ন্যাশনাল জুট মিলে গণহত্যা
১ ডিসেম্বর ২০২২ ১৬:৩২
একজন বাবার কথা কল্পনা করুন। পাঁচ ছেলে ও দুই মেয়ের জনক মানুষটি একাত্তরের পহেলা এপ্রিল সৈয়দপুরে পাকিস্তান আর্মির অর্ডিন্যান্স কোরে চাকরিরত। তার সর্বকনিষ্ঠ সন্তানকে বাঙালি সেনা অফিসার হিসেবে বিদ্রোহ করার দায়ে নির্মমভাবে হত্যার খবর পেলেন। নিজে পরিবার নিয়ে দিনাজপুরের ভিটেমাটি ফেলে এক কাপড়ে জীবন বাঁচাতে পালিয়ে এসেছেন ঘোড়াশালের ন্যাশনাল জুট মিলে কর্মরত সন্তানের কাছে। এরইমধ্যে হারিয়েছেন আরও এক সন্তানকে। হঠাৎ জুটমিলে পাকিস্তানিদের হামলা থেকে পরিবারকে বাঁচাতে এগিয়ে আসা প্রবল সাহসী সেজ সন্তানকে হারিয়েছেন পাকিস্তানিদের ব্রাশফায়ারে। একটু পানির জন্য ছটফট করতে করতে মারা গেছে সে মাত্র ২০ ফুট দূরে কিন্তু প্রাণভয়ে কাছেও যেতে পারেননি। এরপর চোখের সামনে বড় সন্তান আর মেজ সন্তানকে দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড় করিয়ে গুলি করার অপেক্ষায় আছে এক পাকিস্তানি সেনা। যে কোনো মুহূর্তেই ছুটে আসবে এক ঝাঁক গুলি। হঠাৎ ভাইদের বাঁচাতে সবার ছোট বোনটা ছুটে এসে ওই পাকিস্তানি সেনার রাইফেলসহ তাকে জড়িয়ে ধরল। আহাজারি করছে বাচ্চাটা, কাকুতিমিনতি করছে তার বেঁচে থাকা শেষ দুই ভাইকেও যেন মেরে ফেলা না হয়।
দুঃস্বপ্নের চেয়েও ভয়াবহ এমন ঘটনা ঘটেছিল ১৯৭১ সালের ১ ডিসেম্বর। চূড়ান্ত বিজয়ের মাত্র কয়েকদিন আগে ঘোড়াশালের পাশে শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে ন্যাশনাল জুট মিলে ঘটে পৈশাচিক এক গণহত্যা। এই গণহত্যায় ছোটভাইকে হারানো এবং অল্পের জন্য বেঁচে যাওয়া বাংলা একাডেমির কর্মকর্তা এবং নাট্যকর্মী মো. জিল্লুর রহমান তার সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন চোখের সামনে সেদিন ঘটে যাওয়া বর্বরতার উপাখ্যান।
একাত্তরের নভেম্বরের আগুয়ান মুক্তিবাহিনীর দল ঘোড়াশাল ও টঙ্গী রেলস্টেশনের মাঝখানে থাকা বেশ কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ রেল ব্রিজ বোমা মেরে উড়িয়ে দিয়েছিল। এর ফলে রোজার ঈদের দুই দিন আগে থেকে একদিকে ঢাকা থেকে ঘোড়াশালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর জন্য রসদ নিয়ে ট্রেন আসতে পারেনি অন্যদিকে চট্টগ্রাম থেকে ট্রেনগুলোকেও নরসিংদী পর্যন্ত এসেই থামতে হয়েছে। ফলে রসদ ও যোগাযোগের অভাবে ঘোড়াশাল এবং এর আশেপাশের অঞ্চলে পাকিস্তানিদের তৎপরতা একেবারেই কমে গেলো এবং এক পর্যায়ে ঢাকা ও চট্টগ্রাম থেকে রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন মুক্তিবাহিনীর অতর্কিত হামলার ভয়ে বেশিরভাগ পাকিস্তানি সৈন্য নদীপথে ঢাকা ফিরে যেতে বাধ্য হলো। ফলে এ অঞ্চলের মানুষেরা আসন্ন মুক্তির আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে উঠেছিল। কিন্তু বিজয় যে তখনো ছিলো আরও বীভৎসতা আর দুঃস্বপ্নের দূরত্বে!
৩০ নভেম্বর গভীর রাতে ঘোড়াশালে ট্রেন আসার শব্দে আতঙ্কিত হয়ে উঠলেন এই অঞ্চলের মানুষরা। পাকিস্তানি সেনারা দ্রুতই ঢাকা থেকে রিইনফোর্সমেন্ট এনে মুক্তিযোদ্ধাদের বিধ্বস্ত করা ব্রিজগুলো মেরামত করে সচল করেছে এবং সেপথে প্রচুর পরিমাণে পাকিস্তানি সেনা-অস্ত্র-রসদ ঘোড়াশালে এসেছে আবার। পরদিন সকাল থেকে ঘোড়াশাল ও এর আশেপাশের অঞ্চলে শুরু হলো ব্রিজ ধ্বংসের জন্য দায়ী মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজে বের করার জন্য নির্বিচারে নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ড। প্রায় দেড়শো পাকিস্তানি সেনার একটা বিশাল দল সকাল এগারোটার দিকে হামলা চালায় ন্যাশনাল জুট মিলে। তারা মিল এলাকায় ঢুকেই মিলের কোয়ার্টার থেকে সকল পুরুষ কর্মকর্তা-কর্মচারী ও তাদের পরিবারের সদস্যদের বের করে এনে শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে এক লাইনে দাঁড় করায়। এরপর কমান্ডিং মেজর উর্দুতে যা জিজ্ঞেস করল সেটা সহজ বাংলায় অনুবাদ করলে দাঁড়ায় এমন, “তোমাদের মধ্যে বোমা মেরে ব্রিজ ভাঙার সঙ্গে যুক্ত আছে কারা? অবশ্যই কেউ না কেউ মুক্তি তো আছোই, যারা ব্রিজ ভেঙেছে, সেই মুক্তিদেরও চেনো অবশ্যই। যারা এই ঘটনা ঘটিয়েছ বা চেনো কারা ঘটিয়েছে, সামনে এগিয়ে এসে স্বীকার করো অথবা চিনিয়ে দাও। তাহলে বেঁচে যাবে, বাকিরা ছাড়া পাবে। নইলে কেউ বাঁচবে না”।
সেদিন আসলেই তাদের মধ্যে ব্রিজ ভাঙার কুশীলবদের পরিবারের সদস্যরা ছিলো। মিলের লালু পিয়নের ছোট ভাই, স্পিডবোট ড্রাইভার সোলেমানের বড় ছেলে এবং মিলের আরও কয়েক শ্রমিক এই বীরত্বপূর্ণ অপারেশনে মুক্তিবাহিনীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিলেন। কিন্তু তারা অপারেশনের পর থেকেই নিরাপদে আত্মগোপনে থেকে পরের অপারেশনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তারা তো এই লাইনে নেই। লাইনে দাঁড়ানো প্রত্যক্ষদর্শী জিল্লুর রহমানসহ আরও অনেকেই আতঙ্কিত হচ্ছিলেন যে, পাকিস্তানিদের ভয়ে কেউ যদি মুখ খোলে, বলে দেয় মুক্তিযোদ্ধাদের নাম? তাহলে কি ওদের না পেয়ে লালু পিয়ন আর সোলেমান ড্রাইভারকে মেরে ফেলবে? না, ধরে নিয়ে যাবে মুক্তিযোদ্ধাদের ধরার জন্য?
কিন্তু কেউই তাদের নাম বললো না। মরে যেতে পারে জেনেও মিলের প্রত্যেকটি মানুষ অসম-সাহসে জবাব দিল, “হাম নেহি জানতা”, “কুচ নেহি জানতা”। একপর্যায়ে ধৈর্যচ্যুতি ঘটল মেজরের। অর্ডার দিল,“স্ট্যান্ড, টেক পজিশন”। সঙ্গে সঙ্গে সেনারা মেশিনগান ও রাইফেল উঁচিয়ে লাইনের বুক সোজা তাক করে দাঁড়ালো। আর হয়তো কয়েক মুহূর্ত! সবাই শেষবারের মতো প্রার্থনা করছে যখন তখনই জিল্লুর রহমানের ছোট ভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষবর্ষের ছাত্র এবং ঢাকা টেলিভিশন (পরবর্তীতে বাংলাদেশ টেলিভিশন)-এর উদীয়মান অভিনেতা মিজানুর রহমান মিজু লাইন থেকে বেরিয়ে সামনে এগিয়ে এলেন এবং প্রবল সাহস ও বিনয়ে মেজরকে অনুরোধ করলেন যেন তাকে কিছু কথা বলার সুযোগ দেন। জিল্লুর ধরেই নিয়েছিলেন, মিজু সম্ভবত বাঁচার আশায় নামগুলো বলে দেবে।
কিন্তু না, মিজু ভাঙা ভাঙা উর্দু, ইংরেজি, বাংলা মিশিয়ে মেজরকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন এদের মধ্যে কোনো দুষ্কৃতিকারী নেই, মুক্তিও নেই। থাকতেই পারে না। কারণ মিলের সিকিউরিটি অফিসার জুনায়েদ আব্বাসী একজন অবাঙালি রিটায়ার্ড আর্মি অফিসার। সে ঢাকায় হেড অফিসে গেছে, তার সঙ্গে যোগাযোগ করলেই আপনাদের সকল সংশয় দূর হবে। তাছাড়া আমি একজন টেলিভিশন শিল্পী, নিয়মিত অনুষ্ঠান করি টিভিতে, টিভি প্রোগ্রাম দেখে থাকলে অবশ্যই আমাকে চিনবেন। আমি এদের সবাইকেই চিনি এবং জানি। এরা কেউই অপরাধী নয়, এদের দয়া করে ছেড়ে দিন।
মিজুর বলার স্বরে এমন কিছু ছিল যে মেজর তার সব কথা শুনে সৈন্যদের নিবৃত্ত করল। বললো, “আপ সমঝা, তুম টিপু সুলতানকা মসিয়ে লালী হ্যায়। বহুত আচ্ছা, বহুত আচ্ছা! ইসলিয়ে তুমকো জান পেহচান ওয়ালা আদমি মালুম হোতাথা। তুম তো বহুত আচ্ছা কালাকার হ্যায়, লেকিন তুম ইয়াহা কিউ হ্যাঁয়?” এইসব নানা কথাবার্তায় বোঝা গেল মেজর মিজুর কথা বিশ্বাস করেছে এবং কিছুক্ষণ পর সে লাইনের সবার উদ্দেশ্যে বলল,“ঠিক হ্যাঁয়, ইয়ে কালাকারকে রিকোয়েস্ট সে তুম সবকো ছোড় দেতা। যাও, ঘর যাও। লেকিন মিল চালু রাখখো অউর মুক্তি কো পাকড়কে দেও”।
রীতিমতো নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে গেছে সবাই, বিশ্বাসই হচ্ছিল না যেন কারো। দম দেয়া পুতুলের মতো ধীর পায়ে সবাই কোয়ার্টারে ফিরল এবং আপনজনকে আবার দেখতে পেয়ে মা-স্ত্রী-বোন-সন্তানেরা আবেগের রুদ্ধশ্বাসে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। কারো বাড়িতেই রান্না হয়নি, তিনটা বেজে গেছে ইতিমধ্যে। মিলিটারি মিল ছেড়ে চলে গেছে ইতিমধ্যে। সবাই ভাবছিল কোন রকমে দু’টো খেয়েই পরিবার নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে বেরিয়ে পড়তে হবে। এখানে থাকা আর একমুহূর্তের জন্যও নিরাপদ নয়।
কিন্তু দুঃস্বপ্নের আসল অধ্যায় তখনো বাকী ছিলো। কিছুক্ষণ পর হঠাৎ করেই মিলিটারির ওই দলটাই আবার ঢুকলো মিলের ভেতর। ঢুকেই আর মুহূর্তমাত্র দেরী না করে আবার আগের মতো প্রত্যেক কোয়ার্টার থেকে পুরুষ সদস্যদের টেনে-হিঁচড়ে বের করে আনতে শুরু করল। কিছুক্ষণ আগেই যে মানুষটা মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এলো, তাকে আবার নিয়ে যেতে দেখে আতঙ্ক আর ভয়ে কোয়াটারগুলো থেকে নারী সদস্য ও বাচ্চাদের আর্ত-চিৎকার ও আহাজারিতে এক নারকীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো। মিলের সিনিয়র কর্মকর্তাদের তিন তলার দু’টো বিল্ডিং-এর সবগুলো কোয়ার্টারের পুরুষদের বের করে নারিকেল গাছের সারির সামনে দাঁড় করাল ওরা। এরপরে তারা মনোযোগ দিল কর্মচারীদের টিনশেড কোয়ার্টারের দিকে।
জিল্লুর রহমানের ছোট ভাই মিলের সহকারী যন্ত্র প্রকৌশলী জোবায়দুর রহমান থাকতেন এই টিনশেড কোয়ার্টারে। তার কাছে এসেই আশ্রয় নিয়েছিলেন তার বাবা-মা, দুই বোন, দুই ভাই জিল্লুর রহমান ও জুলফিকার রহমান এবং তাদের স্ত্রী-সন্তানেরা। তখনো তাদের কোয়ার্টারগুলোতে পাকিস্তানিরা হামলা না চালালেও চারপাশ ঘিরে ফেলেছিল এবং মিলের অফিসার সবাইকে বের করে এনেছিল। হঠাৎ করেই জিল্লুর লক্ষ্য করলেন তার ছোট ভাই মিজু খাবার তৈরির আগে তিন তলার বিল্ডিং-এ কোয়ার্টারে ভগ্নীপতি মোজাম্মেলের কাছে গিয়েছিল তাকে নিরাপদে সরিয়ে আনতে। সে বাকিদের সঙ্গে নারিকেল গাছের নীচে লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। জিল্লুর রহমানের আরও বেশ কয়েকজন পরিবারের সদস্যও তাদের মধ্যে ছিলো। মিজু সম্ভবত অনুমতি চাচ্ছে সেনাদের কাছে কোন কারণে টিনশেডের কোয়ার্টারে ফিরে আসতে। অনুমতি পেলো কি না বোঝা গেলো না। দেখা গেলো সে রওনা দিয়েছে টিনশেড কোয়ার্টারের দিকে। সবুজ খোলা মাঠ পেরিয়ে অর্ধেক পথ এসেছে কেবল, হঠাৎ করেই শুটিং প্রাকটিসের মতো করে মিজুর দিকে গুলি চালানো হলো।
ঘন ঘাসের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়া মিজু ওঠার চেষ্টা করতেই আরও বেশ কয়েকটা গুলি এসে বিঁধল তার বুকে পিঠে। অনেকদূর আসতে দিয়ে এরপর মাঝমাঠে শুটিং প্রাকটিসের খেলায় মিজুকে দিয়েই শুরু হলো অবর্ণনীয় নারকীয় এক গণহত্যা। পাকিস্তানি সেনাদের হাতে থাকা এসএলআর ও এলএমজি’র বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণে তাৎক্ষণিক মাটিতে লুটিয়ে পড়ল লাইনে দাঁড় করিয়ে রাখা নিরীহ মানুষগুলো। গুলিবিদ্ধ মানুষগুলো শেষ আর্তচিৎকার, চোখের সামনে আপনজনকে মরে যেতে দেখলো কোয়াটারগুলো থেকে ভীত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা চেহারাগুলো। আপনজনের জন্য গগনবিদারী আহাজারি বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না তাদের, নিজেদের প্রাণ বাঁচাতে যে যেদিকে দিকে পারে পালাবার চেষ্টা করতে লাগলো। বিল্ডিংগুলোর প্রত্যেকটি কোয়ার্টারে গুলি চালাতে শুরু করল পাকিস্তানিরা।
পাশের কোয়ার্টারে বসবাসরত মিলের এসিস্ট্যান্ট এডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসার আজিজুর রহমান শুরুতে কিভাবে যেন ওদের হাত থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন। তাকে তার কোয়ার্টার থেকে টেনে-হিঁচড়ে বের করে আনার সময় তার স্ত্রী-ছেলেমেয়েরা আহাজারি আর অনুনয়ে তাকে প্রাণপণে আঁকড়ে ধরে রাখার চেষ্টা করছিল। পাকিস্তানিরা একপর্যায়ে তাকে ঘরের ভেতরেই ব্রাশফায়ারে ঝাঁঝরা করে বেয়নেটে খুঁচিয়ে ক্ষতবিক্ষত করল। আর তার স্ত্রী-সন্তানদের উপর চললো পাশবিক নির্যাতন। এভাবে প্রত্যেকটা কোয়ার্টারে ঢুকে নির্বিচারে হামলা চলতে লাগলো। অবস্থাদৃষ্টে প্রাণ বাঁচাতে জিল্লুর রহমান ও তার পরিবার কোয়ার্টারের পেছনে সুয়ারেজ প্যাসেজে একে একে নেমে যেতে শুরু করলেন। কিন্তু সবাই নিরাপদে যাবার আগেই হুড়মুড় করে তাদের কোয়ার্টারে পাকিস্তানি সেনারা ঢুকে পড়ল।
প্রথমেই ওরা ঘরের সবকিছু তছনছ করে লুটপাট শুরু করল। মূল্যবান সব জিনিস ব্যাগে ভরতে শুরু করল। তাদের লুটপাট ও তাণ্ডবের অবসরে যারা পালাতে পারেনি, তারা পালাবার চেষ্টা করতেই এক কিশোর সেনার হাতে ধরা পড়ল। বৃদ্ধ বাবার সামনেই জিল্লুর ও তার ভাই জুলফিকারকে কোয়ার্টারের আঙ্গিনায় দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড় করালো সেই সেনা। এই বৃদ্ধ পিতা তার একের পর এক সন্তানদের হারিয়েছেন, এখন তার দুই ছেলেকে গুলি করে মেরে ফেলা হবে, এর থেকে ভয়াবহ হৃদয়বিদারক যন্ত্রণা আর কী-ই বা হতে পারে! হঠাৎ করেই পেছনের গলি থেকে জিল্লুরের ৫ম শ্রেণি পড়ুয়া ছোট বোন তাহমিদা যাকে আদর করে পুঁটি ডাকতেন জিল্লুর ভাইদের বাঁচাতে নিজের জীবন তুচ্ছ করে দৌড়ে এসে সেই কিশোর সিপাহীকে রাইফেলসহ জড়িয়ে ধরলো। হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে সে বলতে লাগলো, “তোমার মতো আমার এক ভাই ছিল মিলিটারিতে, তাকে মেরে ফেলেছে, আরেক ভাই বেঁচে আছে কি মারা গেছে আমরা জানি না, ওই যে দেখো ওই মাঠে আরেক ভাই গুলি খেয়ে পড়ে আছে, তুমি আমার এই দুই ভাইকে মেরো না। ওদের ছেড়ে দাও”।
জিল্লুরের কাছে আজও ব্যাখ্যার অতীত সেদিনের ঘটনা। বাচ্চা মেয়েটার মর্মস্পর্শী আহাজারির জন্য হোক কিংবা কোনো অলৌকিক কারণে, সেই কিশোর সেনা সেই মুহূর্তে গুলি চালালো না। পাশেই ভাঁড়ার ঘরের চকির নীচে বাকিদের আশ্রয় নিতে বলে সে দরজার কাছে দাঁড়ালো। কিছুক্ষণ পর পর সেনারা উন্মাদের মতো এদিকে আসছে এবং খুঁজছে আর কেউ আছে কিনা। সেই সেনা সরিয়ে দেয় এই বলে যে, “তুমলোগ উধার যাও, হাম ইয়াহা হ্যাঁয়”। ঘণ্টাখানেকের বেশি সময় ধরে চলতে থাকা এই নরমেধযজ্ঞ, উন্মত্ত নৃশংস গণহত্যা এবং অত্যাচার-নির্যাতনে সেদিন মিলের কোয়ার্টারের প্রায় কেউই রেহাই পায়নি। সন্ধ্যার খানিক আগে অবশেষে হুইসেল বাজিয়ে কমান্ডিং অফিসার যখন এই গণহত্যার সমাপ্তি ঘোষণা করল, তখন সেনারা মিল ছেড়ে চলে গেলো। অলৌকিকভাবে বেঁচে যাওয়া জিল্লুর রহমান, তার ভাই-বোন এবং বাবা বেরিয়ে এসেই ছুটতে ছুটতে ঘন ঘাসের উপর পড়ে থাকা মিজুর কাছে ফিরে গেলেন। কিন্তু ততক্ষণে অসংখ্য বুলেটে ক্ষতবিক্ষত মিজুর দেহ নিস্তব্ধ নিষ্প্রাণ হয়ে গেছে।
জিল্লুর রহমানদের টিনশেড কোয়ার্টারের অবস্থান থেকে মাত্র ২০ ফুট দূরে মুখ থুবড়ে পড়ে ছিলো মিজুর শরীরটা। মানুষটা এতোগুলো প্রাণ বাঁচাতে নিজের প্রাণ তুচ্ছ করেছিলেন, পাকিস্তানিরা তার কথা মেনে নিয়ে সবাইকে ছেড়ে দিয়েও কিছুক্ষণ পরেই ফিরে এসেছিল এবং সবার শুরুতে মিজুকেই হত্যা করেছিল। জিল্লুর আজোও ভুলতে পারেন না যে মিজু বেশ কয়েকবার মাথা তুলে তাদের কোয়ার্টারের দিকে তাকিয়েছিল, হয়তো তার মনে আশা ছিলো কোয়ার্টার থেকে কেউ না কেউ বেরিয়ে এসে তাকে নিয়ে যাবে। কিন্তু পাকিস্তানিদের গুলিবর্ষণ এক সেকেন্ডের জন্যও থামেনি। কোয়ার্টারগুলো থেকে যে-ই বেরিয়ে এসেছিল, সে-ই ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। জিল্লুরের মতো এমন অজস্র স্বজনহারা মানুষ চোখের সামনে তাদের প্রিয়জনকে মরে যেতে দেখেছেন, কিছু করতে পারেননি। ন্যাশনাল জুট মিল গণহত্যায় সেদিন সব মিলিয়ে ৯৬টি মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল। এর বাইরেও নিখোঁজ ছিলেন আরও অনেকেই। অনেককে খুঁজে পাওয়া যায়নি। মাত্র ১৫ দিন পরেই শত্রুমুক্ত হয়েছিল দেশ, এমন অগণিত শহীদের রক্তে ভেজা স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।
প্রত্যক্ষদর্শীর অভিজ্ঞতা বর্ণনা: মো. জিল্লুর রহমান; নাট্যকর্মী; কর্মকর্তা, বাংলা একাডেমি
গ্রন্থ কৃতজ্ঞতা: ১৯৭১: ভয়াবহ অভিজ্ঞতা
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি