শহীদ বুদ্ধিজীবী আনোয়ার পাশা: লাল সবুজে মিশে আছে যে নাম
১৪ ডিসেম্বর ২০২২ ১৭:৩৩
একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক ও প্রাবন্ধিক। যার সাহিত্যকর্মে গভীর দেশাত্মবোধ, মননশীলতা এবং প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক চিন্তাচেতনার পরিচয় পাওয়া যায়— তিনি আনোয়ার পাশা। ১৯২৮ সালের ১৫ এপ্রিল পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুর মহকুমার রাঙ্গামাটি চাঁদপাড়া ইউনিয়নের অন্তর্গত ডবকাই গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন আনোয়ার। পিতা হাজী মকরম আলী ছিলেন ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট। মায়ের নাম নাম সাবেরা খাতুন।
আনোয়ার পাশা ভাবতা আজিজিয়া উচ্চ মাদ্রাসা থেকে ১৯৪৬ সালে মাদ্রাসা পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে কৃতকার্য্য হন। ১৯৪৮ সালে বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজ থেকে আইএ পরীক্ষা দিয়ে পাস করেন। এরপর তিনি চলে যান রাজশাহী কলেজে। সেখান থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতক পাশ করেন ১৯৫১ সালে। এরপর ১৯৫৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যেই স্নাতকোত্তর সম্মাননা অর্জন করেন।
এরপর শুরু করেন কর্মজীবন। যোগ দেন মানিকচক হাই মাদ্রাসার সুপারিন্টেনডেন্ট হিসেবে। ১৯৫৪ সালে ভাবতা আজিজিয়া হাই মাদ্রাসায় এবং ১৯৫৭ সালে সাদিখান দিয়ার বহুমুখী উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। বিভিন্ন স্কুলে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করে যোগদান করেন পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে। সেখানে শিক্ষকতা করেন ১৯৫৮ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত। ১৯৬৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে অস্থায়ী প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। পরে ১৯৬৯ সালে অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী অধ্যক্ষ থাকাকালে তিনি স্থায়ী প্রভাষক হন। ১৯৭০ সালে তিনি জ্যেষ্ঠ প্রভাষক পদে পদোন্নতি পান। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সেখানেই কর্মরত ছিলেন।
আনোয়ার পাশা ছিলেন কবি, ঔপন্যাসিক ও প্রাবন্ধিক। ছাত্রাবস্থায় সাহিত্য চর্চা শুরু করেন তিনি। রাজশাহী কলেজে বিএ শ্রেণীতে অধ্যয়নকালে তিনি রচনা করেন ‘হাস্নাহেনা’ শিরোনামে একটি রম্যরচনা। তার সাহিত্য চর্চার বয়স মাত্র দুই দশক। সাহিত্যজীবনে প্রকাশিত হয় মোট দশটি গ্রন্থ ও পনেরোটি প্রবন্ধ। তার মধ্যে আছে দুইটি কাব্যসংকলন, একটি গল্পসংকলন, তিনটি উপন্যাস ও দুটি সমালোচনা গ্রন্থ। এছাড়া মুহম্মদ আবদুল হাইয়ের সহযোগিতায় তিনি প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের চারটি কাব্য সম্পাদনা করেন। বহু পত্রপত্রিকায় তার রচনা প্রকাশিত হয়েছে। তার রচনাবলীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে: নদী নিঃশেষিত হলে (১৯৬৩), রবীন্দ্র ছোটগল্প সমীক্ষা (২ খণ্ড ১৯৬৩, ১৯৭৩), নীড় সন্ধানী (১৯৬৮), নিশুতি রাতের গাথা (১৯৬৮), সাহিত্যশিল্পী আবুল ফজল (১৯৬৮), নিরুপায় হরিণী (১৯৭০), রাইফেল-রোটি-আওরাত (১৯৭৩), সমুদ্র শঙ্খলতা উজ্জয়িনী ও অন্যান্য কবিতা (১৯৭৪) ইত্যাদি।
স্বপ্ন দেখতেন স্বাধীন বাংলাদেশের। তার সেই স্বপ্নের বাস্তব রূপায়ণ তিনি দেখে যেতে পারেননি। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর দখলদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযোগী আল বদরদের একটি দল তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসা থেকে চোখ বেঁধে নিয়ে যায় এবং মিরপুর বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধের কাছে হত্যা করে। পরে সেখান থেকে মরদেহ উদ্ধার করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জামে মসজিদের পাশে তাকে সমাহিত করা হয়।
পাকিস্তানের হানাদার বাহিনী যখন ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে নিরীহ বাঙালিদের উপর অতর্কিত হামলা চালায়, তখন ভাগ্যের জোরে বেঁচে যান পাশা। সেদিন ঘটে যাওয়া ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামের ভয়াল রাতের নারকীয় হত্যাযজ্ঞ তার চিত্তে আঘাত হানে ৷ চোখের সামনে ঘটে যাওয়া একেকটি ঘটনা অন্যকে জানাতে উদগ্রীব হয়ে ওঠেন তিনি। রচনা করেন রাইফেল-রোটি-আওরাত উপন্যাসটি।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে রচিত ‘রাইফেল-রোটি-আওরাত’ উপন্যাসের কারণে পেয়েছেন মরণোত্তর বাংলা একাডেমি পুরস্কার ও স্বাধীনতা পদক।
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি