একজন অনন্যার গল্প বলি…
১৩ মে ২০১৮ ১৬:৪০
রাশেদা রওনক খান।।
একজন সত্যিকারের অনন্যার গল্প বলি আজ! একজন সফল কর্মজীবী মায়ের গল্প। আমার মা, অধ্যক্ষ প্রফেসর জোহরা আনিস। তরী, সামাজিক বুনন আয়োজিত ‘কীর্তিমান মা সম্মাননা ২০১৮’ লাভ করেছেন আমার মা । এর আগে ২০০৬ সালে রত্নগর্ভা সম্মাননা পেয়েছিলেন তিনি। মা কে নিয়ে লিখতে গেলে কথা ফুরোবে না। অল্প কথায় কীভাবেই বা তুলে ধরি আমার মায়ের অসাধারণ জীবন আর কীর্তি। আমি নিশ্চিত কখনোই তাঁর মত একই সাথে নিজে সফল ও সন্তানের সাফল্য ‘দুই কে এক’ করে ফেলতে পারবোনা, সেই ক্ষমতা আমার নেই। এই অক্ষমতাকে স্বীকার করেই আজকের কথাগুলো বলছি। আমার এই অনন্য মা এখনো এই ৭০ বছর বয়সেও সমাজ কর্ম করে চলছেন, নাতি নাতনিদের নিয়ম করে পড়তে বসান নিজের কাছে।
সন্তানদের মানুষ বানিয়েই শেষ হয়নি তাঁর পথ চলা, তিনি আমাদের বাড়িতে থাকা দুটো আপুকেও (যারা আমাদের সংসার দেখাশোনা করতেন এবং আমাদের দেখভাল করতেন) মানুষ করেছেন, যাদের একজন এখন সরকারি কলেজের শিক্ষক, এবং আরেকজন বেসরকারি কলেজের শিক্ষক। আমার খালারাও তাঁর কাছেই গড়ে উঠেছেন একটা সময় পর্যন্ত। এখনো খালারা তাদের সন্তানেরা কে কখন কি করবে, করছে, এসবের সিদ্ধান্ত মায়ের সাথে আলাপ করে নিয়ে থাকেন। নিজ পরিবার কেবল নন, পৃথিবীর সমস্ত মানুষের কেবল ভালো চায়, আর কিছু ভাবনা তাঁর মাথায় কখনো ঠাই পায়নি। অন্যের ভালো খবরে মন থেকে খুশি হয়ে দোয়া করেন, আর খারাপ খবরে কষ্টে নিমজ্জিত হয়ে যান আমার মা। সমাজ-সংসারের কোন তুচ্ছতা তাঁকে কোনদিন ছুঁয়ে যায়নি, বড়ত্বকে আলিঙ্গন করেছেন প্রতিমুহূর্তে, শিখিয়েছেন আমাদেরকেও তা।
জাফর ইকবাল স্যার একবার আমার বড় বোন (সিলেট শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক) কে বলেছিলেন, ‘তোমাদের বাসায় যদি বিড়াল পালতেন তোমার আম্মা, তাহলে সেও মানুষ হয়ে যেতো!’ প্রথম কথাটা শুনে না বুঝলেও পরে বুঝেছিলাম কেন তিনি এই কথা বলেছিলেন। আমরা অনেকেই সন্তান লালন পালন করি, কিন্তু কজন পারি এই ধরনের মায়েদের মত করে সন্তান মানুষ করে তুলতে? কজন পারি ১০০ ভাগ মানুষ বানিয়ে তুলতে? বেশিরভাগই আমরা সন্তানদের হয় ‘ছেলে মানুষ’, নয় ‘মেয়ে মানুষ’ হিসেবে গড়ে তুলি। কিছু ক্ষেত্রে ‘অমানুষ’ও। নয়ত সমাজ এতো নষ্টদের দখলে যেতনা….
আমার মা একদিকে কঠোর-কঠিন, অন্যদিকে নরম-কোমল। সত্যিকারের ‘ভালো মানুষ’ হিসেবে সন্তানদের গড়ে তোলা সাধনার বিষয়! এখন নিজে মা হয়ে সেটা আরও বেশি অনুধাবন করি। কি কষ্ট তিনি করেছেন আমাদের ‘মানুষ’ বানাতে। রাতের পর রাত তিন ভাই বোনের যার যার পরীক্ষার সময় জেগে থাকতেন। এভাবে জেগে থাকতে থাকতে সময়ের বিবেচনায় তিনি বছরে ক’টা রাত সম্পূর্ণ ঘুমিয়েছেন, তা বলা মুশকিল। ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে তিনি বাসায় চলে আসতেন আমাদের পড়ালেখা হচ্ছে কিনা, দুপুরের খাবার খেলাম কিনা, একটু ঘুমিয়ে নিলাম কিনা, তা দ্যাখার জন্য! ভাবলে এসব কল্পনার মত মনে হয়। আমার মায়ের স্বপ্ন ছিল, তাঁর দুই মেয়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবে (আমার নানা-নানু শিক্ষক ছিলেন এবং তিনি নিজেও শিক্ষক বলে হয়তো), আর একমাত্র ছেলে ডাক্তার হবে। তাই হয়েছে! স্বপ্ন পূরণের জন্য সাধনা করতে হয়। কোন কিছুই এমনি এমনি হয়ে যায়না। একমাত্র ছেলে তাঁর যে কিনা প্রচণ্ড মেধাবী (বোর্ডে ফার্স্ট স্ট্যান্ড করা), এসব ক্ষেত্রে মা- বাবারা একটু পক্ষপাতিত্ব করেন। কিন্তু ঘুণাক্ষরেও তিনি বা আমার বাবা কোনদিন আমাদের দুই বোনকে একমাত্র ছেলের চেয়ে একবিন্দু কম গুরুত্ব দেন নি, বরং কিছু ক্ষেত্রে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। কারণ, তাঁরা কখনো ভাইয়াকে ‘ছেলে মানুষ’ কিংবা আমাদের ‘মেয়ে মানুষ’ বানাতে চায়নি, চেয়েছিলেন তিনটি ‘ভালো মানুষ’ বানাতে।
আজ মা দিবসে একটি কথাই বলতে ইচ্ছে হচ্ছে, ‘মা, তোমার শিক্ষা আমাদের আজন্মের পাওয়া! এই ঋণ আমাদের পক্ষে শোধ করা সম্ভব নয়। তবে কথা দিচ্ছি, যে শিক্ষা তুমি আমাদের দিয়েছ, তাতে আমাদের তিন ভাইবোন দ্বারা কেউ কোনদিন আঘাত পাবেনা, পেলে কেবল ভালোবাসাই পাবে!’ তুমি আজীবন শিখিয়েছ আমাদের, এখনো প্রতি মুহূর্তে শেখাও যে, তোমাদের দ্বারা কেউ যেন কোনদিন আঘাত না পায়। তুমি আমাদের পড়ার টেবিলে প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে পড়তে বসলে দেখতাম, নিজের করা বাগান থেকে ফুল এনে টেবিলে সাজিয়ে রাখতে, আর বলতে ‘আমি চাই, আমার তিন সন্তান এই ফুলের মত হবে, যা কেবল চারদিক সুভাষিত করবে, ভালোবাসা দেবে।’ জানিনা মা, আমরা তোমার সেই ফুল হতে পেরেছি কিনা, পারবো কিনা, কিন্তু সত্যি বলছি মা, আমরা আজন্ম তোমার এই চাওয়াকেই সম্মান জানিয়ে যেতে চাই, আমরা চেষ্টা করে চলছি, তুমি কেবল পাশে থেকো। এখনো কোন সিদ্ধান্ত নিতে তিন ভাই বোন বসে থাকি তোমার মুখপানে চেয়ে। এখনো তোমায় ছাড়া প্রতি মুহূর্তে অসহায় বোধ করি। এখনো তোমার গা ঘেঁষে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে ইচ্ছে হয়। এখনো প্রতি মুহূর্তে মিস করি মা তোমায়…
কঠিন শাসন আর অপরিসীম সোহাগ ভালোবাসা দিয়ে কিভাবে সন্তানকে নিজের মায়াজালে বেঁধে সমাজের সকল অপশক্তির ছায়া থেকে দূরে রাখতে হয়, তা শেখাটাই আমার মত এখনকার মায়েদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ! বিধাতার কাছে একটাই চাওয়া, শতায়ু হও, মা। তোমার মত মা হতে চাওয়াটা ধৃষ্টতা হয়ে যাবে, কেবল শতভাগের এক দশমাংশ পরিমাণও যদি তোমার মত হতে পারি, তাহলেই জনম সার্থক হবে, মা!
লেখক – সহকারী অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সারাবাংলা/আরএফ