ঢাকা জেলে ৩ নভেম্বর রাতে কী ঘটেছিল?
২ নভেম্বর ২০২২ ২১:০০
জেলখানার ভেতর ৪৭ বছর আগে বঙ্গবন্ধুর এই চার সহযোদ্ধাকে হত্যা করা হয়েছিল। সেই রাতের বর্ণনা পাওয়া যায় তৎকালীন আইজি প্রিজন’স এন নুরুজ্জামান ও ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে কর্তব্যরত ডিআইজি প্রিজনস কাজী আবদুল আউয়ালের প্রতিবেদন থেকে। ১৯৭৫ সালের ৫ নভেম্বর তারা এই প্রতিবেদন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন সচিবের কাছে জমা দিয়েছিলেন।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৫ আগস্টের পর জাতীয় চার নেতাসহ আরও অনেক রাজনৈতিক নেতাকে আটক করে কেন্দ্রীয় কারাগারের রাখা হয়েছিল। নিউ জেলের পাশাপাশি তিনটি কক্ষে তাদের রাখা হয়। ১ নম্বর কক্ষে ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দীন আহমদসহ আটজন বন্দী। ২ নম্বর কক্ষে ছিলেন এ এইচ কামারুজ্জামানসহ ১৩ জন। ৩ নম্বর কক্ষে ছিলেন এম মনসুর আলীসহ ২৬ জন। সেই রাতে ১ নম্বর কক্ষে সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দীন আহমদকে রেখে বাকি ছয়জন বন্দীকে অন্য রুমে নিয়ে যাওয়া হয়।
আর ২ নম্বর কক্ষে থেকে এ এইচ কামারুজ্জামান ও ৩ নম্বর কক্ষ থেকে এম মনসুর আলীকে ১ নম্বর কক্ষে নেওয়া হয়। এই কক্ষেই তাদের চারজনকে ৩ নভেম্বর রাতের শেষ প্রহরে (মূলত ২ নভেম্বর দিবাগত রাত ৪টা থেকে ৪:৩৫ টা) একসঙ্গে হত্যা করা হয়।
প্রতিবেদনে ঘটনার বর্ণনায় তখনকার আইজি প্রিজন’স এন নুরুজ্জামান উল্লেখ করেন, “… মেজর রশিদ আবার ফোন করে আমাকে জানান, কিছুক্ষণের মধ্যেই জনৈক ক্যাপ্টেন মোসলেম জেলগেটে যেতে পারেন। তিনি আমাকে কিছু বলবেন। তাকে যেন জেল অফিসে নেওয়া হয় এবং ১. জনাব তাজউদ্দীন আহমদ ২. জনাব মনসুর আলী ৩. জনাব সৈয়দ নজরুল ইসলাম ৪. জনাব কামারুজ্জামান-এই ৪ জন বন্দীকে যেন তাকে দেখানো হয়।”
“এ খবর শুনে আমি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা বলতে চাই এবং টেলিফোন প্রেসিডেন্টকে দেওয়া হয়। আমি কিছু বলার আগেই প্রেসিডেন্ট জানতে চান, আমি পরিষ্কারভাবে মেজর রশিদের নির্দেশ বুঝতে পেরেছি কি না। আমি ইতিবাচক জবাব দিলে তিনি আমাকে তা পালন করার আদেশ দেন। কয়েক মিনিটের মধ্যেই ৪জন সেনাসদস্যসহ কালো পোশাক পরা ক্যাপ্টেন মোসলেম জেলগেটে পৌঁছান। ডিআইজি প্রিজনের অফিসকক্ষে ঢুকেই তিনি আমাদের বলেন, পূর্বোল্লিখিত বন্দীদের যেখানে রাখা হয়েছে সেখানে তাকে নিয়ে যেতে। আমি তাকে বলি, বঙ্গভবনের নির্দেশ অনুযায়ী তিনি আমাকে কিছু বলবেন। উত্তরে তিনি জানান, তিনি তাদের গুলি করবেন। এ ধরনের প্রস্তাবে আমরা সবাই বিমূঢ় হয়ে যাই। আমি নিজে এবং ডিআইজি প্রিজন’স ফোনে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করি, কিন্তু ব্যর্থ হই। সে সময় জেলারের ফোনে বঙ্গভবন থেকে মেজর রশিদের আরেকটি কল আসে। আমি ফোনটি ধরলে মেজর রশিদ জানতে চান, ক্যাপ্টেন মোসলেম সেখানে পৌঁছেছেন কিনা। আমি ইতিবাচক জবাব দিই এবং তাকে বলি, কী ঘটছে আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। তখন মেজর রশিদ আমাকে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা বলতে বলেন। আমি প্রেসিডেন্টকে ক্যাপ্টেনের বন্দীদের গুলি করার ইচ্ছার কথা জানাই। প্রেসিডেন্ট জবাব দেন, সে যা বলছে তাই হবে। তখন আমরা আরও উত্তেজিত হয়ে যাই। ক্যাপ্টেন মোসলেম বন্দুকের মুখে আমাকে, ডিআইজি প্রিজন, জেলার ও সে সময় উপস্থিত অন্যান্য কর্মকর্তাদের সেখানে যাওয়ার নির্দেশ দেন, যেখানে উপরোল্লিখিত বন্দীদের রাখা হয়েছে। ক্যাপ্টেন ও তার বাহিনীকে তখন উন্মাদের মতো লাগছিল এবং আমাদের কারও তাদের নির্দেশ অমান্য করার উপায় ছিল না।”
প্রতিবেদনে সাবেক আইজি প্রিজন’স এন নুরুজ্জামান আরও উল্লেখ করেন, “তার নির্দেশ অনুযায়ী পূর্বোল্লিখিত ৪ জনকে অন্যদের কাছ থেকে আলাদা করা হয় এবং একটি রুমে আনা হয়, সেখানে জেলার তাদের শনাক্ত করেন। ক্যাপ্টেন মোসলেম এবং তার বাহিনী তখন বন্দীদের গুলি করে হত্যা করে। কিছুক্ষণ পর নায়েক এ আলীর নেতৃত্বে আরেকটি সেনাদল সবাই মারা গেছে কিনা তা নিশ্চিত হতে জেলে আসে। তারা সরাসরি সেই ওয়ার্ডে চলে যায় এবং পুনরায় তাদের মৃতদেহে বেয়নেট চার্জ করে।” (সূত্র: সিমিন হোসেন রিমি; আমার ছোটবেলা, ১৯৭১ এবং বাবা তাজউদ্দীন আহমদ, পৃষ্ঠা ১৯৫-২০০।)
নির্মম সেই হত্যাকাণ্ডের বিচার
জেলখানায় নৃশংস এই হত্যাযজ্ঞের পরদিন অর্থাৎ ৪ নভেম্বর তৎকালীন ডিআইজি প্রিজন’স কাজী আবদুল আউয়াল লালবাগ থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। মামলায় সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা মোসলেম উদ্দিনের নাম উল্লেখ করে বলা হয়, তার নেতৃত্বে চার-পাঁচজন সেনাসদস্য কারাগারে ঢুকে চার নেতাকে হত্যা করেন। গুলি করার পরে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়।
ঘটনার পরদিন মামলা করা হলেও এই মামলার তদন্ত থেমে ছিল ২১ বছর। এরপর থেমে থেমে চলে মামলার কার্যক্রম। ঘটনার ২৯ বছর পর ২০০৪ সালের ২০ অক্টোবর ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালত এই মামলার রায় ঘোষণা করেন। রায়ে তিন আসামি মোসলেম উদ্দিন, দফাদার মারফত আলী শাহ ও দফাদার মো. আবুল হাশেম মৃধাকে মৃত্যুদণ্ড এবং ১২ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
যাবজ্জীবন দণ্ডিত ১২ আসামি হলেন- লে. কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান, লে. কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, মেজর (অব.) বজলুল হুদা ও মেজর (অব.) এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ, কর্নেল (অব.) খন্দকার আবদুর রশিদ, লে. কর্নেল (অব.) শরিফুল হক ডালিম, কর্নেল (অব.) এম বি নূর চৌধুরী, লে. কর্নেল (অব.) এ এম রাশেদ চৌধুরী, মেজর (অব.) আহম্মদ শরিফুল হোসেন, ক্যাপ্টেন (অব.) আবদুল মাজেদ, ক্যাপ্টেন (অব.) কিশমত হাশেম, ক্যাপ্টেন (অব.) নাজমুল হোসেন আনসার।
২০০৮ সালে আসামিদের মৃত্যুদণ্ড অনুমোদনের জন্য রায়সহ মামলার নথিপত্র হাইকোর্টে আসে। এ ছাড়া কারাগারে থাকা যাবজ্জীবন দণ্ডিত চার আসামি সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, বজলুল হুদা ও এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ (ল্যান্সার) আপিল করেন। ২০০৮ সালের ২৮ আগস্ট হাইকোর্ট রায় দেন। রায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত তিন আসামির মধ্যে মোসলেম উদ্দিনের মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকে। মারফত আলী শাহ ও দফাদার আবুল হাশেম মৃধা মৃত্যুদণ্ড থেকে খালাস পান। আপিলকারী চার দণ্ডিত যাবজ্জীবন কারাদণ্ড থেকে খালাস পান। যাবজ্জীবন দণ্ডিত অপর আট আসামির যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বহাল থাকে।
অবশ্য সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, বজলুল হুদা ও এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ (ল্যান্সার) জেলহত্যায় অব্যাহতি পেলেও বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি তাদের ফাঁসি কার্যকর হয়। (দৈনিক জনকণ্ঠ, ২৮ জানুয়ারি ২০১০)
এদিকে জেলহত্যা মামলায় হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে পরে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করে। আপিল বিভাগ দফাদার মারফত আলী শাহ ও দফাদার মো. আবুল হাশেম মৃধাকে হাইকোর্টের খালাসের রায় বাতিল করে বিচারিক আদালতের দেওয়া মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন। ২০১৫ সালের ১ ডিসেম্বর আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। কিন্তু ১১ আসামির কাউকে এখনও সাজার আওতায় আনা যায়নি। আসামিদের সবার অবস্থান সম্পর্কেও নিশ্চিত তথ্য পাওয়া যায়নি।
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি