পর্নহাব বন্ধে কোন উদ্যোগ নাই নারীবাদী জাস্টিন ট্রুডোর।। পর্ব ৩
৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ১৭:৪৫
দ্বিতীয় পর্বের পর (পর্নহাবের কন্যারা)
৪)
পর্নহাবের মালিক মাইন্ডগিক নামক এক বেসরকারি পর্নগ্রাফ প্রতিষ্ঠান। মাইন্ডগিকের আন্ডারে প্রায় ১০০ টিরও বেশি পর্নগ্রাফিক ওয়েবসাইট, প্রযোজনা হাউজ এবং ব্র্যান্ড রয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানের অন্য সাইটগুলো হচ্ছে রে*টিউব, ই*পর্ন, এ*টিউব, স্প্যান*ওয়্যার, এক্সট্রি* টিউব, ম্যা* ডট কম, মাই ডা* হবি, থাম্ব*লা, পর্ন *ডি, ব্রে**র্স এবং গে *উব। মাইন্ডগিকের ছত্রছায়ায় থাকা ওয়েবসাইট ছাড়াও এই খেলায় আরও বড় খেলোয়াড় আছে যেমন জ্যামস্টার এবং এক্সভিডিওজ। কিন্তু মাইন্ডগিক হচ্ছে পর্ন দুনিয়ার দানব। এটা যদি পর্ন ইন্ডাস্ট্রির না হয়ে অন্য কোন শিল্প মাধ্যমের হতো তাহলে হয়তো বিচার বিভাগ তাদের প্রতি কঠোর হতো।
পর্নহাব এবং মাইন্ডগিকের প্রচুর প্রভাব। চলতি বছর একটি ডিজিটাল মার্কেটিং প্রতিষ্ঠান তাদের সমীক্ষায় বলে যে পর্নহাব একবিংশ শতাব্দীতে বিশ্বের প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে তৃতীয় বৃহৎ প্রতিষ্ঠান যাদের ব্যাপক সমাজিক প্রভাব। তালিকার উপরের দুই ওয়েবসাইট ফেসবুক এবং গুগল। জেনে অবাক হবেন যে, অ্যাপল, মাইক্রোসফট এবং অ্যামাজন পর্নহাবের ধারেকাছেও নাই।
মন্ট্রিয়াল থেকে পরিচালিত হলেও করের ক্ষেত্রে বেশি সুবিধা পাওয়ায় মাইন্ডগিক লুক্সেমবার্গে অবস্থিত। বেসরকারিভাবে পরিচালিত এই প্রতিষ্ঠানটির মালিক কে সেটি কখনও নির্দিষ্ট করে প্রকাশ না করলেও এটির দুই পরিচালক ফারান অ্যানটন এবং ডেভিড টোসিলো নামের দুই কানাডিয়ান। দুজনের কেউই কখনও গণমধ্যমে সাক্ষাৎকার দিতে অপরাগ।
এদিকে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো নিজেকে একজন নারীবাদী হিসেবে দাবি করেন। এমনকি তিনি এবং তার সরকার বিশ্বব্যাপি নারীর ক্ষমতায়নে অবদান রাখার জন্য গর্ববোধ করেন। এখন ট্রুডো এবং কানাডার জনগনের প্রতি প্রশ্ন কেন কানাডা এমন এক প্রতিষ্ঠানকে তাদের দেশে জায়গা দিয়েছে যারা কিনা বিশ্বব্যাপি ধর্ষণের ভিডিও ছড়ায়?
মাইন্ডগিকের মডারেটরকে বাচ্চাদের ভিডিও ফিল্টার করার জন্য দোষী করা হয় আবার এই প্রতিষ্ঠানটির ব্যাবসায়িক মডেলটি এমনভাবে তৈরি যাতে করে তারা তরুবণদের অভিনীত যৌন ভিডিও থেকে লাভবান হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মাইন্ডগিকের সাবেক এক কর্মকর্তা আমাকে বলে যে মাইন্ডগিকের মডারেটরদের যত বেশি সম্ভব ভিডিও আপলোডের লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া থাকে। ওই কর্মকর্তার বিশ্বাস উপরের সারির কর্মকর্তারা হয়তো খারাপ নয় কিন্তু তারা এসবের অনেক উর্দ্ধে। তাদের চিন্তাভাবনা জুড়ে থাকে শুধু লভ্যাংশ বাড়ানো।
আমাকে পর্নহাব হয়তো কখনোই বলবে না তাদের ঠিক কতজন মডারেটর রয়েছে। কিন্তু এক সাক্ষাৎকারে আমাকে একজন জানায় যে, পুরো বিশ্বব্যাপি ৮০ জন মডারেটর মাইন্ডগিকের সাইটে কাজ করে। (তুলনার স্বার্থে বলি ফেসবুক কর্তৃপক্ষ আমাকে জানিয়েছে যে তাদের ১৫ হাজার মডারেটর রয়েছে)। প্রতিবছর পর্নহাবে ১৩ লাখ ৬ হাজার মিলিয়ন ঘন্টার নতুন ভিডিও আপলোড করা হয়। যার মানে দাঁড়ায় প্রতি মডারেটরকে সপ্তাহে কয়েকশ ঘন্টার ভিডিও পর্যবেক্ষণ করতে হয়। আর তাই মডারেটরদের দ্রুত আগেপিছে যেতে হয়। তাই এক্ষেত্রে এটি নির্ণয় করা কঠিন যে, ভিডিওর চরিত্রর বয়স ১৪ নাকি ১৮, অথবা ভিডিওতে দেখানো নির্যাতনের দৃশ্যটি বাস্তব নাকি অভিনয়। বেশিরভাগ অপ্রাপ্তবয়স্ক কনটেন্টে কিশোর-কিশোরী জড়িত। আমি যে মডারেটরের সাথে কথা বলেছি সে বলেছিলো আবার অনেক ভিডিও থাকে যা স্পাই ক্যামেরা দিয়ে টয়েলেট বা চেঞ্জিং রুমে ধারণ করা হয়। তাই এসব ভিডিওতে অনেকসময় ৮ থেকে ১২ বছরের শিশুরাও থাকে।
গাড়িতে ঠাই পাওয়া সেরেনা কে ফ্লেইটস
মাইন্ডগিকের সাবেক সেই মডারেটর আমাকে আরও বলেছে, ‘এই চাকরিটা যে কোন ব্যক্তিরই আত্মাকে ধ্বংস করে দেয়।’
পর্নহাবের নাগরিক বা ফৌজদারি দায়বদ্ধতা না থাকার বিষয়টি দিনদিন উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে পর্নহাবের বিরুদ্ধে গুপ্তক্যামেরায় ভিডিও প্রকাশ হওয়ার অভিযোগ ওঠার পরে আইনজীবীরা তাদের চারপাশে ঘুরছে। নয় জন মেয়ে পর্নহাবের বিরুদ্ধে ফেডারেল আদালতে মামলাও করেছেন। ভিডিওগুলি দক্ষিণ ক্যারোলিনার লাইমস্টোন কলেজের একটি লকার রুমে ধারণ করা হয়েছিল যেখানে মেয়েদের গোসল করতে ও পোশাক পরিবর্তন করতে দেখা গেছে।
পর্নহাবের কার্যনির্বাহীরা অতীতে ধারণা করতো যে তারা কমিউনিকেশন ডিসেন্সি আইনের ২৩০ ধারার অধীনের সুযোগ সুবিধা উপভোগ করেছেন, যা ইন্টারনেট প্ল্যাটফর্মগুলোকে জনসাধারণের করা পোস্টের দায়বদ্ধতা থেকে সুরক্ষা দিত। তবে ২০১৮ সালে কংগ্রেস এই আইনের ধারা ২৩০-কে অনেকখানিই সীমাবদ্ধ করে দিয়েছে। যার ফলে এখন আর এই ধারাটি প্রতিষ্ঠানটিকে রক্ষার পক্ষে যথেষ্ট নয়, এবং মাইন্ডগিককে আরও দায়িত্বশীল হতে বাধ্য করেছে।
গত কয়েকবছরে প্রতিষ্ঠানটি মডারেটর সংখ্যা দ্বিগুণ করেছে। সাবেক সেই মডারেটর আমাকে জানিয়েছে, চলতি বছর থেকে পর্নহাব যে কোন অবৈধ বিষয়বস্তু তাদের সামনে পড়লে স্বেচ্ছায় তা National Center for Missing and Exploited Children নামক সংস্থার কাছে পৌঁছে দেবে এবং প্রয়োজনীয় অভিযোগ আনবে। আগে বাচ্চাদের ভিডিও মুছে দিতে বা অসংবেদনশীল ভিডিও সরিয়ে দিতে গা-ছাড়া ভাব দেখানো পর্নহাব এখন অতি দ্রুত কাজ করছে।
তারা নিষিদ্ধ সামগ্রীর একটি তালিকাও তৈরি করেছে। আমি এই তালিকার একটি অনুলিপি পেয়েছি এবং এটি ‘ধর্ষণ’, ‘প্রি-টিন’, ‘পেডোফিলিয়া, এবং ‘পশু’- এর মতো বিষয়গুলি বা ভিডিওগুলিকে নিষিদ্ধ করার পরিকল্পনা করেছে।
পর্নহাবের কন্যারা।। পর্ব-১
এখন তাই পর্নহাবে ইংরেজি ভাষাভাষীদের জন্য ‘অপ্রাপ্তবয়স্ক’ বা ‘ধর্ষণ’ লিখে সার্চ দিলে কোন কিছু পাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু পর্নহাব এধরণের ভিডিওগুলো বাতিল করার সেরকম কোন চেষ্টা এখনও করেছে বলে চোখে পড়েনি। ’13**boyteen’ নামের এক সদস্য এখনও এখানে ভিডিও পোস্ট করতে পারে। ‘r*pe’ লিখে খুঁজতে গেলে ১৯০১ টি ভিডিও সামনে আসে, ‘g**l wi** braces’ লিখে দিলে ১৯১৩ টি ভিডিও আসে এবং অতিরিক্ত সাজেশন হিসেবে ‘e***tra s*all t**ns’ আসে। ’13yo’ লিখে খুঁজতে গেলে ১ লাখ ৫৫ হাজার ভিডিও চলে আসে। বলে রাখি এদের অধিকাংশই ১৩ বছরের নয়, তবে এটা থেকে এটাই প্রতিষ্ঠিত হয় যায় যে পর্নহাবের সাইটে পেডোফাইলদের আকৃষ্ট করার প্রচেষ্টা এগুলো।
তবুও কিছু ভিডিও রয়েছে যা তাদের নিষিদ্ধ বিষগুলোর মধ্যে রয়েছে। ‘Runaway G**l Gets Ultimatum, A*al or the st*eets’ এটা পর্নহাবের একটা ভিডিওর শিরোনাম। অন্য আরেকজন একটি ভিডিও দিয়েছে যা ছিল একজন ‘কি*রির সাথে যৌনকর্ম’, যেখানে মেয়েটা কাঁদছিলো, বাধা দিচ্ছিলো এবং ব্যাথায় চিৎকার করছিলো।
যদিও পর্নহাব আইন জানা আমেরিকানদের জন্য সেদেশে অনেকটাই সতর্ক অবস্থান নিয়েছে কিন্তু বিদেশিদের প্রতি তাদের মনোভাব আগের মতই অবহেলিত রয়ে গেছে। একটি ইন্দোনেশিয়ান ভিডিওর শিরোনাম, ‘নিম্ন মাধ্যমিক স্কুলের মেয়ে ক্লাসের শেষে’ যেখানে দেখা যায় একজন কিশোরী যৌনকর্ম করছে। মাত্রই একটি চাইনিজ ভিডিও সরিয়ে নেওয়া হয়েছে যার শিরোনাম ছিলো, ‘হাইস্কুলের ছাত্রীকে তার সহপাঠি ধোকার মাধ্যমে ছাদে নিয়ে তাকে অপমান ও ধর্ষণ করে।’
জিলা ছদ্মনামের একজন কলাম্বিয়ান কিশোরী আমাকে বলে, ‘তারা আমার জীবনের সবচেয়ে খারাপ সময়ে আমার শরীর দিয়ে টাকা কামিয়ে নিয়েছে’,। যখন তার বয়স মাত্র ১৬ তখন দুজন আমেরিকান পুরুষ তার সঙ্গে টাকার বিনিময়ে যৌনকর্ম করে। তারা ভিডিও ধারণ করে এবং পরে সেটি পর্নহাবে ছড়িয়ে দেয়। সেও পর্নহাবের শিকার আরও কিছু নারীর মতো সেও আত্মহত্যার কথা ভেবেছে বা চেষ্টা করেছে বলে আমাকে জানায়।
শেষ কয়েকদিনে যখন আমি এই প্রবন্ধটি লিখছি তখনও দুটো নতুন ভিডিও প্রকাশ পেয়েছে যেখানে একজন মেয়েকে নির্যাতন করা হচ্ছে। আর অন্য আরেক ভিডিওতে একজন ১৫ বছরের কিশোরির সেক্স ভিডিও অনলাইনে ছড়িয়ে গেলে আত্মহত্যার চেষ্টা করছে। আমি ঠিক জানি না মাইন্ডগিকের মডারেটগুলো এখনও কেন এগুলো প্রকাশের বৈধতা দিয়ে যাচ্ছে।
ছবি- শাটারস্টক
(প্রাপ্তবয়স্কদের বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম বিভিন্ন পর্নওয়েবসাইট। এগুলোর বিরুদ্ধে যৌন সহিংসতাকে উসকে দেওয়াসহ নানা অভিযোগ আছে। এমনই একটি ওয়েবসাইট পর্নহাব। সম্প্রতি পর্নহাবের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমনে কার্যকর উদ্যোগ না নিয়ে বরং একে উৎসাহ দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। পর্নহাব নিজে নারী বা শিশু নির্যাতনে অংশ নিচ্ছে তা নয়, কিন্তু এটি একটি মুক্ত প্লাটফর্ম হওয়ায় এখানে যেকোন ব্যবহারকারী ইচ্ছামতো ভিডিও আপলোড দিতে পারেন। আবার সেসব ভিডিও সহজেই ডাউনলোড দিয়ে ব্যক্তিগত সংগ্রহেও রাখা যায়।
এই সুযোগে অনেকেই শিশু, অপ্রাপ্তবয়স্ক ও অবৈধ উপায়ে সংগৃহীত ভিডিও আপলোড দেন পর্নহাবে। ভুক্তোভোগীরা অভিযোগ করে বা আইনের আশ্রয় নিলেও সঠিক বিচার পাচ্ছেন না। এবং আইনের ঘোরপ্যাঁচে শাস্তির আওতায় আসে না অন্যতম বড় এই পর্ন ওয়েবসাইট। শাস্তি তো দূরের কথা এসব ভিডিওর মাধ্যমে শত শত কোটি টাকা কামিয়ে নিচ্ছে তারা। এবিষয়েই সম্প্রতি নিউ ইয়র্ক টাইমসে নিকোলাস ক্রিস্টোফের মতামত কলাম ছাপা হয়েছে। সারাবাংলার জন্য সেটি অনুবাদ করেছেন রেহমান মোস্তাফিজ। চার পর্বের লেখাটি পড়তে সারাংলার সঙ্গেই থাকুন।)
সারাবাংলা/আরএফ