Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

আনোয়ার পাশা: সংগ্রামের দিনলিপি উদ্ভাসিত যার লেখায়

রাতিন রা’দ
১৫ ডিসেম্বর ২০২২ ১৫:০১

‘নতুন মানুষ, নতুন পরিচয় এবং নতুন একটি প্রভা। সে আর কত দূরে। বেশি দূর হতে পারে না। মাত্র এই রাতটুকু তো। মা ভৈঃ। কেটে যাবে।’

‘রাইফেল রোটি আওরাত’ নামে কিংবদন্তী এক উপন্যাসের শেষ লাইনে এভাবেই দৃপ্তস্বরে শত্রুমুক্ত বিজয়ী স্বদেশে অপূর্ব এক ভোরের আগমনীবার্তা শুনিয়েছিলেন ঔপন্যাসিক আনোয়ার পাশা। একাত্তরে যখন পাকিস্তানি জান্তা সরকারের লেলিয়ে দেওয়া সেনাবাহিনী সাধারণ ও নিরস্ত্র জনগণের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সিনিয়র লেকচারার আনোয়ার পাশা সেই হতাশ অমানিশার মধ্যেও উজ্জ্বল স্বাধীন সূর্যোদয়ের গল্প লিখেছিলেন অসম সাহসিকতায়। ‘বাংলাদেশে নামল ভোর’ বাক্য দিয়ে যার শুরু, তার শেষ হয় অমোঘ আশার বাণী ‘মা ভৈঃ’ দিয়ে। এক সকাল থেকে আরেক সকালের এই গল্প লেখা শুরু হয় একাত্তরের এপ্রিল মাসে, আর শেষ হয় জুনে।

বিজ্ঞাপন

উপন্যাসের সময়কাল মাত্র ৩ মাস হলেও এ যেন এক দীর্ঘ সংগ্রামের গল্প। পটভূমি বধ্যভূমি ঢাকা শহর থেকে বাংলাদেশের নিভৃত এক গ্রাম। যখন জীবন নিয়ে পালিয়ে বাঁচতে হচ্ছে দেশের ভেতর থেকে আরও ভেতরে, তখন এই মানুষটি লিখছেন জাতির ইতিহাসের সবচেয়ে মর্মান্তিক কিন্তু গৌরবময় সময়ের রক্তে রাঙানো দলিল। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম উপন্যাস ‘রাইফেল রোটি আওরাত’। বন্দিশিবিরের ভয়াবহতার মধ্যে বসে আশার অভয়বাণী শোনানোর এমন আখ্যান বিশ্বসাহিত্যে বিরল।

কবি, কথাসাহিত্যক, ঔপন্যাসিক, শিক্ষাবিদ ও অধ্যাপক আনোয়ার পাশার জন্ম পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদের বহরমপুর মহকুমার ডাবকাই গ্রামে ১৯২৮ সালের ১৫ এপ্রিল। পিতা হাজী মকরম আলী দেশভাগের আগে দীর্ঘদিন ছিলেন ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট, ফজলুল হক প্রবর্তিত ঋণ-সালিশি বোর্ডের চেয়ারম্যানও নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। আনোয়ার পাশারা ছিলেন তিন ভাই— বাকি দু’জন আলাউদ্দীন ও আবদুর রকীব। মাদরাসা শিক্ষার মাধ্যমে শুরু হওয়া আনোয়ার পাশার শিক্ষাজীবন ছিল সফল। ১৯৪৬ সালে হাই মাদরাসা পরীক্ষা দিয়ে পেয়েছিলেন প্রথম বিভাগ। কিন্তু মাদরাসা লাইনে পড়া তার নীতিবিরুদ্ধ হওয়ায় ১৯৪৬ সালে ভর্তি হন বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজে।

বিজ্ঞাপন

দেশভাগের পর ১৯৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন, ভর্তি হন রাজশাহী কলেজে। সেখান থেকে স্নাতক শেষ করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিষয়ে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সে সময়ে তার শিক্ষক ছিলেন ড. শশিভূষণ দাশগুপ্ত; ড. সুকুমার সেন, অধ্যাপক প্রমথনাথ বিশীর মতো রথী-মহারথীরা। আনোয়ার পাশার সহপাঠীদের মধ্যে ছিলেন সত্যপ্রিয় ঘোষ (কবি শঙ্খ ঘোষ), ড. ক্ষেত্র গুপ্ত, ড. অশ্রুকুমার সিকদারের মতো উজ্জ্বর সব মুখ। তার জন্মস্থান ডাবকাই গ্রামের তিনিই প্রথম স্নাতকোত্তর পাস ব্যক্তি ছিলেন। ছাত্র হিসেবে দুর্দান্ত মেধাবী আনোয়ার পাশা সম্পর্কে প্রশংসাপত্রে কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ডের পরিচালক ড. মুহম্মদ এনামুল হক উল্লেখ করেছেন— ‘He was one of the bright students of my class…. He as a student made a very favourable impression on me.’ (27.06.1966)

কর্মজীবনে আনোয়ার পাশা শিক্ষকতা ও অধ্যাপনা করেছেন বিভিন্ন জায়গায়, সম্মুখীন হয়েছেন নানা বিচিত্র পরিস্থিতির। ভারতে থাকাকালীন প্রথমে মানিকচক হাই মাদরাসা, পরবর্তী সময়ে ভাবতা হাই মাদরাসা এবং এরপর সাদিখান দিয়ার বহুমুখী উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন আনোয়ার পাশা। কিন্তু সবসময়ই তিনি চেয়েছিলেন কলেজে অধ্যাপনাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করতে। দুঃখজনকভাবে নানা জায়গায় চেষ্টা করেও সে সুযোগ তার হয়নি। এর পেছনে কারণগুলোও ছিল অদ্ভুত। দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি অধ্যাপক পদে আবেদন করেছিলেন, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় খুব ভালো করার পরও শেষ পর্যন্ত সাম্প্রদায়িক পক্ষপাতিত্বের কারণে আনোয়ার পাশাকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ দেওয়া হয়নি!

এমন ঐতিহ্যবাহী একটি বিশ্ববিদ্যালয় সম্পূর্ণ সাম্প্রদায়িকতামুক্ত— এমন দৃঢ় আস্থা পোষণ করতেন আনোয়ার পাশা। সেখান থেকেই অভাবনীয় সাম্প্রদায়িক আচরণে প্রচণ্ড মানসিক আঘাত পান। ফলে ১৯৫৮ সালে তিনি চলে আসেন পূর্ব পাকিস্তানে। সে বছরের ২ মার্চ তিনি পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের বাংলা বিভাগে যোগ দেন প্রভাষক হিসেবে। পরে কালক্রমে অধ্যাপক পদে উন্নীত হন। তবে মানসিক হতাশা ও কষ্ট তার থেকেই যায়।

নিজের জন্মভূমি, মা-বাবা, পরিবার পরিজন সবাইকে ফেলে পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসতে হয়েছিল যে কারণে, সেই সাম্প্রদায়িকতাই তাকে মানসিকভাবে ভেঙে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। পূর্ব পাকিস্তানে আসার পর এখানকার সাম্প্রদায়িকতার আরও গভীর ও কুৎসিত দিক তাকে স্তব্ধ করে দেয়। ১৯৬০ সালের ২৬ আগস্ট আনোয়ার পাশা ডায়েরিতে লিখেছেন— ‘ভারতের মাটিতে আমার পরিচয় মুসলমান বলে, আর পাকিস্তানে আমি ঘৃণিত ও অবহেলিত হচ্ছি মুসলমান নই বলে।… যে পরিবেশে এখানে আছি তাতে কেবল মর্যাদা নিয়ে গৌরব করার কিছু নেই। অধ্যাপকরা এ দেশে যেন অভিশপ্ত জীব।… সাংস্কৃতিক মান এখানকার অত্যন্ত নিম্নস্তরের, এক কথায় দৈনন্দিন জীবন এখানে আদৌ সুখকর নয়। তার ওপর আছে যথেষ্ট পরিমাণে মুসলমান না হতে পারার লাঞ্ছনা।”

আনোয়ার পাশা রাজনীতি করতেন না। তবে মনে মনে ছিলেন কংগ্রেসপন্থি। পাকিস্তান ছিল একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র। সেই সাম্প্রদায়িক পাকিস্তানেই তিনি চলে এলেন। সপরিবারে বসবাস করতে লাগলেন পাকিস্তানের বা সাম্প্রদায়িকতার অনুগামী হয়ে নয়, বরং তার ঘোরতর বিরোধী হয়ে। এখানে এসে ওই আড্ডার অংশীদার হয়ে তিনি তার অজান্তেই যেন কিছুটা ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপের) সমর্থক বনে গেলেন। বস্তুতই তিনি ছিলেন একজন খাঁটি জাতীয়তাবাদী।

অবশেষে ১৯৬৪ সালে ইমিগ্রেশন সার্টিফিকেট নিয়ে তিনি চিরতরে ভারতের সাথে সম্পর্ক ত্যাগ করে ১২ এপ্রিল গ্রহণ করেন পাকিস্তানের নাগরিকত্ব। কবি শঙ্খ ঘোষের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, ভারত ছেড়ে চলে আসার সময় তার সঙ্গে দেখা হলে আনোয়ার পাশা বলেছিলেন— ‘শঙ্খ, তুমি থাকো আমার দেশে, আমি চলে গেলাম তোমার দেশে।’ (শঙ্খ ঘোষের জন্ম বরিশালের বানারীপাড়ায়, সাতচল্লিশে দেশভাগের পর থেকে অবস্থান ভারতের কলকাতায়, সেখানেই মৃত্যু)।

এডওয়ার্ড কলেজে অধ্যাপনাকালেই ছেষট্টির ২২ এপ্রিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার প্রভাষক পদে নিয়োগের আবেদন করেন আনোয়ার পাশা। ১ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থায়ী প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। ওই সময় অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী ছিলেন বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষ। ১৯৭০ সালের ১৪ জুলাই তিনি উন্নীত হন সিনিয়র প্রভাষক পদে। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত এখানেই ছিলেন তিনি।

পাবনায় অধ্যাপনা ও লেখালেখির পাশাপাশি বিভিন্ন সাংস্কৃতিক-সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডেও যুক্ত হয়ে পড়েছিলেন আনোয়ার পাশা। পূর্ব পাকিস্তানে তার লেখা প্রথম প্রকাশ পায় ১৯৬১ সালে, রাজশাহী থেকে প্রকাশিত জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী ও মুস্তাফা নূরুল ইসলাম সম্পাদিত ত্রৈমাসিক ‘পূর্বমেঘ’ পত্রিকায়। ওই সময়ই পাবনার এডওয়ার্ড কলেজে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন তিনি। এছাড়াও পাবনা অন্নদা গোবিন্দ পাবলিক লাইব্রেরি ও মহাকালী বালিকা বিদ্যালয়ের সভায় সভাপতিত্ব করেন আনোয়ার পাশা। রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী অনুষ্ঠান আয়োজনে উদ্যোগী হওয়ার ‘অপরাধে’ পূর্ব পাকিস্তান সরকারের স্বরাষ্ট্র বিভাগের নির্দেশে তার পাসপোর্ট ছয় বছরের জন্য স্থগিত রাখা হয়।

ওই সময়কার একটি ব্যতিক্রমী ঘটনার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। ১৯৬৪ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ছিল আইয়ুব খান গঠিত মৌলিক গণতন্ত্রীদের ভোটে পাকিস্তানব্যাপী গণপরিষদের নির্বাচন। পাবনায় ঘটে গেল সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। কিছুদিন আগে মালদহে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ঘটেছিল, তারই প্রতিশোধ নিতে পাবনার নিরপরাধ হিন্দুদের কচুকাটা করা হলো। আইনজীবী-শিক্ষক-ব্যবসায়ী নির্বিশেষে কমপক্ষে ৩১ জন নির্মমভাবে নিহত হলেন, শত শত মানুষ আহত হলেন, হিন্দু নারীরা হলেন ধর্ষণের শিকার। হাজার হাজার বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দেওয়া হলো। পাবনার জীবনযাত্রা অচল হয়ে পড়ল আতঙ্কে।

যে পুলিশ দাঙ্গা প্রতিরোধ করবে, তারাই দিব্যি দাঙ্গাকারীদের বড় সহায়ক ভূমিকা পালন করল। পথ দেখিয়ে দেওয়া থেকে সবকিছু। দাঙ্গার শুরু সন্ধ্যায়, তা চলল রাত ৩টা পর্যন্ত। ট্রাকে করে এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় সশস্ত্র দুর্বৃত্তদের আনা-নেওয়া চলছিল পুলিশের নাকের ডগায়। এডওয়ার্ড কলেজের হিন্দু ছাত্রাবাসের ৩০ জন ছাত্র মহাআতঙ্কে ছুটে গেল অধ্যক্ষের বাসভবনে। কিন্তু অধ্যক্ষ তাদের নিরাপত্তায় কোনো ব্যবস্থা নিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে মুখের ওপর দরজা লাগিয়ে দিলেন। বললেন, ‘দরকার হলে এসপির কাছে যাও। আমার কিছু করার নেই।’

হতাশ হয়ে ফিরে এলো ছাত্ররা। এরই মধ্যে দেখা গেল একটি রিকশা নিয়ে ছুটে এলেন অধ্যাপক আনোয়ার পাশা। তিনি ওই আতঙ্কিত ছাত্রদের জিজ্ঞাসা করলেন, তারা কেমন আছে। সব শুনে তিনি নাইটগার্ডকে ডাকলেন। ডেকে টিচার্স কমনরুমের দরজা খুলে দিতে বললেন। দরজা খুলতেই আনোয়ার পাশা ছাত্রদের ওই কক্ষে ঢুকিয়ে দিয়ে নাইটগার্ডকে তালা বন্ধ করে দিতে বললেন। আর ছাত্রদের বললেন, ‘তোমরা ভেতরে চুপচাপ থাক। কথাবার্তা বলবে না, চিৎকার-চেঁচামেচি কিছুই করবে না। অন্য কেউ ডাকলেও না। আমি বাসায় যাচ্ছি। তোমাদের জন্য খাবার-পানি নিয়ে আসি।’

বলেই আনোয়ার পাশা ছুটলেন বাসায়, স্ত্রীকে বললেন রান্না বসাতে। রান্না শেষ হতেই আনোয়ার পাশা দু’টি রিকশা ডেকে খাবার, এক হাঁড়ি পানি ও কয়েকটি গ্লাস সঙ্গে নিয়ে চলে গেলেন কলেজ ক্যাম্পাসে। নাইটগার্ডকে ডেকে টিচার্স রুমের দরজা খুলিয়ে খাবারগুলো ঢুকিয়ে দিতে বললেন পানির হাঁড়ি ও গ্লাসগুলোসহ। ছাত্রদের ওগুলো খেয়ে ঘুমিয়ে যেতে এবং নাইটগার্ডকে পুনরায় দরজায় তালা লাগাতে বলে সকালে অবস্থা ভালো থাকলে দরজা খুলে দিতে এবং ছাত্রদের তাদের হোস্টেলে ফিরে যেতে বললেন। তবে অবস্থা খারাপ থাকলে এই রুমেই থাকতে বলে তিনি বাসায় চলে গেলেন।

হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তির দাপটে দেশ ছেড়ে এসেছিলেন অধ্যাপক আনোয়ার পাশা। তিনিই আবার এভাবেই হিন্দু ছাত্রদের আগলে রেখে বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন। এ নিয়ে আনোয়ার পাশার কোনো আত্ম-অহমিকা ছিল না। তিনি বিশ্বাস করতেন, শিক্ষক তো ছাত্রদের কাছে পিতার মতোই। তিনি শুধু পিতার ভূমিকা পালন করেছেন, আর কিছু নয়। তবে আনোয়ার পাশার মনে প্রশ্ন ছিল— হিন্দুর দেশ যদি হয় হিন্দুস্তান (ভারত) আর মুসলমানের দেশ পাকিস্তান, তাহলে মানুষের দেশ কোনটি?

আনোয়ার পাশার প্রথম প্রকাশিত বই তার কাব্যগ্রন্থ ‘নদী নিঃশেষিত হলে’। দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘সমুদ্র শঙ্খলতা উজ্জয়িনী ও অন্যান্য কবিতা’ প্রকাশিত হয়েছিল তার মৃত্যুর পর, ১৯৭৪ সালে। ১৯৬৩ সালে প্রকাশিত হয় তার ‘রবীন্দ্র ছোটগল্প সমীক্ষা (প্রথম খণ্ড)’। রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষে ১৯৬১ সালে (বঙ্গাব্দ ১৩৬৮) পুরো এক বছরে এই বইয়ের প্রথম খণ্ড রচনা করেন তিনি। এতে গল্পগুচ্ছের প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ডের গল্পগুলোর আলোচনা ছাড়াও দেশ-কাল এবং প্রকৃতি সম্পর্কেও আলোচনা করেছেন তিনি। এ বইয়ের সংশোধিত ও সংযোজিত দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৯৬৯ সালে। ‘রবীন্দ্র ছোটগল্প সমীক্ষা (দ্বিতীয় খণ্ড)’ প্রথম প্রকাশ পায় তার মৃত্যুর পরে, ১৯৭৮ সালে। ১৯৬৭ সালে তার তৃতীয় গ্রন্থ ‘সাহিত্যশিল্পী আবুল ফজল’ প্রকাশ পায়।

আনোয়ার পাশার প্রথম উপন্যাস ‘নীড় সন্ধানী’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬৮ সালে। যদিও তিনি এটি রচনা করেছিলেন ১৯৬৫-৬৬ সালে, ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল মাসিক পূবালী পত্রিকায়। পরের উপন্যাসটিও বেরোয় ১৯৬৮ সালেই— ’নিষুতি রাতের গাঁথা’। দু’টি উপন্যাসই আত্মজীবনীমূলক। দেশত্যাগ করে পূর্ব পাকিস্তানে আশ্রয় নেওয়ার ঘটনাগুলো অবলম্বন হয়ে উঠেছে এসব উপন্যাসে, উঠে এসেছে দেশত্যাগের পুরনো আক্ষেপ ও নানা হতাশা। তার একমাত্র গল্পগ্রন্থ ‘নিরুপায় হরিণী’ প্রকাশিত হয় ১৯৭০ সালে। তার একটি অসমাপ্ত উপন্যাসের নাম ‘নেতিগর্ভ/হিমগৃহ’ বলে উল্লেখ পাওয়া যায়।

এর বাইরে বেশকিছু প্রবন্ধ-নিবন্ধও রচনা করেছেন আনোয়ার পাশা। মুহম্মদ আবদুল হাইয়ের সঙ্গে যুগ্ম-সম্পাদনায় ১৯৬৮ সালে প্রকাশ করেন ‘চর্যাগীতিকা’, ১৯৬৭ সালে ‘বড়ু চণ্ডীদাসের কাব্য’ (শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের কিছু অংশ) প্রকাশ পায়। ‘কালকেতু উপাখ্যান’ (মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর চণ্ডীমঙ্গলের অংশবিশেষ) ও ‘মানসিংহ-ভবানন্দ উপাখ্যান’ (ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের অন্নদামঙ্গলের অংশবিশেষ) প্রকাশিত হয় ১৯৬৭ সালে এবং ১৯৬৯ সালে প্রকাশিত হয় ‘ঈশ্বরগুপ্তের কবিতা-সংগ্রহ’।

এত সব গল্প, কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ, গবেষণার মধ্যেও আনোয়ার পাশাপাশি অমরত্ব দিয়েছে তার তৃতীয় উপন্যাসটি। মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে, ১৯৭১ সালের এপ্রিল থেকে জুনের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক এলাকায় বসে লেখা সেই উপন্যাস। চারপাশে তখন বারুদের গন্ধ, প্রতিদিন নির্মমভাবে প্রাণ হারাচ্ছেনর হাজারও নিরপরাধ মানুষ, মুহূর্তেই হানাদার পাকিস্তানিদের হাতে ধরা পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা— এমনই পরিবেশ-প্রতিবেশের মধ্যে আনোয়ার পাশা একমনে লিখে চলেছেন রক্তে ভেজা এক মুক্তিসংগ্রামের গল্প, যার চরিত্রগুলোর অনেকেই মূর্তিমান বাস্তব।

‘রাইফেল রোটি আওরাত’ উপন্যাসের শুরু ১৯৭১ সালের ২৮ মার্চের ভোরে। ইতিহাসের অন্যতম পৈশাচিক কালরাতের দু’রাত পরের এক ভোর। রোমহর্ষক অকল্পনীয়তা থেকে মৃত্যু ততক্ষণে হয়ে উঠেছে খুবই স্বাভাবিক সাধারণ এক বাস্তবতা। উপন্যাসের মূল চরিত্র সুদীপ্ত। বাংলার চিরায়ত অসাম্প্রদায়িকতায় মোড়ানো নাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, তবে সেই পদ পেতে বাধ্য হয়ে নিজের নাম বদলাতে হয়েছে সুদীপ্তকে, ‘হিন্দুয়ানি’ নামের জন্য ইন্টারভিউ বোর্ডে শিকার হতে হয়েছে সাম্প্রদায়িক অপদস্থতার। এ যেন তার নিজের জীবনেরই গল্প, শুধু পরিবেশ আর পরিস্থিতি হয়ে গেছে একেবারেই ভিন্ন কিছু, জঘন্য বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে দুঃস্বপ্নের চেয়েও অন্ধকার কিছু। এই বইয়ে দেখানো হয় পাকিস্তানি নরপিশাচদের অন্যতম অবজ্ঞার বস্তু ছিল আমাদের ‘বাংলা ভাষা’ এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদ।

এই দুই সত্তাকে বিনাশ করতে তারা এর সঙ্গে যুক্ত করে ‘হিন্দুয়ানি’ ট্যাগ। চালায় হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণ, গণধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, ধর্মান্ততরিতকরণসহ ভয়াবহতম জেনোসাইড। কিন্তু তারা জানত না— অত্যাচার করে, ট্যাংকে দলেপিষে দিয়েই একটি জাতির শেকড়, বিশ্বাস উপড়ে ফেলা যায় না, যে বিশ্বাস ছড়িয়ে দিয়ে গেছেন কলিযুগের দেবতা হিসেবে উপন্যাসে উল্লেখ করা ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব। মসজিদে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জন্মদিনের আয়োজনে উপস্থিত থেকে তিনি অসাম্প্রদায়িকতার বিরল এক নজির গড়েন। তাকে মেরে ফেললেও তার এ ধারাকে বিনাশ করতে পারেনি সেই পিশাচের দল!

ঠিক একইভাবে অধ্যাপক শহিদ আনোয়ার পাশাকে মেরে ফেললেও মুছে ফেলতে পারেনি তার রেখে যাওয়া বিজয়ের উজ্জ্বল ভোরের আগমনী ধ্বনি। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আবাসিক এলাকার ৩০ নম্বর বাড়ির বাসায় সেদিন পরিবার-পরিজনের সঙ্গে তিনিও ছিলেন। পরনে লুঙ্গি ও হাওয়াই শার্ট, গায়ে চাদর। সেদিন সকাল ৯টার দিকে লাল রঙের একটি গাড়ি আনোয়ার পাশার বাসার সামনে এসে থামে। গাড়ি থেকে অস্ত্রসহ নেমে আসে ইসলামি ছাত্রসংঘের আশরাফুজ্জামান ও চৌধুরী মইনুদ্দিনের নেতৃত্বে আলবদর বাহিনীর কয়েক জল্লাদ।

আলবদর জল্লাদরা বাসায় ঢুকে প্রথমেই আনোয়ার পাশার গায়ের চাদরটি দিয়ে তার চোখ বেঁধে ফেলে, ধরে নিয়ে চলে যায় মিরপুর বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধের দিকে। সেখানেই আরও অনেকের সঙ্গে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। ছোটবেলা থেকে নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে জন্মভূমি ছেড়ে পরিবার-আত্মীয়-পরিজনকে পেছনে ফেলে পরবাসী হয়েছিলেন একটা সুস্থ-স্বাভাবিক স্বাধীন প্রগতিশীল জীবনের প্রত্যাশায়। অধ্যাপনার পাশাপাশি প্রগতিশীল সমাজ গঠনে করেছেন শিল্পসাহিত্য ও মুক্তবুদ্ধির চর্চা। অথচ নিজের জন্মভূমি ছেড়ে চিরতরে চলে এসেছেন যে দেশে, যে দেশকে নিয়ে নিরন্তর স্বপ্ন দেখেছেন, সেই দেশের মানুষরূপী কিছু সাম্প্রদায়িক ধর্মান্ধ জল্লাদ তার জীবন কেড়ে নিল তার ভবিষ্যদ্বাণী করে যাওয়া বিজয়ের ভোরের সূর্য উদিত হওয়ার মাত্র দু’দিন আগে!

এক চলমান জেনোসাইডের দুঃস্বপ্নের মধ্যে বসে মরণপণ প্রতিরোধ আর দুর্মর সংগ্রামে কালো অন্ধকার পেরিয়ে আসন্ন বিজয়ের সূর্য ওঠার স্বপ্ন দেখার স্পর্ধা খুব সহজ কিছু নয়। আনোয়ার পাশার ‘রাইফেল রোটি আওরাত’ উপন্যাসটিও এক প্রবল যুদ্ধই বটে! কিন্তু আনোয়ার পাশা অতিমানবিক চেষ্টায় সে কাজটি করেছেন। সেই কঠিন সময়ের ভেতর স্থির ও শান্ত থেকে ঋজুতা নিয়ে ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য লিখে গেছেন। ভয়াবহ নিপীড়ন, হত্যা আর নির্মম জেনোসাইডের মধ্যেও মাথা উঁচু করে প্রচণ্ড প্রতিরোধের বীরত্বগাঁথা, অজস্র মৃত্যু পেরিয়ে বিজয়ের পাড়ে পৌঁছানোর হার না মানা জীবনীশক্তির গল্প ছড়িয়ে দিয়েছেন! হাজার বছর পরও একাত্তরের সেই ঘোর অমানিশা সময়কে আর আমাদের তীব্র প্রতিরোধে ছিনিয়ে আনা বিজয়ের গল্পকে কেউ ঠিকই চিনে নিতে পারবে তার রাইফেল-রোটি-আওরাতে! বিজয়ের ভোর দেখার জন্য তিনি ছিলেন না। তবুও রাত কেটে গিয়েছিল, অন্ধকার কেটে গিয়েছিল। বিজয়ের সূর্যের রৌদ্রকরোজ্জ্বল প্রভা উঠেছিল প্রবল স্পর্ধায়!

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

আনোয়ার পাশা: সংগ্রামের দিনলিপি উদ্ভাসিত যার লেখায় ফিচার মুক্তিযুদ্ধ রাতিন রা’দ

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর