গেরিলাদের তোপে বিপর্যস্ত স্টেট ব্যাংক
২ নভেম্বর ২০২৩ ১৭:২২
একাত্তরে পাকিস্তানী দখলদার জেনোসাইডারদের ঢাকায় অন্যতম স্ট্রংহোল্ড ছিল মতিঝিল কমার্শিয়াল এলাকার স্টেট ব্যাংক ভবন। পাকিস্তানীরাও স্টেট ব্যাংক অফ পাকিস্তান আগলে রাখতো অসম্ভব সতর্কতার সাথে। সকালে দুপুরে বিকালে রাতে প্রতি চার ঘন্টা পর পর পালাক্রমে পাহারা বদল হত। ব্যাংকের প্রত্যেকটা প্রবেশদ্বার স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র হাতে পাহারা দিত সশস্ত্র পাকিস্তানী সেনারা। ব্যাংকের একপাশে তৈরি করা হয়েছিল বাঙ্কার। তার আড়ালে ছিল পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশের সার্বক্ষণিক পাহারা। আর ব্যাংক ভবনের গা ঘেঁষে ছিল পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশের দুটো ক্যাম্প। অর্থাৎ চোখ এড়িয়ে ব্যাংকে ঢোকার কোন উপায় নেই, কারো না কারো চোখে অবশ্যই পড়তে হবে।
সেই অতি সুরক্ষিত স্টেট ব্যাংক ভবনের দুর্ভেদ্য দুর্গ রীতিমত এফোঁড়ওফোঁড় করে ফেলেছিল ঢাকার আরবান গেরিলার দল। হানাদার পাকিস্তানী শাসকদের দম্ভ খান খান করে দিয়েছিল দুটো প্রচন্ড বিস্ফোরণ। একটি বিস্ফোরণ কাঁপিয়ে দিয়েছিল ব্যাংকের প্রবেশদ্বার, অন্য বিস্ফোরণে টুকরো টুকরো হয়ে ছিটকে পড়েছিল ব্যাংকের ছয়তলার দরজা-জানালা। ব্যাংকের ছয় তলায় তখন ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গর্ব কমান্ডো বাহিনীর কয়েকজন জওয়ান, যার ফলে এখানে হামলা ফেলে আরো মারাত্মক প্রভাব।
আগস্ট মাসের শুরুতে জানা গেল, পি আই এ (পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ার লাইন্স)-এর এক ফ্লাইটে ঢাকায় আসছেন কুখ্যাত বাঙ্গালী বিরোধী কর্মকর্তা এস ইউ দূররানি। স্টেট ব্যাংক অফ পাকিস্তানের গভর্ণরের দায়িত্ব নিয়ে আসছে সে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধান কার্যনির্বাহীদের চারদিনব্যাপী এক সম্মেলন উদ্বোধন করতে ঢাকা আসছে সে। তার উদ্দেশ্য হিসেবে পত্রিকাগুলোতে লেখা হলোঃ তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের ঋণদান ব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক সমস্যা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করে সমস্যা দূর করতে কার্যকরী সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতিকে কার্যক্ষম করে তোলার ব্যাপারে আলোচনা ও কার্যকরী পন্থা নিরূপণ।
ঠিক হলো মূল অপারেশন চালাবে ৫ জন আরবান গেরিলা। সিরাজ, মুজিব, আজহার, হাবীব, খালেদ। অস্ত্রের মধ্যে ছিল একটা স্টেনগান ও দুটো হ্যান্ডগ্রেনেড। আর ২০ পাউন্ডের পি-কে অর্থাৎ প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিভ এবং ৭ সেরের স্প্লিন্টারের একটা “প্লেটার চার্জ” তৈরি করা হলো। ঘটনার দিন বেলা বারোটার সময় রেকি করলো আজহার ব্যাংকের একজন পিওনের সহায়তায়। কমলাপুরের কোন এক বাসায় ছিল ওদের ক্যাম্প। সেখান থেকে সন্ধ্যা ছয়টায় সবাই রিকশায় চেপে রওনা হলো। ঠিক হলো, সিরাজ এবং আজহার বিস্ফোরক প্লেটারটি নিয়ে গিয়ে ব্যাংকের উত্তর দিকের গেটে পুলিশদের বাংকারের পাশে বসবে। মুজিব হাতের আড়ালে লম্বালম্বিভাবে স্টেনগানটা নিয়ে বসলেন লুকিয়ে রেখে, কাভার দেবেন যদি প্রয়োজন হয়। হাবিব ও খালেদ গ্রেনেড নিয়ে তৈরি থাকবে অদূরে গ্লাক্সোর মতিঝিলে অবস্থিত দফতর ভবনের কাছে।
সিরাজ ও আজহারের রিকশা এসে দাঁড়াল বাংকার ঘেঁষে পাশের রাস্তায়। ওপাশে এক চিলতে ছোট্ট একটা খাল। লোকজন সে খাল পেরিয়ে সবসময় যাতায়াত করে। ওরা এমনভাবে নামলো যেন মনে হলো ওরাও একইপথের যাত্রী। হাতে কিন্তু প্লেটার চার্জের বাক্স। সেটা নিয়ে এমন ভঙ্গিতে বাংকারের পাশের রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে দেখে যে কেউ মনে করবে ভারী বাক্স টানতে টানতে হয়রান হয়ে গেছে, তাই বয়ে নেবার পথে একটু জিরিয়ে নিচ্ছে। মুশকিল হলো যে বাক্সটা দেখতেও খুবই বিদঘুটে এবং সন্দেহজনক, ফলে যা হবার তাই হল। প্লেটার চার্জের বাক্সটা দেখে সন্দেহ করে বসলো বাংকারের ওপাশে পাহারারত পুলিশের দল। তারা এগিয়ে এলো, অবস্থা বেগতিক দেখে সিরাজ ও আজহার দূরে সরে গেলেন। অদ্ভুত এই বস্তুটা দেখতে পুলিশের পাশাপাশি কিছু পথচারীও জুটে গেল। মুজিব কোনভাবেই আর ঝুঁকি নিতে রাজী হল না, সাথে সাথে ছুটে এলো। কারণ এই প্লেটারটা সেই সময়ের হিসেবে বেশ দামী একটা বোমা ছিল, বানাতে প্রায় আড়াইশো টাকারও বেশি খরচ হয়েছিল গেরিলাদের।
মুজিবের পেছন পেছন কিছুটা দুরত্ব বজায় রেখে থাকলেন সিরাজ ও আজহার। বিদ্যুতবেগে মুজিব ছুটে এসে ভিড় ঠেলে ঢুকে দ্রুতগতিতে চার্জকে ইগনাইট করল তার জ্বলন্ত সিগারেটের আগুন থেকে। ইগনাইট করেই সাথে সাথে সেখান থেকে ভ্যানিশ হয়ে গেল। লোকজন ভ্যাবাচ্যাকা অবস্থায় কিছু বুঝে ওঠার আগেই বাক্স দেখে এগিয়ে আসা পুলিশের দল বাংকারের আড়ালে চলে গেল। তাদের লুকিয়ে যেতে দেখে জড়ো হওয়া লোকজনও ছিটকে পালাতে শুরু করল। দেখতে না দেখতেই কিছুক্ষণ পর প্লেটার চার্জ বিস্ফোরিত হলো বাংকার উড়িয়ে। কেঁপে উঠলো পুরো মতিঝিল এলাকা।
একাত্তরের অক্টোবরের ২০ তারিখে দ্বিতীয় হামলায় কেঁপে উঠলো স্টেট ব্যাংক অফ পাকিস্তান। এই আক্রমণে ছিল মোট ৫ জন গেরিলা, যাদের মধ্যে ৪ জন হচ্ছে নাজমুল গ্রুপের গেরিলা সাদেক, আমান, জসীম এবং নাজমুল নিজে। পঞ্চম ব্যাক্তিটি হচ্ছেন স্টেট ব্যাংকের একজন কর্মচারী। এই অপারেশনে ব্যবহার হয়েছিল ৮ পাউন্ড পি-কে। ব্যাংকের সেই সহযোগী কর্মচারী বন্ধুটিই সর্বপ্রথম গেরিলাদের জানালো যে ব্যাংকের ছয়তলায় টয়লেট রুমের পাশের কক্ষে আনা হয়েছে কয়েকজন বিশেষ ভদ্রলোককে। খোঁজ নিয়ে জানা গেল তারা হচ্ছে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর স্পেশাল ‘হায়ার ট্রেইনড কমান্ডো’। সম্ভবত নিরাপত্তা বাড়ানোর জন্য এবং মুক্তিবাহিনীকে হানাদার পাকিস্তানীদের শক্তি প্রদর্শন ও ভয় দেখানোর জন্যই তাদের আনা হয়েছে।
গেরিলারা সিদ্ধান্ত নিল ঠিক ঐ রুমেই বোমা হামলা চালানো হবে। কতটা অসমসাহসী দুর্ধষ হলে এমন চিন্তা করা যায়! পর পর দুই দিন রেকি হলো। পরিকল্পনা হল কমান্ডোরা দুপুরে যখন রুমে বিশ্রামে থাকবে, তখনই হামলা চালানো হবে। একটা ব্রিফকেসে সাজানো হলো পি-কে চার্জ। এর সাথে দেয়া হলো সাত মিনিটের ফিউজ ওয়্যার এবং একটা গ্রেনেড-৩৬।
নির্দিষ্ট দিনে সাদেক, আমান ও জসীম নির্দিষ্ট সময়ে স্টেট ব্যাংকের সম্মুখের রাস্তায় গাড়িতে করে বিস্ফোরকটা নিয়ে আসলো। সেখানে অপেক্ষা করছিল স্টেট ব্যাংকের সেই সহযোগী বন্ধু কর্মচারীটি, তার হাতে ব্রিফকেসটা পৌঁছে দিয়ে ওরা গাড়িতে চলে এলো। গাড়ির মধ্যে সবাই স্টেনগান হাতে বিস্ফোরণের শব্দ শোনার অপেক্ষা করতে থাকলো। এদিকে লুঙ্গি, পাঞ্জাবী, পাম্প সু পরা নাজমুল বাকিদের থেকে আলাদা থেকে বহু আগে থেকেই গেটের অদূরে অপেক্ষা করছিল। তার স্টেনগান লুকানো ছিল সুকৌশলে, যদি কোন গড়বড় হয় ব্যাকআপ দেবার জন্য ছিল সে।
কিন্তু কোন গড়বড় হয়নি, স্টেট ব্যাংকের কর্মচারী বন্ধুটি পরিকল্পনা মাফিক টয়লেটে গিয়ে ব্রিফকেসটা যথাস্থানে স্থাপন করে কেস থেকে বেরিয়ে আসা ফিউজ ওয়্যারে ইগনাইট করল। তারপর প্যান্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে বেরিয়ে এলো খুবই স্বাভাবক ভঙ্গিতে যেন সে টয়লেটেই গিয়েছিল। ফিউজ ওয়্যার পুড়তে যদিও সামান্য গড়বড় করেছিল, কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই ঘটলো প্রচন্ড বিস্ফোরণ। হতাহত হলো পাকিস্তানীদের স্পেশাল কমান্ডোর দলটি।
তথ্যসূত্রঃ
১। একাত্তরের ঢাকা/ সেলিনা হোসেন
২। স্বাধীনতা সংগ্রাম ঢাকায় গেরিলা অপারেশন/ হেদায়েত হোসেন মোরশেদ
সারাবাংলা/এসবিডিই