বন্ধুত্বের বন্ধন আজীবন
৩১ জুলাই ২০২১ ২০:৫২
প্রতি বছর আগস্টের প্রথম রোববার সারা বিশ্বে ঘটা করে পালিত হয় বিশ্ব বন্ধু দিবস। অনেকে ফেসবুক, টুইটারে বন্ধুদের নিয়ে ছবি পোস্ট করেন। কেউ কেউ বন্ধুদের নিয়ে দু’চার লাইন স্মৃতিচারণ করে স্ট্যাটাস দেয়, কেউ কবিতা উৎসর্গ করে, কেউ উপদেশমূলক কথাবার্তা লেখে। মোবাইলে এসএমএস এর মাধ্যমে শুভেচ্ছাও জানান কেউ কেউ। বিভিন্ন জায়গায় দলবেধে ঘুরতে যাওয়া এবং পার্টিও হয়।
বন্ধু কী? এই প্রশ্নে প্রতিটি মানুষের ভিন্ন ভিন্ন অনুভূতি প্রকাশ করে। বন্ধুত্বের কথা জিজ্ঞেস করলে বেশিরভাগ মানুষই বাল্যকালের বন্ধুত্বের কথাই উল্লেখ করে থাকেন। কারণ সেই সময়ের বন্ধুত্বটা হয় নিছক বন্ধুত্বের জন্য—কোনো স্বার্থের মোহে নয়। খেলার সাথি থেকে শুরু করে বিপদে আপদে, সুখে দুঃখে, মাঠে ময়দানে, স্কুল কলেজের বারান্দায় সময় কাটিয়ে এমনকি জীবনের নানান বাঁকে বাঁকে পরিচয় হওয়া মানুষের সঙ্গে হয় বন্ধুত্ব। তবুও সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে বাল্যকালের খেলার সাথিদেরই। মনের অজান্তেই সেই বন্ধুত্ব তৈরি হয় চোখের অন্তরাল হলেও মনের ফ্রেমে, কল্পনায় উজ্জ্বল হয়ে জ্বলতে থাকে সেই স্মৃতিময় দিনগুলো।
যারা বন্ধুত্বের সংজ্ঞা বাক্যে সাজিয়ে বলতে পারে না, কিন্তু বন্ধুত্ব কী সেটা অনুভব করে, তাদের কাছে বন্ধুত্বের মর্মটা অনেক বেশি। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নানা বাস্তবতার কারণে মানুষের মাঝে দূরত্ব তৈরি হয়। কিন্তু মনের কোণে লুকিয়ে থেকে যায় সেই সুপ্ত প্রীতি ভালোবাসা। জীবনের শেষ প্রান্তে এসেও ভুলা যায় না সেই সম্পর্ক। এমনও হয়— বন্ধুর কবরের পাশে দাড়িয়ে স্মৃতি স্মরণ করে ব্যাকুলভাবে হুহু করে কেঁদে উঠে। এই বন্ধন আজীবনের। বন্ধুত্বের মধ্যে সেটাই উৎকৃষ্ট বন্ধুত্ব।
এরিস্টটলের ভাষায়, প্রত্যেক নতুন জিনিসকেই উৎকৃষ্ট মনে হয়। কিন্তু বন্ধুত্ব যতই পুরাতন হয় ততই উৎকৃষ্ট ও দৃঢ় হয়। বন্ধু শব্দটি অতি ছোট কিন্তু তার তাৎপর্য কোনো সংজ্ঞা দিয়ে বর্ণনা বা পাল্লা দিয়ে পরিমাপ করা যায় না। যা সাগরের মতো গভীর ও আকাশের মতো বিশাল।
মা বাবা ভাই বোন ও আত্মীয় যারা আছেন বন্ধু তাদের চাইতেও একটি ভিন্ন অনুভূতির। অনেক বিষয় আছে যা পিতামাতা কিংবা আত্মীয়দের নির্দ্বিধায় বলা যায় না। কিন্তু এই অব্যক্ত কথাগুলো বন্ধুর কাছে বলা যায়। নিজের দুঃখ কষ্টের এমনকি বিশেষ সময়ের কথাগুলোও শেয়ার করা যায় সেই বিশেষ মানুষের সঙ্গে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়, গোলাপ যেমন একটি বিশেষ জাতের ফুল; বন্ধু তেমনি একটি বিশেষ জাতের মানুষ।
বন্ধুত্ব হবে এমন সম্পর্ক, যে হাসিমুখে সুখে দুঃখে পাশে থাকে। শুধু যেন সুসম্পর্কের বন্ধু না হয়। বিপদে ছেড়ে পালিয়ে না যায়। দুর্বলতা কাজে লাগিয়ে ফায়দা হাসিল না করে। শুধুমাত্র স্বার্থের জন্য বন্ধুত্ব না করে। বন্ধু যেন সফলতার মাপকাঠি দিয়ে যাচাই না করে। পৃথিবীর সবাই যখন নিজ স্বার্থ হাসিল করে ছুড়ে ফেলে দেবে বন্ধু পিঠে হাত রেখে বলবে আমি আছি তো। বন্ধু গুরুত্বহীন, নিরর্থক ও নিষ্প্রয়োজনয় কথাগুলো শুনবে ব্যর্থতাকে ঝেড়ে ফেলে সামনে এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা যোগাবে।
বন্ধুত্ব রক্ষার জন্য সন্দেহ সংশয় ভুল বুঝাবুঝি দূর করতে হবে। সম্পর্ককে আঘাত করে কখনই বাজে মন্তব্য করা যাবে না। ছাড় দেওয়ার মানসিকতা নিয়ে যে কোনো ঝামেলা না বাড়িয়ে দ্রুত মিটিয়ে ফেলতে হবে। শুধু লাভের মানসিকতা ছেড়ে ত্যাগ ও ত্রাতার ভূমিকা পালন করতে হবে।
কথায় আছে— সৎ সঙ্গ স্বর্গ বাস, অসৎ সঙ্গ সর্বনাশ। এক বন্ধুর চারিত্রিক প্রভাব অন্য বন্ধুর উপর অবশ্যই পড়ে। তাই বন্ধু নির্বাচনে অবশ্যই সেই দিকে খেয়াল রাখতে হবে। তার সম্পর্কে অভিভাবকদের অবশ্যই অবহিত করতে হবে। তার পরিবার সম্পর্কেও সুস্পষ্ট ধারণা রাখতে হবে। এজন্য সক্রেটিস বলেছেন, বন্ধুত্ব গড়তে ধীর গতি হও। কিন্তু বন্ধুত্ব হয়ে গেলে প্রতিনিয়ত তার পরিচর্যা কর।
ছোট কিংবা বড় যে কোনো বয়সের মানুষের সঙ্গেই বন্ধুত্ব হতে পারে। মানুষ ছাড়াও জীবজন্তু, গাছপালা ও অন্যান্য বস্তুর সঙ্গে বন্ধুত্ব হতে পারে। বন্ধুত্ব জাত, প্রথা, ধর্ম ও বর্ণের ঊর্ধ্বে। একটি বন্ধুত্বে হাত বহু অজানা ভয়কে দূর করে দেয়। বিপদে ভয়কে জয় করে অসাধ্য সাধনের সাহস যোগায়।
আজকাল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে যে কেউ বন্ধু সেজে ছদ্মবেশে অনেক ক্ষতি সাধন করে থাকে। এ বিষয়ে সজাগ দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন। সামান্য বিষয় নিয়ে বন্ধুর সঙ্গে বন্ধুর মনোমালিন্য হয়, সম্মান ও সম্পদ হারানো এমনকি খুন পর্যন্ত হয়ে থাকে। খারাপ বন্ধুর প্রভাবে অনেকে অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। মাদক সেবন, ইভটিজিং, কিশোর গ্যাংসহ নানাবিধ অসামাজিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়।
এবার বন্ধু দিবসে আপনি আপনার অন্তরঙ্গ বন্ধুর সঙ্গে সম্পর্ক আরও জোরদার করুন। হারিয়ে যাওয়া বন্ধুকে খুঁজে বের করতে পারেন। অনেক কাছের বন্ধু আছে যার সঙ্গে আপনার দীর্ঘ দিন যোগাযোগ হয় না, তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। কারো সঙ্গে ভুল বুঝাবুঝি থাকলে তা মিটিয়ে নিতে পারেন। বিভিন্ন উপহার পাঠাতে পারেন। কয়েকজন বন্ধু মিলে বিভিন্ন সামাজিক উন্নয়নমূলক কাজে অংশ নিতে পারেন। রক্ত দিয়ে কারো জীবন বাঁচাতে পারেন। পরিবেশ রক্ষায়, এমনকি সামাজিক অপরাধ নিরসনে কাজ করতে পারেন।
লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; পরিচালক, বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ ফাউন্ডেশন
সারাবাংলা/আইই