যের পরিবারবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। পেশায় চিকিৎসক এবং সাত সন্তানের মা উরসুলা ভন ডার লেন চিকিৎসাবিদ্যায় অভিসন্দর্ভ করাসহ লন্ডন স্কুল অব ইকনোমিকসে রাজনীতি ও অর্থনীতি বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন। এখন তিনি ৩২ হাজার মানুষের এক প্রতিষ্ঠানও দক্ষতার সঙ্গে সামলাচ্ছেন।
২০২০ সালে টাইমের ১০০ প্রভাবশালী নারীর তালিকায় চলে আসে উরসুলা ভন ডার লেনের নাম। তার সম্পর্কে ইউরোপীয়ান সেন্ট্রাল ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট লাগারদে টাইম ম্যাগাজিনে লিখেছেন, ‘উরসুলা ভন ডার লেন এমন একজন রাজনীতিক যিনি স্বছন্দের সঙ্গে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেন এবং প্রতিকূল পরিস্থিতিতে কখনোই পিছিয়ে যান না। তিনি এমন এক ইউরোপের স্বপ্ন দেখেন যেখানে ২০৫০ সাল নাগাদ কার্বন নিঃসরণ কমে একটি সুস্থ পর্যায়ে আসবে, ডিজিটাল ব্যাবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্য তৈরি হবে এবং একইসঙ্গে বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ দৃঢ়ভাবে মোকাবিলা করবে।’
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বর্তমান কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে বিশ্বকে সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক বিপর্যয় থেকে রক্ষার জন্য তিনি চলতি বছরের মে মাসে ৭৫০ বিলিয়ন ডলারের রিকভারি ফান্ড গঠনের প্রস্তাব দেন যা দুই মাসের মাথায় ইউরোপীয় ইউনিয়নভুলত দেশগুলোর সরকারপ্রধানরা অনুমোদন দেন।
১৮. স্টেফানি ফ্র্যাপার্ট
পুরুষ ফুটবলের লীগ পর্যায়ের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ আসর উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লীগের ম্যাচে প্রথমবারের মতো নারী রেফারি হিসেবে ম্যাচ পরিচালনা করে ইতিহাস গড়েন স্টেফানি ফ্র্যাপার্ট।
বুধবার (২ ডিসেম্বর) ইতালির তুরিনে অনুষ্ঠেয় জি গ্রুপের জুভেন্টাস ও ডায়নামো কিয়েভের ম্যাচ পরিচালনা করেন ৩৬ বছরের এই নারী রেফারি। ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর ৭৫০তম গোলের মাইলফলক উদযাপনের এই ম্যাচে তার দল জুভেন্টাস ৩-০ গোলে জয় পায়।
চ্যাম্পিয়নস লীগের ম্যাচে প্রথমবার দায়িত্ব পালন করলেও পুরুষদের ফুটবলে রেফারি হওয়া এই প্রথম নয় ৩৬ বছর বয়সী স্টেফানির। এর আগেও আরেক মর্যাদাপূর্ণ ইউরোপিয়ান লীগ উয়েফা সুপার কাপের ফাইনালেও রেফারির দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ২০১৯ এর সেপ্টেম্বরে লিভারপুল ও চেলসি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সেই ম্যাচে।
ইস্তানবুলে অনুষ্ঠেয় সেই ম্যাচের পর সিএনএনের কাছে এক প্রতিক্রিয়ায় স্টেফানি জানান, ‘নারী ফুটবল বিশ্বকাপের ফাইনালে দায়িত্ব পালনের পরই তিনি পুরুষ ফুটবলের দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠেন। সেই ম্যাচেই মূলত প্রথমবারের মতো মাঠে বিপুল সংখ্যক দর্শকের চাপ সামলানোর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেন।
‘স্টেডিয়ামে পা রাখার পর যখন দেখলাম দর্শকরা আমাদের (রেফারিদের) জন্য উল্লাস করছে, সেই অভিজ্ঞতা ছিল একটি বিশেষ অনুভূতি’— বলেন স্টেফানি।
‘এমন কিছু আমি কখনোই দেখিনি। তাও আবার এমন বড় মাপের একটি ম্যাচে। ওয়ার্ম আপের সময় তাদের চিৎকার দেখে আমি এদিকে সেদিকে তাকাই আর দেখি খেলোয়াড়দের কেউ তখনো মাঠে প্রবেশ করেনি। তাই বুঝে নেই যে, দর্শকরা আসলে আমাদেরকেই উৎসাহ দিচ্ছে।
ভীড়ের দিকে তখন তাকাই… সাধারণত আমি এমনটা করি না… কিন্তু সেদিন দেখি তারা আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে, কেউ কেউ হাত নাড়ছে এবং অভিনন্দন জানাচ্ছে। আমার কাছে এগুলো বিশেষ কিছু।’
২০১৯ সালে প্রথমবারের মতো আলোচনায় আসেন স্টেফানি ফ্র্যাপার্ট। বলা যায়, ফ্রান্সে অনুষ্ঠেয় নারী ফুটবল বিশ্বকাপে যুক্তরাষ্ট্র ও নেদারল্যান্ডসের ম্যাচের দায়িত্ব পাওয়ার পর তিনি নারী রেফারিদের মধ্যে সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছান। যেকোনো রেফারিরই স্বপ্ন থাকে বিশ্বকাপ ফুটবলের ফাইনাল ম্যাচে দায়িত্ব পালনের।
আর লীগ পর্যায়ে ইউরোপের সেরা প্রতিযোগিতাগুলোতে আসার আগে ফ্র্যাপার্টের হাতেখড়ি হয় ফ্রেন্স লীগ ওয়ানে। গতবছর এপ্রিলে অনুষ্ঠেয় অ্যামিয়েন্স ও স্ট্র্যাসবুর্গের ম্যাচে প্রথম নারী রেফারি হিসেবে দেখা যায় তাকে।
এরপর অক্টোবরেই ইউরোপা লীগে লেচেস্টার সিটির মাঠে ইউক্রেনিয়ান দল জরিয়া লুহানস্ক খেলতে আসলে সেটি রেফারি হিসেবে মাঠে ছিলেন ফ্র্যাপার্ট।
১৯. লুইজ গ্লাক
৭৭ বছর বয়সী মার্কিন কবি লুইজ গ্লাক জিতে নিয়েছেন এ বছরের সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার। এর মাধ্যমে লুইজ গ্লাকের হাত ধরে ২৭ বছর পর সাহিত্যের নোবেল যুক্তরাষ্ট্রের। এর আগে ১৯৯৩ সালে টনি মরিসন জিতেছিলেন এই সম্মানিত পুরষ্কার।
গত ৮ অক্টোবর বিকেলে নোবেল কমিটির পক্ষ থেকে এ বছরের সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী হিসেবে গ্লাকের নাম ঘোষণা করা হয়। পুরষ্কার জেতার ঘোষণায় নোবেল কমিটি বলে, ‘অভ্রান্ত কাব্যিক কণ্ঠস্বর’ যা ‘পরম সৌন্দর্যে’র সঙ্গে মিলিত হয়ে ‘ব্যক্তির অস্তিত্বকে সার্বজনীনতা’র মাত্রা দেয়— এমন কাব্যগুণের কারণেই নোবেল জিতে নিয়েছেন গ্লাক। ষষ্ঠদশ নারী সাহিত্যিক হিসেবে নোবেল জিতলেন তিনি।
গ্লাক দীর্ঘদিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্রের সাহিত্য জগতের পুরোধা এক ব্যক্তিত্বের স্থান নিয়ে আছেন। শৈশব আর পারিবারিক আবহ ঘুরে ফিরে এসেছে তার কবিতায়। গ্রিক ও রোমান মিথলজির বিভিন্ন উপাদান নিয়েও ভাঙাগড়ার কাজ তার কবিতায় স্পষ্ট হয়ে এসেছে। ন্যাশনাল বুক ওয়ার্ড ছাড়াও পুলিৎজার পুরস্কারও রয়েছে গ্লাকের ঝুলিতে।
লুইজ গ্লাকের কাব্যকে ‘অকপট ও আপসহীন’ বলে আখ্যা দিয়েছেন নোবেল পুরষ্কার কমিটির চেয়ার অ্যান্ডারস অলসন। তিনি বলছেন, তার কবিতাগুলো একইসঙ্গে ‘রসবোধে পরিপূর্ণ এবং বুদ্ধিদীপ্ত’। ‘ফেইথফুল অ্যান্ড ভার্চুয়াস নাইট’ থেকে শুরু করে ‘দ্য ওয়াইল্ড আইরিস’সহ গ্লাকের ১২টি কাব্যগ্রন্থের প্রতিটিই ‘স্পষ্টতা অর্জনের নিরন্তর লড়াই’য়ে নিমগ্ন। যেকোনো মতবাদে সহজেই আস্থা স্থাপন না করার বৈশিষ্ট্যের জন্য গ্লাককে এমিলি ডিকিনসনের সঙ্গেও তুলনা করেছেন অলসন।
গ্লাকের বিশাল কাব্যভাণ্ডারের মধ্যে পুলিৎজার বিজয়ী ‘দ্য ওয়াল্ড আইরিস’ কাব্যগ্রন্থ থেকে ‘স্নোড্রপ’ কবিতাটি উদ্ধৃত করেছে নোবেল কমিটি। শীতের শুষ্কতা-রুক্ষতা শেষে যেমন প্রকৃতি প্রাণ ফিরে পায়, সেই স্মৃতির বন্দনা গ্লাক এই কবিতায় করেছেন।
কানেক্টিকাটের ইয়েল ইউনিভার্সিটির ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক গ্লাক। ১৯৬৮ সালে প্রকাশ পায় তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ফার্স্টবর্ন’। এরপর দু’হাত ভরে লিখে গেছেন। ১২টি কাব্যগ্রন্থের পাশাপাশি কাব্য সংকলনও রয়েছে তার। এর মধ্যে ‘অ্যাভারনো’ সংকলটিতে উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে রেখেছে গ্রিক মিথোলজির দুই চরিত্র পারসিফোনি আর হেডিস।
২০. গ্যাল গ্যাডট
বিশ্বের আলোচিত ব্যক্তির তালিকা আসলে বিনোদন জগতকে বাদ দেওয়ার উপায় নাই। সারাবিশ্বের মানুষকে শুধু বিনোদন দেওয়াই নয়, মানুষের চিন্তা-ভাবনার জগতকে নাড়া দিয়ে যায় বিনোদনের নানা মাধ্যম। এর মধ্যে অবশ্যই সর্বাগ্রে আসবে সিনেমার নাম। চলতি বছর করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে দেশে দেশে লক ডাউন চলার ফলে সবকিছুর মত বন্ধ হয়ে যায় সিনেমা হল ও থিয়েটার। ওটিটি প্লাটফর্মে অনেক চলচ্চিত্র ও সিরিজ মুক্তি পেলেও বড়পর্দায় সিনেমা মুক্তি পাওয়া না পাওয়া নিয়ে আশংকা যেন কাটছিল না কিছুতেই।
বছর শেষে পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসায় টুকটাক করে চলচ্চিত্র মুক্তি পেতে শুরু করেছে বিশ্বের নানা প্রান্তে। তবে সারা বিশ্বের প্রায় সব ভাষাভাষি মানুষই তাকিয়ে থাকে হলিউডের ছবি মুক্তির দিকে। বছর শেষের চমক হিসেবে সুপার হিরো মুভি ওয়ান্ডার উওম্যান সিরিজের দ্বিতীয় চলচ্চিত ‘ওয়ান্ডার উওম্যান ১৯৮৪’ মুক্তি পেয়েছে। আর ওয়ান্ডার উওম্যান বলতেই চোখে ভাসে ইসরাইলি অভিনেত্রী গ্যাল গ্যাডটের চেহারা। তাই বছরের শেষ মুহুর্তে আলোচনায় তিনি।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে অনলাইনের মাধ্যমে চলচ্চিত্রের প্রচারণায় ব্যস্ত সময় পার করছেন তিনি। নারীদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পালটে দেওয়া এই চলচ্চিত্রের প্রথম কিস্তি মুক্তি পায় ২০১৭ সালে। তিনবছর ধরেই চলছিল তাই দ্বিতীয় পর্বের অপেক্ষা। ভক্তদের সেই অপেক্ষার প্রহর অবশেষে ফুরিয়েছে বছরের শেষ মুহুর্তে এসে।
অ্যাঙ্গেলা মেরকেল উরসুলা ভন ডার লেন কমলা হ্যারিস ক্রিস্টাইন লাগারদে গ্যাল গ্যাডট জেসিন্ডা আর্ডেন লালে ওসমানী লুইজ গ্লাস সান্না মারিন স্টেফানি ফ্র্যাপার্ট