উদীয়মান বাংলাদেশ অস্তাচলে গিয়েছিল যেদিন
১৫ আগস্ট ২০২৩ ১৭:৩০
বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে মূলত স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশকেই খুন করার অপচেষ্টা করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, হাজার বছরের বহমান জাতীয় সংষ্কৃতি এবং মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে ভূলুণ্ঠিত করা হয়। উগ্রবাদ ও অসহিষ্ণুতার রাজনীতি শুরু হয় দেশে। বাংলাদেশকে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে প্রমাণ করতে কুঠারাঘাত করা হয় অর্থনৈতিক সংষ্কার পরিকল্পনাগুলোতে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলকারী সরকারগুলোর সঙ্গে রাতারাতি পাকিস্তানি জান্তা ও উগ্রবাদী কিছু রাষ্ট্রের অভিনব সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
মার্কিন কংগ্রেসের লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত থাকা যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত হাওয়ার্ড বি শ্যাফারের পাঠানো তথ্য থেকে তৎকালীন পরিস্থিতি সম্পর্কে অনেক কিছু জানা যায়। তিনি জানিয়েছিলেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমান—১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য যাকে মূল্যায়ন করা হয়, তাকে হত্যা ও তার সরকারকে যখন উৎখাত করা হয়, তখন আমি ইসলামাবাদে আছি প্রায় এক বছর। এরপর বাংলাদেশে যে সরকারগুলো এসেছিল, তাদের মধ্যে পাকিস্তান ও কট্টর ধর্মভিত্তিক সংযোগের প্রতি উদার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। বিহারি হিসেবে পরিচিত আটকে পড়া পাকিস্তানিদের ফেরত পাঠানোসহ পাকিস্তানের সঙ্গে অমীমাংসিত যেসব ইস্যু সমাধানে বঙ্গবন্ধুর সরকার বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছিল, সেগুলো তখন গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। আটকে পড়া পাকিস্তানিদের পাকিস্তানে ফেরার আগ্রহের বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তান সরকারের কাছে সময় সময় তুললেও, এ বিষয়ে বাংলাদেশের তৎকালীন সরকারগুলোর খুব একটা আগ্রহ ছিল না।’
এই হাওয়ার্ড বি শ্যাফার ১৯৮৪ থেকে ১৯৮৭ সালে ঢাকায় রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সময় পাকিস্তানে মার্কিন দূতাবাসের রাজনৈতিক কাউন্সেলর ছিলেন। ১৯৭৭ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত তিনি ভারতেও মার্কিন দূতাবাসের রাজনৈতিক কাউন্সেলর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। দক্ষিণ এশীয়ার পরিস্তিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করতেন তিনি।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এক্সিকিউটিভ ইন্টেলিজেন্স রিভিউ (ইআইআর)-থেকে জানা যায়, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত ১৫ জনকে জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার ১৬ দিন পর, ১৯৭৫ সালের ৩১ আগস্ট, পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ মিত্র চীন বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোরবিরোধী সৌদি আরব বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পরপরই বাংলাদেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পাকিস্তান রেডিও বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের খবর জানানোর পাশাপাশি গৌরবের সঙ্গে প্রচার করেছিল, ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ নাম বদলে ‘ইসলামিক প্রজাতন্ত্র বাংলাদেশ হয়েছে’। তবে বাংলাদেশের নাম বদলানোর বিষয়টি পরে অস্বীকার করা হয়। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে বাংলাদেশের ওপর স্বাধীনতাবিরোধী আন্তর্জাতিক বলয়ের প্রভাব শক্তিশালী হয়। তারা নিজেদের ভাবধারার প্রচারের পেছনে বাংলাদেশে অর্থ লগ্নি করে।
মুজিব হত্যার মাধ্যমে ঘাতকরা মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনায় আঘাত হানে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ শুধু দেশ স্বাধীনের লড়াই ছিল না, এটি ছিল অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গঠনের জনযুদ্ধ। ভাষা আন্দোলনে বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষার যে জাগরণ শুরু হয়, তারই পরিপূর্ণ প্রকাশ ঘটে মুক্তিযুদ্ধে। ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায় নির্বিশেষে সাধারণ মানুষ অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিল একটি ন্যায়সঙ্গত আবাসস্থল প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর দেশ গিয়ে পড়ে প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর হাতে।
প্রতিক্রিয়াশীল চক্র ও স্বৈরশাসকরা প্রথমেই ‘জয় বাংলা’র পরিবর্তে পাকিস্তানি কায়দায় উর্দু শব্দে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’-এর প্রচলন করেন। ‘বাংলাদেশ বেতার’ এর নাম পরিবর্তন করে ‘রেডিও বাংলাদেশ’ করা হয়। সংবিধানের মূলনীতির পরিবর্তন ঘটিয়ে একে সাম্প্রদায়িক চেহারা দেওয়া হয়। বাংলাদেশকে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত করা হয়। ৭১-এর যুদ্ধাপরাধী, রাজাকার, আলবদরদের পুনর্বাসন করা হয়। হত্যা করা হয় জাতীয় চার নেতাকে।
যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমকে দেশে ফিরিয়ে আনা, জামায়াত-শিবিরের রাজনীতিকে বৈধতা দান ও তাদের ক্ষমতায়ন করাই ছিল ১৯৭৫ পরবর্তী সরকারগুলোর মূল কাজ। ১৫ আগস্টের পর থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে একের পর এক সেনা অভ্যুত্থান, সেনাবাহিনীর অন্তর্দ্বন্দ্ব, মুক্তিযোদ্ধা সেনাসদস্যদের হত্যা ও তাদের ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া চলে। ৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর থেকে ১৯৮১ সালের ৩০ মে পর্যন্ত সময়ের মধ্যে ২২টি সেনা অভ্যুত্থান ঘটে, যা দেশের চরম অরাজক চিত্রই তুলে ধরে।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ভূলুণ্ঠিত করে এ দেশে পাকিস্তানি ধ্যান-ধারণার পুনর্প্রচলনের অপচেষ্টা চলে। পাঠ্যপুস্তক থেকে বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে ফেলার সব রকম চেষ্টা দেখা যায়। গণআন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিকৃত করা হয়। এমনকি জাতীয় সংগীতেরও অবমাননা করা হয় বিভিন্নভাবে। সেসময় অনেক সরকারি অনুষ্ঠানেও জাতীয় সংগীতের পরিবর্তে শুধু সুর বাজানো শুরু হয়েছিল।
মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাদের দ্বারা নির্যাতিত নারীদের পুনর্বাসনের কাজ বন্ধ হয়ে যায় এবং সামাজিকভাবে তাদের হেয় করা হয় বা একঘরে করা হয়। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসনের কাজও কার্যত বন্ধ হয়ে যায়। গণতন্ত্রকে রুদ্ধ করে চলে স্বৈরতন্ত্রের তাণ্ডব। বঙ্গবন্ধু হত্যা তাই জাতির জন্য বয়ে আনে দীর্ঘস্থায়ী দুর্ভাগ্যের কালো মেঘ।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে থমকে দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশকে। ধ্বংস করা হয়েছে সদ্য-স্বাধীন একটি দেশের অর্থনীতি ও সংস্কৃতি গড়ে তোলার প্রক্রিয়া। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ধনী-গরিব নির্বিশেষে সব শ্রেণির মানুষ অংশ নিয়েছে। তাই বঙ্গবন্ধু এই দেশকে সবার জন্য সমানভাবে গড়তে চেয়েছিলেন। কৃষির আধুনিকায়ন ও শিল্পভিত্তিক নিজস্ব অর্থনীতি ব্যবস্থা চালু করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তার পরিকল্পনায় সাধারণ মানুষের জন্য যেসব কর্মসূচি ছিল, তাকে হত্যার পর সেগুলো আস্তে আস্তে পিছিয়ে পড়েছে।
বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু সারা দেশে কৃষিভিত্তিক সমবায় আন্দোলনের যে ডাক দিয়েছিলেন, সেই সময়ে এটা একটা বড় ধরনের প্রগতিশীল অর্থনৈতিক উদ্যোগ ছিল। ভূমির মালিক, চাষি কৃষক ও সরকার মিলে সমবায়ের ভিত্তিতে উৎপাদিত ফসল বণ্টন করে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মাস্টারপ্লান ছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুতে থমকে যায় দেশের উন্নয়ন পরিকল্পনাগুলো।
আজকে যে আমরা টেকসই উন্নয়নের কথা বলছি, জাতিসংঘ যে টেকসই উন্নয়নের ডাক দিয়েছে, তার মূল কথা হলো— কাউকে বাদ দেওয়া যাবে না। সবাইকে উন্নয়নের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে এবং ন্যায্যভাবে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এটা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আছে। বঙ্গবন্ধুর চিন্তাভাবনা ও তার বক্তব্যে এবং রাজনৈতিক কর্মসূচিতে এসব দিক প্রতিফলিত ছিল। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু প্রথম যে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা করেছিলেন, তা বাস্তবায়ন করতে পারেননি। তাকে হত্যার মধ্য দিয়ে দেশ অনেক দূরে পিছিয়ে গেছে। কৃষিতে যে উন্নয়নের টার্গেট বঙ্গবন্ধু করেছিলেন, তা এতাদিনে এসে বঙ্গবন্ধুকন্যার হাত ধরে অর্জিত হয়েছে।
যাদের কোনো রাজনৈতিক দর্শন ছিল না, বঙ্গবন্ধুর হত্যার মধ্য দিয়ে তাদের হাতে দেশ ও রাষ্ট্র পরিচালনা হয়েছে। ফলে দেশের আর্থিক ভিত্তি দুর্বল হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে আমদানি ও ঋণনির্ভর অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছিল।
এরশাদ আমলে এদেশে ৯০ শতাংশ বাজেট হয়েছে ঋণনির্ভর। বঙ্গবন্ধু হত্যার মধ্য দিয়ে দেশ ঋণ ও আমদানিনির্ভর হয়ে গেছে। নিজস্ব শিল্প-কারখানা ধ্বংস হয়েছে। পাটশিল্প ধ্বংস হয়েছে। ব্যবস্থাপনাগত দুর্বলতায় রাষ্ট্রীয় শিল্প-কারখানা ধ্বংস হয়েছে। অর্থনৈতিকভাবে দেশ দুর্বল হয়ে গেছে। অর্থনীতি, গণতন্ত্র ও সুশাসন ধ্বংস করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু জীবিত থাকলে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার আলোকে বাংলাদেশ এগিয়ে যেত।
বঙ্গবন্ধুর পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ধার করেছিলেন মালয়েশিয়ার তৎকালীন অর্থমন্ত্রী মাহাথির বিন মোহাম্মদ। পরবর্তীতে সেই পথ ধরে মালয়েশিয়া উন্নত আধুনিক রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। অথচ বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে বাংলাদেশ পরিণত হয়েছিল অভাব-অনটনের দেশে, যার ফলে দেশে বিস্তার লাভ করে উগ্রবাদ।
সারাবাংলা/এসবিডিই