Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ঢাকার ঈদ


২২ এপ্রিল ২০২৩ ১৯:২৬

ইদ মানে আনন্দ। সারা পৃথিবীর মুসলিমদের কাছে এই দিনটি একইভাবে আনন্দের। সংস্কৃতির ভিন্নতার কারনে সেই আনন্দের রূপ ভিন্ন হলেও আনন্দের জোয়ারে ভেসে যায় সবাই। রোজার ইদের আনন্দ একটু বেশিই হয়ে থাকে। একদিকে এটি হচ্ছে বছরের প্রথম ইদ, অন্যদিকে একমাস রোজ রাখার পর আসে এই কাঙ্খিত দিনটি।

ঢাকার ইদ অনেকটাই ভিন্নতা দেখতে পাওয়া যায়। প্রায় চার’শ বছর আগে ঢাকায় ইদের জামাত আয়োজনের কথা জানা যায়। সেই দিনটির স্বাক্ষী হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে ধানমন্ডি সাতমসজিদ রোডে ‘ঢাকা ইদগাঁ’। বাংলার সুবেদার শাহ্ সুজার আদেশে তার প্রধান অমাত্য মীর আবুল কাশেম ১৬৪০ সালে এটি নির্মাণ করেন। সেই সময়ে এই ইদগাঁয় মোঘল সুবেদার, নাজিম, গণ্যমান্য ব্যক্তিরা ইদের নামাজ আদায় করতেন। এই দেশের মানুষের সেখানে প্রবেশাধিকার ছিল না। তারা বাইরে দাঁড়িয়ে দেখতেন। সেই সময়ে এই দেশের মানুষ, বাইরে থেকে আসা বিচিত্র পোশাক পরা লোকগুলোকে দেখেই তৃপ্ত থাকতেন।

বিজ্ঞাপন

মোঘল আমলের ঢাকার সাধারণ মানুষের ইদ আয়োজনের কোন তথ্য পাওয়া যায় না। এমনকি ঢাকায় বসবাসরত মোঘলদের অন্দরে ইদ আয়োজন কেমন ছিল সেটারও কোন তথ্য নেই। সেই সময়ে ইদ আয়োজন শুধু পুরুষদের বিষয়টি নানাভাবে দেখতে পাওয়া যায়।

নবাবী আমলের ইদ মিছিল সম্পর্কে জানা যায়, সেই সময়ের কিছু চিত্রকর্ম থেকে। উনিশ শতকের প্রথম দিকে আলম মাসওয়ার নামে এক শিল্পী ইদ মিছিলের ছবি আঁকেন। তার আঁকা ইদ মিছিল ও মুহরমের মিছিলের ৩৯টি ছবি পাওয়া যায়। সেই ছবিগুলো রক্ষিত আছে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে। তার মধ্যে ইদ মিছিলের ছবিগুলো থেকে অনেক তথ্য পাওয়া যায়। তখন নায়েব-নাজিমদের বসবাস ছিল নিমতলি প্রাসাদে। সেই প্রাসাদের ফটক থেকেই ইদ মিছিল শুরু হতো। নিমতলি প্রাসাদের ফটকটি এখন এশিয়াটিক সোসাইটির ঐতিহ্য জাদুঘর। সেখান থেকে মিছিল শুরু করে বিভিন্ন পথ প্রদক্ষিণ করে আবার সেখানেই এসে শেষ হতো।

বিজ্ঞাপন

সেদিনের সেই ইদ মিছিলে থাকতো সাজানো হাতি, উট, পালকি। সামনের হাতিতে থাকতেন নায়েব-নাজিম। নানারকম সাজসজ্জায় সেই মিছিল ছিল বর্ণিল। সঙ্গে বাজত নানা রকম বাদ্যবাজনা। সেখানেও সাধারণ বাঙালির ঠাঁই ছিল বলে ছবি দেখে মনে হয় না। ধারণা করা হয়, এই ইদ মিছিল আয়োজন অষ্টদশ শতকে শুরু হয়, নায়েব-নাজিমরাই ছিলেন এর পৃষ্ঠপোষক। সম্ভবত নায়েব-নাজিমদের পতনের পরেই এই ইদমিছিল বন্ধ হয়ে যায়।

পরে গত শতাব্দির আশির দশকে কিছুদিন এই ইদ মিছিলের আয়োজন হয় নতুনভাবে। সেটাও বেশিদিন টিকেনি। আজকাল একটি সংগঠন ইদের পরদিন ইদ মিছিলের আয়োজন করে, ঐতিহ্যটাকে না বুঝেই। হাতেগোনা কয়েকজন লোক সেই মিছিলে অংশ নেয়। এতে ঢাকাইয়া কেন সাধারণ মানুষের অংশগ্রহনও দেখা যায় না। যার কারনে এই মিছিল সার্বজনীন হয়নি।

বলছিলাম রোজার ইদ নিয়ে। ঢাকায় রোজার ইদের আয়োজনটা শুরু হয় রমজান মাসের প্রথম দিন থেকে। প্রথমে সবাই রোজা রেখে চলাফেরা, পোশাকে একটা পবিত্র পরিবেশের সৃষ্টি করে। চকবাজারের ইফতারের আয়োজন দেখে সহজেই অনুমান করা যায় ঢাকার বাসিন্দাদের অন্দরমহলের পরিবেশনা। পুরনো ঢাকার আদি বাসিন্দারা উৎসব- আনন্দ আচার-অনুষ্ঠানে নবাবদের রীতিই আদর্শ বলে মনে করেন। এখনও এসব আচার ও উৎসবে তাদের নবাবী ঢংয়ের প্রচলন আছে। আদি ঢাকার বাসিন্দা ও নাট্যকার সাইদ আহমদের শৈশবের স্মৃতি থেকে রোজার ইদ সম্পর্কে তথ্য তুলে দিলে বিষয়টা আরও পরিস্কার হওয়া যাবে-

‘ইসলামপুর থেকে কেনা রঙিন বাহারি পিস কাপড় নিয়ে আমার মা আর বোনেরা বসে যেতেন সেলাই মেশিন নিয়ে। একের পর এক অক্লান্তভাবে ইদের আগমনী আনন্দে মশগুল হয়ে সেলাই করে যেতেন। শুধু মেয়েদের পোশাক অর্থাৎ সালোয়ার, কামিজ, দোপাট্টা ইত্যাদি বানাতেন। পুরুষদের পোশাক আসতো দর্জির দোকান থেকে।

আমাদের জুতা আসত চীনা মুচির জুতোর কারখানা থেকে। ইদের নামাজ পড়ার জন্য চকবাজার থেকে আসতো নানা রঙ আর নানা ঢঙের টুপি। পাজামা, সিল্কের কুর্তা, টুপি আর চকচকে মচমচে জুতোর আওয়াজ তুলে পাড়ার সবাই মিলে দল বেঁধে নামাজ পড়তে যেতাম। সাধারণত আমরা পাড়ার মসজিদেই নামাজ পড়তাম, কখনও কখনও ইদের নামাজ পড়তে যেতাম ইদগায় হাফেজ বায়রাতের ইমামতিতে। আতর ও সুরমা অবশ্যই লাগাতে হতো। নামাজ পড়ে ফিরে এসে সবাই প্রথমে দুধে ভিজিয়ে রাখা সরু করে কাটা খোরমা আর সেমাইয়ের জর্দা খেতাম। তার কিছুক্ষণ পরেই অর্থাৎ এগারোটা-বারোটায় দুপুরের খাওয়া সেরে ফেলতাম। মসজিদ থেকে ফেরার পথে অনেকে বাড়িতে আসতেন। সবাই একসঙ্গে এক দস্তরখানে বসে সাদা পোলাও, কোর্মা, কালিয়া খেতেন। ইদের দিন এমন কোন বাড়ি ছিল না, যে বাড়িতে বিরিয়ানি, মোরগ পোলাও হতো না। প্রচুর পরিমানে এমন রান্না করা হতো যে পাড়া- প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন সবাইকে খাওয়ানো সম্ভব হতো। রাত পর্যন্ত চলতো মেহমানদারির পালা।’

‘ঢাকাইয়ারা’ পোষাক নিয়ে যেমন হুলুস্থুল করে, তেমনি হুলুস্থুল হয় ইদের খাবার আয়োজনে। এক সময় মোরগ পোলাও ইদের প্রধান খাবার ধরা হত। মহিলাদের হাতে তৈরি চুটকি সেমাই (দুই আঙ্গুলে তৈরি) ছিল ইদের অন্যতম মিষ্টান্ন। রোজার মাসব্যাপী এই সেমাই বানিয়ে শুকিয়ে রাখা হত। ইদের চাঁদ দেখার পর গরম পানিতে ধুয়ে ঘন দুধে রান্না করা হত। সেই সেমাইয়ে দেয়া হত কিসমিস, পেস্তাবাদাম। চুটকি সেমাইয়ের প্রচলন কমে গেলেও দুধ সেমাই, ফিরনি, মোরগ পোলাও, বিরিয়ানি, সাদা পোলাও, মাংশ, খিচুড়ি এখনও ঢাকাইয়াদের ইদের খাবারে থাকবেই।

ঢাকাইয়া সম্ভ্রান্ত পরিবারে এখনও ইদের দিনে মজাদার নানা রকম পোলাও-বিরিয়ানি রান্নার রেওয়াজ শেষ হয়ে যায়নি। আমি দু’একটি ঢাকাইয়া পরিবারে ইদের দিনে অতিথি হয়ে গিয়ে দেখেছি সবাই প্রায় আদি নিয়মকানুনে পোলাও মাংস রান্না করেন।

ইদ মানে আনন্দ। সেই আনন্দ ‘ঢাকাইয়াদের’ জামা-কাপড় এবং খাবারে দেখতে পাওয়া যায়। ইদের আনন্দ থাকে তিনদিন। পরের দুইদিন বাসি ইদ। এই তিনদিনই সবার মধ্যে আনন্দ চোখে পড়ে। ঢাকার ইদের পুরনো একটি ঐতিহ্য হলো চকবাজার ইদমেলা। শতবর্ষী পুরোনো এই মেলায় অতি সাধারণ জিনিসপত্র পওয়া যায়। সঙ্গে থাকে নানা রকম খাবার। ব্যস্ততম এই এলাকায় বন্ধের মধ্যে ইদের পরদিন জমে ওঠে মেলা। বাঁশি, মাটি ও কাঠের খেলনা, মাংসের বড়া, জিলাপি আরও অনেক কিছু। এই মেলা স্থায়ী থাকে তিনদিন।

এই মেলা এখন প্লাস্টিক পণ্যের বাজারে পরিণত হলেও এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে। এক সময় ঢাকাইয়ারা এই মেলায় কেনাকাটা করে ইদের ছুটি উপভোগ করতো। এখন কেবল নিন্মআয়ের মানুষদেরই এই মেলায় দেখা যায়। দেশ বিভাগের পর ঢাকার ইদ উৎসব পালনে ব্যাপ্তি বাড়ে। বিহার-পাকিস্তান থেকে আসা মুসলিমদের অংশগ্রহন ইদের আনন্দের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। তখনও এই দেশের মানুষ এই আনন্দের ভাগীদার কমই ছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ইদ উৎসবের উৎকর্ষতা লাভ করে। এই দিনে নতুন পোশাক পরে নামাজে বেরিয়ে পড়েন সবশ্রেনীর মানুষ। বর্তমানে ইদ সার্বজনীন এক মহাউৎসব। এই উৎসবে সব ধর্মের মানুষ তিনদিনের ছুটি ভোগ করে।

একটা কথা না বললেই নয়, ঢাকার বসবাসরত মানুষের বেশির ভাগই নাড়ির টানে চলে যায় তার জন্মস্থানে। এখানে সে কাজ করে অর্থ উপার্জন করে। সেই অর্থ এবং ভালোবাসা কাজে লাগায় নিজের শহরে। এই শহর নিয়ে নেই তার কোন আগ্রহ ও মায়া। তারা যাচ্ছেতাইভাবে ব্যবহার করছে এই শহরটিকে। যার ফলে দেখা যায় জীবন-মরন সমস্যা নিয়েও তারা ছেড়ে যায় ঢাকা।

ঢাকাইয়া এবং যারা ঢাকার ছায়াতলে এসেছেন, তাদের নিয়েই বর্তমান ঢাকার বিশাল ইদ উৎসব। ঢাকার প্রধান ইদের জামাত হয় জাতীয় ইদগাহ ময়দানে। আশির দশকে জাতীয় ইদগাহ জায়গাটি ছিল একটি পুকুর। আশির দশকের শেষের দিকে এটিকে ভরাট করা হয়। ২০০০ সালে জাতীয় ইদগাহের রূপ পায়। সে বছর থেকেই এটি ইদের প্রধান জামাত হিসেবে বিবেচিত হয়।

এখানে ইদের নামাজে সাধারণের সঙ্গে অংশগ্রহন করেন রাষ্ট্রপতি এবং মন্ত্রীপরিষদের সদস্যরা। জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে হয় চারটি জামাত। ধানমন্ডি ইদগাহসহ নগরীতে শত শত ইদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়। নতুন পাঞ্জাবি পরে সবাই হাজির হয় ইদের জামাতে। বায়তুল মোকাররম, জাতীয় ইদগাহসহ কয়েকটি ইদ জামাতে নারীদের নামাজ আদায়ের ব্যবস্থা থাকে। নামাজ শেষে একে অপরের সাথে কোলাকুলি করে ইদের আনন্দ বিনিময় করে। পুরনো ঢাকার ঐতিহ্যবাহী মসজিদগুলো এবং শহরের সমস্ত মসজিদে ইদের জামাত শেষ হলে শহর জুড়ে উৎসবের রূপ পায়। দিনভর থাকে ইদের খাওয়া দাওয়ার ধুম। নতুন কাপড় পরে পরিবার নিয়ে মানুষ বের হয় বেড়ানোর জন্য। ইদের ছুটির দিনগুলোতে চিড়িয়াখানা, লালবাগ কেল্লা, আহসান মঞ্জিল, বিভিন্ন পার্কে মানুষে পরিপূর্ণ থাকে। সব মিলিয়ে ইদের দিনে ঢাকা উৎসবের নগরীতে পরিণত হয়।

ইতিহাস-ঐতিহ্য ঈদুল ফিতর সংখ্যা ২০২৩ ঢাকার ঈদ ফিচার মোহাম্মদ আসাদ মোহাম্মদ আসাদের 'ঢাকার ঈদ' সাহিত্য

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর