গাড়িতে ঠাই পাওয়া সেরেনা কে ফ্লেইটস।। পর্ব ২
৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ১৪:১০
প্রথম পর্বের পর (পর্নহাবের কন্যারা)
২)
ক্যালিফোর্নিয়ার বেকারসফিল্ডের ১৪ বছরের ছাত্রী সেরেনা কে ফ্লেইটস কখনো কোন ছেলের সঙ্গে মেশেনি। অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় এক বছরের বড় এক ছেলের উপর ক্রাশ তৈরি হয় (ভালো লাগে)। ছেলেটি সেরানাকে একটি নগ্ন ভিডিও পাঠাতে বলে। ক্রাশের এমন প্রস্তাবে মেয়েটি না করার কথা ভাবেনি এবং নিজের একটি ভিডিও তাকে পাঠায়।
এরপর ছেলেটি আরও কিছু ভিডিও চায় এবং মেয়েটিও দেয়। মনে মনে কিছুটা ভয় থাকলেও ছেলেটির কথায় মুগ্ধতাও ছিল। কিন্তু এই ভিডিও পাঠানোই তার কাল হয়ে দাঁড়ায়। পুরোপুরি বদলে যায় সেরেনার জীবন। তার এখনও মনে আছে, সেসময়ে সে স্কুলে গেলে সবাই কেমন অদ্ভুতভাবে তাকাতো তার দিকে। আসলে ছেলেটি সেই ভিডিওগুলো অন্য ছেলেদেরকেও দেখায় এবং কেউ একজন সেগুলো পর্নহাবে আপলোড দেয়। ফলে পুরো স্কুলই দেখে ফেলে তার নগ্ন শরীরের ভিডিও।
ফ্লেইটসের পৃথিবী যেন তারপর হঠাৎই পালটে গেল। ১৪ বছর বয়সের একজন কিশোর বা কিশোরীর জন্য যেমন সহপাঠীর নগ্ন দেহ দেখে নিজেকে বিনোদিত করা থেকে আটকে রাখা দূরহ, তেমনি এটি দেখার পর তাকে ‘বেশ্যা’ বলে ধিক্কার না জানানোটাও অসম্ভব বলতে গেলে। সেরেনা আমাকে বলে, ‘সেসময় মানুষ আমাকে টেক্সট মেসেজ করে বলতো যদি আমি তাদের আমার নগ্ন দেহের ভিডিও না পাঠাই তাহলে তারা আমার ভিডিওগুলো আমার মায়ের কাছে পাঠিয়ে দেবে’।
ছেলেটিকে যদিও স্কুল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিলো কিন্তু ফ্লেইটসের আর স্কুলে যাওয়া হয় না। এই লজ্জা সে আর কোনভাবেই নিতে পারছিলো না। তার মা পর্নহাবে যোগাযোগ করে ভিডিওটি মুছে দেওয়ার জন্য এবং ফ্লেইটসের স্কুল বদলে দেন। কিন্তু একাধিক স্কুল বদলালেও কোন লাভ হয় না। এই গল্পগুলো নতুন সব স্কুলেও ছড়িয়ে যায় আর পর্নহাবসহ অন্য ওয়েবসাইটেও ভিডিওগুলো কেউ না কেউ পুনরায় ছড়িয়ে দিতে থাকে।
ফ্লেইটসের মায়ের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে আর নিজেকে কাটাকুটি করে কষ্ট দিতে থাকে৷ তারপর একদিন মেডিসিন ক্যাবিনেটে গিয়ে যতগুলো বিষন্নতা রোধের ওষুধ পায়, তার সবগুলোই একসঙ্গে খেয়ে ফেলে। তিনদিন পর হাসপাতালে জ্ঞান ফেরার পর বেঁচে আছে দেখে খুবই বিরক্ত হয়৷
এরপর আরেকদিন সে বাথরুমে গলায় ফাঁস নেয়। তার ছোটবোন সেটা দেখে ফেলে সেযাত্রাও চিকিৎসকরা তাকে আবারও সুস্থ করে তোলেন। ফ্লেইটস যখন এভাবে ক্রমাগত পতনের দিকে ধাবিত হচ্ছিলো তখন তার এক বন্ধু তাকে ম্যাত এবং অপিওড নামক মাদকের সঙ্গে পরিচয় করায়। দ্রুতই এগুলোতে আসক্ত হয়ে পড়ে। সে স্কুল ছেড়ে দেয় এবং গৃহহীন হয়ে পড়ে।
১৬ বছর বয়েসে সে ক্রেগলিস্টে বিজ্ঞাপন দিয়ে নিজের নগ্ন ছবি এবং ভিডিও বিক্রি করা শুরু করেছিলো। এটা তার জন্য ছিল অর্থ উপার্জনের মাধ্যম এবং সম্ভবত নিজেকে শাস্তি দেওয়ারও একটা উপায়। ফ্লেইটস আমাকে জানায়, সে তখন ভেবেছিল সে আর কোনও কিছুরই যোগ্য নয় যেহেতু সবাই তার নগ্নদেহ দেখে ফেলেছে। তাই এভাবেই সে জীবনধারণের পথ খুঁজে নেয়।
এই ভিডিওগুলিও পর্নহাবে পৌঁছে যায়। ফ্লেইটস তাদের কাছে ভিডিওগুলো অপসারণের জন্য অনুরোধ করলে তারা সেগুলো সরিয়ে ফেলে। কিন্তু আবারও কেউ না কেউ এসব ভিডিও আপলোড দিতে থাকে। তার ১৪ বছরের একটি নগ্ন ভিডিও চার লাখ বারের বেশি দেখা হয়েছে। সেরেনা আমাকে জানায়, যদি কেউ তাকে চিনে ফেলে সেই ভয়ে সে ফাস্টফুডের চাকরির জন্যও আবেদন করতে ভয় পায়।
পর্নহাবের কন্যারা।। পর্ব-১
এই মুহুর্তে ১৯ বছরের ফ্লেইটস একবছর হয় মাদকের দুনিয়া থেকে দূরে। চাকরিহীন বেকার এবং ট্রমার মধ্যে জীবনযাপন করছে। কোন বাড়ি নয়, তার বসবাস ছোট্ট একটি গাড়ির ভেতর আর তাকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য রয়েছে তিনটি কুকুর। ফ্লেইটসের মতে কুকুর মানুষ থেকে অনেক বেশি বিশ্বস্ত এবং স্বার্থ ছাড়াই ভালবাসার প্রমাণ রেখেছে তার কাছে। ফ্লেইটস একজন পশু চিকিৎসক হতে চায় কিন্তু জানে না কীভাবে কি করতে হবে। সে বলছিলো ‘একটা ছোট গাড়িতে তিনটি কুকুরের সাথে বাস করা একজন মানুষের জন্য স্কুলে যাওয়াটা খুবই কঠিন।’
অষ্টম শ্রেণিতে পড়ুয়া ১৪ বছরের ফ্লেইটসকে আজকের প্রাপ্তবয়স্ক ফ্লেইটস বোকা মনে করে। সেই বয়সে তার একটুও মনে হয়নি যে তার এই ভিডিওগুলো অনলাইনে ছড়িয়ে পড়তে পারে। আসলে যেকোন কিশোরীই এমন কাজ করতে পারে। কিন্তু এটা অদ্ভুত যে এই ছোট কাজটাই পরে কত বড় হয়ে যায়! একটা পুরো জীবন পুরোপুরি বদলে যেতে পারে শুধুমাত্র এইরকম এক সামান্য ভুলের কারণে।
৩)
এই সমস্যাটা শুধুমাত্র পর্নহাবেই সীমাবদ্ধ নয়, এটি আরও বড়। এমনকি পর্নহাবের প্রতিদ্বন্দ্বী এক্সভিডিওজ যারা কিনা পর্নহাবের চেয়ে কিছুটা ছোট তারাও শিশু নির্যাতনের ভিডিও দিয়ে মানুষকে আকর্ষিত করে। আর ফেসবুক, টুইটার, রেডিটের মত মূলধারার সাইটে এগুলো প্রকাশিত হয়। এমনকি গুগলও সেসব কোম্পানিকে সমর্থন করে যাচ্ছে যারা কিনা শিশু নির্যাতনের উপর ভিত্তি করে টিকে আছে।
গুগলে ‘ইয়াং পর্ন’ লিখে খুঁজলে অন্তত ৯২০ মিলিয়ন ভিডিও সামনে আসবে। এসব ভিডিওর উপরের সারিতেই রয়েছে এক্সভিডিওজের ‘ভেরি ইয়াঙ টিন’ নামের এক নগ্ন ভিডিও যে কিনা পরবর্তীতে যৌন ক্রিয়ায় লিপ্ত হয়। এমনকি পর্নহাবেরও অনেকটা একই নামের আরেক ভিডিও রয়েছে।
আমি হারিয়ে যাওয়া এবং শোষিত শিশুদের নিয়ে কাজ করা জাতীয় সংস্থার কাছে প্রতিবছর তাদের হাতে আসা শিশু যৌন নির্যাতনের ছবি, ভিডিও বা এ সম্পর্কিত অভিযোগের প্রতিবেদন চেয়েছিলাম। সেই রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১৫ সালে তারা ছবি এবং ভিডিও সম্পর্কিত অভিযোগ পায় ৬৫ লাখ। ২০১৭ সালে যা বেড়ে দাঁড়ায় ২ কোটি ৬ লাখ। এবং মিলিয়ন এবং ২০১৯ সালে ৬ কোটি ৯২ লাখ।
ফেসবুক এবছরের তিন মাসের মধ্যে ১ কোটি ২৪ লাখ ছবি তাদের সাইট থেকে মুছে দিয়েছে যা ছিল শিশুদের যৌন নির্যাতন সম্পর্কিত। টুইটার গত বছরের প্রথম ছয় মাসে ২ লাখ ৬৪ হাজার একাউন্ট বন্ধ করে দিয়েছে যারা শিশু যৌন নির্যাতনের সাথে কোন না কোনভাবে জড়িত ছিল। অন্যদিকে পর্নহাব জানায়, ‘ইন্টারনেট ওয়চ ফাউন্ডেশন’ নামের লন্ডনভিত্তিক একটি অলাভজনক দাতব্য সংস্থা যারা কিনা শিশু যৌন নির্যাতনের বিরুদ্ধে কাজ করে তারা পর্নহাবের কাছে গত তিন বছরে মাত্র ১১৮ টি ভিডিওর বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছে। কোটি কোটি ভিডিওর তুলনায় এটি নিতান্তই তুচ্ছ একটি সংখ্যা। পর্নহাব তাদের বিবৃতিতে আরও বলে, ‘আধুনিক কনটেন্ট ভিত্তিক প্লাটফর্মে সবধরনের অবৈধ বিষয়বস্তু নির্মূল করার বর্তমান চলমান যুদ্ধে তারা সবসময়ই সামনের সারির একজন’।
পর্নহাবের বিরুদ্ধে অভিযোগ এত কম কেন সেটার প্রশ্নে ইন্টারনেট ওয়াচ ফাউন্ডেশন আশাজনক ব্যাখ্যা দিতে পারে নি। হয়তো কেউ সেটা নিয়ে ভালোভাবে দেখেশুনে তবে অভিযোগ করেনি। কিন্তু যদি তারা সত্যি সত্যি খুঁজতো এবং জানতো তারা কিসের অভিযোগ করবে তাহলে তারা হাজারের উপর বিষয়বস্তু পেত শুধুমাত্র ৩০ মিনিটেই যা শিশু নির্যাতনের সাথে জড়িত। সম্প্রতি পর্নহাব নতুন কিছু প্লেলিস্ট যুক্ত করেছে যাদের কিছু নাম হচ্ছে ‘less than 18’, ‘the best collection of young boys’ এবং ‘under- age.’
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস বা নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ক্রমেই ছড়াতে থাকা এই সমস্যাটি নিয়ে কিছুই করে নি। প্রযুক্তি সংস্থা যারা এগুলোকে সম্ভব করছে তারাও নিজেদের বাঁচাতে আত্মরক্ষামূলক অবস্থানে। কিন্তু ২০১৯ সালের শুরুর দিকে টাইমসের এক কলিগ তার রিপোর্টে বলেছিলো কংগ্রেস এই শিশু যৌন নিপিড়কদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে তা বন্ধের লক্ষ্যে কৌশল সাজাচ্ছে৷ কিন্তু তা এখনও আলোর মুখ দেখে নি।
তবে পর্নহাবের জন্যও নিশ্চিন্তে ব্যবসা করার উপায় হয়তো আর থাকছে না। ইতোমধ্যে পর্নহাব বন্ধের লক্ষে এক পিটিশনে ২১ লাখ লোকের স্বাক্ষর নেওয়া হয়েছে। নেব্রাস্কার রিপাবলিকানের সিনেটর বেন স্যসি বিচার বিভাগের কাছে পর্নহাবের বিরুদ্ধে তদন্তের আবেদনও জানিয়েছিলেন। পে প্যাল ইতোমধ্যেই কোম্পানিটির সঙ্গে নিজেদের সম্পর্ক চ্ছিন্ন করেছে। অন্যান্য ক্রেডিট কার্ড কোম্পানিকেও একই পদক্ষেপ নেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়েছে। লেয়লা ম্যাকক্লেওয়েট নামের এক অ্যাকটিভিস্ট তার সংস্থা ‘ট্রাফিকিং হাব’ এর মাধ্যমে নির্যাতনের প্রমাণসহ পর্নহাব বন্ধের ডাক দিয়েছে। কানাডা সংসদের ২০ জন সদস্য মন্ট্রিয়লে অবস্থিত পর্নহাবকে সেখান থেকে উচ্ছেদ করে দিতে কানাডা সরকারের কাছে আবেদন করেছে।
টেইলর নামের ১৮ বছরের এক মেয়ে আমাকে বলে, ‘তারা (পর্নহাব) আমার ব্যাথা এবং কষ্টকে পুঁজি করে অর্থ উপার্জন করছে’। সেরেনার মতো সেও ১৪ বছরের কিশোরী ছিলো যখন তার ছেলেবন্ধু তাদের ভালোবাসার সময়টুকু লুকিয়ে ভিডিও করে এবং যখন পুলিশ এটা বের করে ততদিনে ভিডিওটি পর্নহাবে পৌঁছেছে।’ চোখের পানি মুছতে মুছতে মেয়েটি বলে, ‘পরদিন আমি যখন স্কুলে যাই, সবাই নিজেদের ফোনের দিকে তাকাচ্ছিলো আর তারপর আমার দিকে কেমন কুৎসিতভাবে তাকাচ্ছিলো’। কাঁদতে কাঁদতে টেইলর বলেন, ‘তারা আমাকে দেখে হাসছিলো’।
টেইলর আমাকে বলেছে লজ্জায় এবং ঘৃণায় সে এপর্যন্ত দুইবার আত্মহত্যার চেষ্টা চালায়। এই লেখাটিতে যাদের নাম এসেছে তাদের সবার মতোই টেইলর তার গল্প বলতে এবং প্রমাণ হিসেবে তার গল্প লিখতে দিতে রাজি হয়েছে কারণ তার মনে হয়েছে এটা অন্য মেয়েদের ভবিষ্যতে এই ভুল না করতে সাহায্য করবে।
(প্রাপ্তবয়স্কদের বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম বিভিন্ন পর্নওয়েবসাইট। এগুলোর বিরুদ্ধে যৌন সহিংসতাকে উসকে দেওয়াসহ নানা অভিযোগ আছে। এমনই একটি ওয়েবসাইট পর্নহাব। সম্প্রতি পর্নহাবের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমনে কার্যকর উদ্যোগ না নিয়ে বরং একে উৎসাহ দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। পর্নহাব নিজে নারী বা শিশু নির্যাতনে অংশ নিচ্ছে তা নয়, কিন্তু এটি একটি মুক্ত প্লাটফর্ম হওয়ায় এখানে যেকোন ব্যবহারকারী ইচ্ছামতো ভিডিও আপলোড দিতে পারেন। আবার সেসব ভিডিও সহজেই ডাউনলোড দিয়ে ব্যক্তিগত সংগ্রহেও রাখা যায়।
এই সুযোগে অনেকেই শিশু, অপ্রাপ্তবয়স্ক ও অবৈধ উপায়ে সংগৃহীত ভিডিও আপলোড দেন পর্নহাবে। ভুক্তোভোগীরা অভিযোগ করে বা আইনের আশ্রয় নিলেও সঠিক বিচার পাচ্ছেন না। এবং আইনের ঘোরপ্যাঁচে শাস্তির আওতায় আসে না অন্যতম বড় এই পর্ন ওয়েবসাইট। শাস্তি তো দূরের কথা এসব ভিডিওর মাধ্যমে শত শত কোটি টাকা কামিয়ে নিচ্ছে তারা। এবিষয়েই সম্প্রতি নিউ ইয়র্ক টাইমসে নিকোলাস ক্রিস্টোফের মতামত কলাম ছাপা হয়েছে। সারাবাংলার জন্য সেটি অনুবাদ করেছেন রেহমান মোস্তাফিজ। চার পর্বের লেখাটি পড়তে সারাংলার সঙ্গেই থাকুন।)
সারাবাংলা/আরএফ