রোজায় তাকওয়া অর্জনের সুফল
১৭ এপ্রিল ২০২৩ ১৫:০২
অন্য যে কোনো ইবাদতের সঙ্গে রোজার একটি মৌলিক পার্থক্য আছে। অন্য ইবাদতে ফাঁকিবাজির সুযোগ থাকে, লৌকিকতার আশঙ্কা থাকে। কিন্তু রোজায় ফাঁকিবাজি ও লৌকিকতার কোনো সুযোগ নেই। নীরবে-নির্জনে কিছু খেলে বা পান করলে হয়তো কেউ দেখবে না, তবুও রোজাদার তা থেকে বিরত থাকে। এর একমাত্র কারণ হলো আল্লাহর ভয়। একজন মানুষ যেখানে যায়, যা কিছু করে— সবকিছু আল্লাহর সামনে অত্যন্ত সুস্পষ্ট। দুনিয়ার আর কেউ না দেখলেও আল্লাহ তা দেখেন। এই যে আল্লাহর ভয়ে বান্দা খাবার-দাবার থেকে বিরত থাকল, এটাই হলো তাকওয়া বা খোদাভীতি। এই তাকওয়াই হলো রোজার প্রাণ। যিনি আল্লাহকে যত বেশি ভয় করবেন তার রোজা তত বেশি পোক্ত হবে।
শরিয়তের পরিভাষায় আল্লাহর ভয়ে সব ধরনের অন্যায়, অত্যাচার ও পাপাচার বর্জন করে পবিত্র কোরআন ও সুন্নাহর নির্দেশানুযায়ী মানবজীবন পরিচালনা করার নামই তাকওয়া। ইসলামে তাকওয়ার চেয়ে মর্যাদাবান কিছু নেই। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই আল্লাহর কাছে অধিক মর্যাদাসম্পন্ন, যে অধিক মুত্তাকি।’ পবিত্র রমজানের সুফল বর্ণনা করতে গিয়ে কোরআনে বলা হয়েছে, ‘যেন তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পার।’
ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষে-মানুষে কোনো ভেদাভেদ নেই, মানুষে-মানুষে পার্থক্য করার কোনো সূত্র নেই। তবে একমাত্র তাকওয়া দ্বারাই মানুষের মধ্যে পার্থক্য হতে পারে। কোরআনের ভাষায়, যে আল্লাহকে যত বেশি ভয় করে সে তত বেশি সম্মানিত।
সাধারণভাবে তাকওয়ার অর্থ আল্লাহর ভয়ে নিজের ভেতরের রিপু দমন করে আল্লাহর আদেশ-নিষেধ মেনে চলা। রোজা মুমিন বান্দার অন্তরে সেই আল্লাহভীতি ও আত্মসমর্পণ জাগিয়ে তাকে পরিশুদ্ধ হওয়ার সুযোগ করে দেয়। ক্ষুধা-পিপাসা ও সংযমের পবিত্র দহন রোজাদারকে আল্লাহর বিধানের সামনে খুশিমনে আত্মসমর্পণের প্রেরণা দেয়।
ইসলামি শরিয়তের পরিভাষায় তাকওয়ার বিভিন্ন স্তর রয়েছে। এর সর্বনিম্ন স্তর হচ্ছে কুফর ও শিরক থেকে বেঁচে থাকা। এর মধ্যমস্তরে রয়েছে কবিরা গোনাহ থেকে বেঁচে থাকা ও সগিরা গোনাহ বারবার না করা। আর সর্বোচ্চ স্তর হচ্ছে মন্দ বিষয় থেকে বেঁচে থাকার উদ্দেশ্যে এমন জায়েজ অনেক বিষয়কেও পরিহার করে চলা, যেগুলো করলে নাজায়েজ কাজে জড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাকওয়া অবলম্বনকারী ব্যক্তিকেই বলা হয় মুত্তাকি।
ইসলামে রোজার যে নিয়মশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তা আত্মশুদ্ধি লাভ ও তাকওয়া অর্জনের মূলমন্ত্র। মাহে রমজানসহ মুসলমানদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তাকওয়ার গুরুত্ব অপরিসীম। কারও ভেতরে তাকওয়া বা খোদাভীতি থাকলে তিনি কখনও অনাচারে লিপ্ত হবেন না। যিনি আল্লাহকে ভয় করেন, তিনি অন্যের অনিষ্টের চিন্তা করতে পারেন না। তার দ্বারা কোনো অপরাধ সংঘটিত হতে পারে না। একটি সুষ্ঠু সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের জন্য এ ধরনের বিশুদ্ধ মানুষের প্রয়োজন অনেক বেশি। সমাজে ভাল মানুষের সংখ্যা যত বাড়বে সমাজ তত উন্নত ও সভ্য হবে। বিশুদ্ধ মানুষ তৈরির বিশেষ অনুশীলন হলো রমজানের সিয়াম বা রোজা।
রোজাদার বান্দা প্রতিদিন খাবার-দাবার ও জৈবিক চাহিদা পূরণ থেকে নিজেকে সযতনে বিরত রাখেন। সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও এই কাজটি করেন কেবল আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ পালনের জন্য, তার সন্তুষ্টির জন্য। হাদিসে আছে, ‘যে ব্যক্তি রোজা অবস্থায় মিথ্যাচার ও মন্দ কাজ ত্যাগ করেনি, তার পানাহার ত্যাগে আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই।’ আল্লাহর এই কঠোর নির্দেশনা মানতে গিয়ে রোজাদার ব্যক্তি সবসময় নিজেকে পাপকাজ থেকে বিরত রাখে। মানুষের পক্ষে হয়ত শতভাগ পাপমুক্ত থাকা সম্ভব নয়। তবুও কেউ চেষ্টা করলে তা অসম্ভব নয়। আল্লাহকে ভয় করে যে নিজেকে যত বেশি পাপমুক্ত রাখার চেষ্টা করবে সে আল্লাহর তত সান্নিধ্য অর্জন করবে।
শুধু রমজান নয়, মানুষের গোটা জীবনেই তাকওয়ার কোনো বিকল্প নেই। তবে রমজানে তাকওয়ার অনুশীলন অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে সহজ। পবিত্র রমজানে কেউ পাপমুক্ত থাকার চেষ্টা করলে পরিবেশ-পারিপার্শ্বিকতা তাকে অনেকটা সুযোগ করে দেয়। এই মাসে আল্লাহর বিশেষ রহমতও থাকে। মূলত আল্লাহর রহমত ছাড়া কেউ নিজেকে পাপমুক্ত রাখতে পারেন না।
যখন মানুষ তার প্রচেষ্টা দিয়ে আল্লাহর ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করে, তখন আল্লাহও তার দিকে সদয় হন। হাদিসে কুদসিতে আছে, বান্দা যখন আল্লাহর দিকে হেঁটে যায় আল্লাহ তখন তার দিকে দৌড়ে আসতে থাকেন। এর দ্বারা মূলত বোঝানো হচ্ছে, পাপমুক্ত ও বিশুদ্ধ জীবন গড়ার জন্য মানুষের আন্তরিকতা যতটুকু, এটা তার চেয়েও বেশি পরিমাণে চান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন।
সারাবাংলা/এসবিডিই