ভিনদেশি সংবাদমাধ্যমে একাত্তরের কথা (দ্বিতীয় পর্ব)
১১ ডিসেম্বর ২০২৩ ১৫:০৬
বিদেশী সংবাদপত্রে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ কীভাবে প্রতিফলিত হয়েছিল তার পর্যালোচনা একটি কৌতূহলোদ্দীপক বিষয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের কথা বাদ দিলে বিভিন্ন দেশের সংবাদপত্রে প্রকাশিত অনেক সংবাদ প্রতিবেদন প্রধানত চর্বিত চর্বণ। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এগুলো বার্তা সংস্থা এপি বা রয়টার্সের খবরের হুবহু প্রতিলিপি অথবা নিউইয়র্ক টাইমস, লন্ডন অবজারভার, গার্ডিয়ান, ডেইলি টেলিগ্রাফ, ভারতের দ্য স্টেটসম্যান প্রভৃতি সংবাদপত্রের বিলম্বিত প্রতিধ্বনি মাত্র।
এ সত্ত্বেও ১৯৭১-এ আমরা বেশ কয়েকটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন দেখি; ১০-১৫ জন সাংবাদিকের একনিষ্ঠ তত্পরতা লক্ষ করি। পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞ সম্পর্কে বিশ্ববাসীকে অবগত করার ব্যাপারে সাইমন ড্রিং ও অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের ভূমিকা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে বিশেষভাবে লিখিত থাকবে। এছাড়া সিডনি শনবার্গ, মাইকেল লরেন্ট, লেয়ার লেভিন, জ্যাক এন্ডারসন, পিটার ডান, ড্যান কোগিন, নিকোলাস টোমালিন, ক্লেয়ার হোলিংওয়ার্থ, মার্টিন ওলাকট, জন পিলজার, ডেভিড লোশাক, পিটার হ্যাজেলহাস্ট, আর্নড ডি বর্চগ্রেইভ প্রমুখের অবদান স্মরণীয় হয়ে থাকবে। এরা বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে অনুপূর্ব আগ্রহী ছিলেন এবং ধারাবাহিকভাবে বিশ্ববাসীকে পাকিস্তানিদের নিপীড়ন ও বাঙালিদের দুর্দশার কথা অবগত করে গেছেন। সর্বোপরি লন্ডন থেকে প্রচারিত বিবিসি রেডিওর অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ব্রিটিশ সাংবাদিক মার্ক ট্যালির সঙ্গে ভারতের যোগাযোগ ঘনিষ্ঠ। তিনি প্রতিদিন সীমান্ত, শরণার্থী শিবির ও যুদ্ধক্ষেত্র ঘুরে তথ্য সংগ্রহ করেছেন; যা বিবিসি রেডিওতে অবিলম্বে প্রচারিত হয়েছে। অন্যদিকে মার্কিন ও ইউরোপীয় সংবাদপত্রে অনুমানপ্রসূত খবর প্রকাশিত হতে দেখা যায় না। তারা সতর্কতার সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনাবলি প্রচার করার পক্ষপাতী ছিলেন।
এই সম্পর্কে বিদেশী সংবাদমাধ্যমে যেভাবে এসেছিল একাত্তরের কথার প্রথম পর্বে (প্রথম পর্ব: লিংক যাবে) বিস্তারিত আছে। আজ থাকছে লেখাটির দ্বিতীয় কিস্তি-
ঘ. এপ্রিলে প্রথম বাংলাদেশ সরকার গঠন সম্পর্কে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে যে খবর প্রচারিত হয়েছিল তা অপ্রতুল। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল শনিবার বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন তাজউদ্দীন আহমদ। এরপর বাংলাদেশ সরকারের প্রথম মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা মন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। ভারত সরকারের সার্বিক সহায়তায় বাংলাদেশের মাটিতে কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুরের ভবের পাড়ে বৈদ্যনাথতলা আম বাগানে অনুষ্ঠানটির আয়োজন করা হয়েছিল। কথিত আছে ভারতীয় সাংবাদিকদের সঙ্গে অনেক বিদেশী সাংবাদিকও এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। ১৮ এপ্রিল কলকাতার যুগান্তর পত্রিকার শিরোনাম ছিল ‘প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অভ্যুদয়’। কিন্তু এ অনুষ্ঠানের খবর বা বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র বিশ্বব্যাপী তেমন প্রচার লাভ করেনি। বলা বাহুল্য, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের স্বাধীনতার ঘোষণা আর প্রবাসী সরকার গঠন ছিল স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার অনস্বীকার্য ভিত্তি চিহ্ন।
আরও পড়ুন: ভিনদেশি সংবাদমাধ্যমে একাত্তরের কথা (প্রথম পর্ব)
ঙ. বিদেশী পত্রপত্রিকায় মুক্তিযুদ্ধের খবরাদি তেমন গুরুত্ব লাভ করেনি। ৫ জুলাই ১৯৭১ বিবিসি রেডিওতে প্রচারিত মার্ক ট্যালির একটি প্রতিবেদনের একাংশ নিম্নরূপ: ‘পূর্ব পাকিস্তানে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসার বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রয়েছে বলেই মনে হচ্ছে। গত শুক্রবার বিদ্যুৎ সরবরাহের পাইপলাইন আবার নাশকতার শিকার হয়েছে, কিন্তু এবার ঢাকায়। ঢাকার একাংশে ২৪ ঘণ্টা কোনো বিদ্যুৎ সরবরাহ ছিল না। সপ্তাহান্তে ঢাকায় বেশ কয়েকটি বোমা আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে। গত সপ্তাহে ময়মনসিংহের উত্তরে সরিষাবাড়ী বাজারে বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এ কারণে সেনাবাহিনী এসে পুলিশের থানা দখল করে অবস্থান নিয়েছে। সরিষাবাড়ী পাটকলে গাঁট বাঁধার কাজ পুরোপুরি থেমে আছে। পরিস্থিতি শান্ত হয়ে আসছে। শুক্রবার রাতে পাবনায় অগ্নিকাণ্ড ও বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। গত সপ্তাহে রাজশাহীতে একটি ব্রিজ উড়িয়ে দেয়া হয়েছে। শনিবার রাতেও সেখানে অগ্নিকাণ্ড ও বোমা বিস্ফোরণ হয়েছে। রাজশাহীর কর্তৃপক্ষ জানাচ্ছে, ভারতের দিক থেকে আসা অনুপ্রবেশকারীদের গঙ্গা নদী অতিক্রমের প্রচেষ্টা চলাকালে সেনাবাহিনী গুলিবর্ষণ করে। কিন্তু কিছু গোলাগুলি সেদিকে হয়ে থাকলেও অন্যদিক থেকেও গুলির শব্দ পাওয়া গেছে। গেরিলা অভিযানগুলোর সঠিক মূল্যায়ন করা বেশ শক্ত, কারণ পূর্ব পাকিস্তানের কর্তৃপক্ষ এ নিয়ে উদ্বিগ্ন এবং অনেক কিছুই চেপে যাচ্ছে। এটা ঠিক, বর্তমান পরিস্থিতিতে এসব খবরের আনুষ্ঠানিক সূত্র উল্লেখ করা যাচ্ছে না, সব মিলিয়ে মনে হচ্ছে লোকজন যাতে সরকারকে সহযোগিতা করতে না পারে এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড যাতে বাধাগ্রস্ত করা যায়, সে লক্ষ্যে অন্তত এ ধরনের বিক্ষিপ্ত সহিংসতা চলতেই থাকবে।’ বিবিসি রেডিওর এ রকম অনুপুঙ্খ যুদ্ধ বিবরণী বিদেশী পত্রপত্রিকায় নগণ্য।
চ. কলকাতা থেকে পরিচালিত বাংলাদেশ সরকারের কার্যক্রম সম্পর্কে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের তেমন আগ্রহ ছিল না। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বা প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের বক্তব্য সংবলিত কোনো একটি সংবাদ বিদেশী সংবাদপত্রে দৃষ্টিগোচর হয় না। তবে এমনও হতে পারে যে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে পদ্ধতিগত বাধা সৃষ্টি করে রেখেছিল; হয়তো বিদেশী সাংবাদিকরা বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে আলোচনা করার সুযোগই লাভ করেননি। এর একটিমাত্র ব্যতিক্রম আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়েছে, যা যথাস্থানে আলোচনা করা হবে।
ছ. পাকিস্তানের কারাগারে আটক শেখ মুজিবের বিচার শুরু হয় আগস্টের ১১ তারিখে এবং তা শেষ হতে হতে নভেম্বর পার হয়ে যায়। এ সময় ১৯৭১ সালের ১৪ আগস্ট প্রকাশিত ডেইলি টেলিগ্রাফের সম্পাদকীয় নিবন্ধের শিরোনাম ছিল: ‘মুজিবকে কি মেরে ফেলা হয়েছে?’—অবশ্য পরদিনই সংশোধনমূলক সংবাদ মুদ্রণ করা হয়: ‘পূর্ব পাকিস্তানের নেতা শেখ মুজিবকে একজন সম্মানীয় রাজনৈতিক বন্দি হিসেবে কারাগারে সর্বোচ্চ মর্যাদা দেয়া হয়েছে’ (ডেইলি টেলিগ্রাফ: ১৫ আগস্ট ১৯৭১)।
জ. আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা ছিল পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য ভারতের যথাযথ সামরিক প্রস্তুতি সম্পর্কে অনবহিত থাকা। ভারত বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার গঠনে ত্বরিত সাহায্য করেছিল বটে কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনে, অস্ত্র সরবরাহে এবং প্রশিক্ষণ প্রদানে তারা বিলম্ব করেছিল। ভারতের ধারণা ছিল গেরিলা যুদ্ধ দিয়ে পূর্ব বাংলার মাটি থেকে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীকে হটানো সম্ভবপর হবে না। তাই তারা পূর্ণাঙ্গ সামরিক অভিযানের উদ্দেশ্য নিয়ে সময়সাপেক্ষ প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিল। তাদের লক্ষ্য ছিল শীতকাল শুরু হলে, বিশেষ করে মৌসুমি বৃষ্টিপাত বন্ধ হলে এবং নদীনালায় পানি শুকিয়ে গেলে পূর্ব পাকিস্তানে আক্রমণ করা।
ঝ. একইভাবে আগস্টের প্রথম সপ্তাহে সম্পাদিত দিল্লির সঙ্গে মস্কোর শান্তি চুক্তির তাত্পর্যও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম অনুধাবন করতে সক্ষম হয়নি। পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক অভিযান পরিচালনার জন্য ভারতের জন্য প্রয়োজন ছিল সোভিয়েত রাশিয়ার মতো একটি পরাশক্তির সমর্থন। পাকিস্তানকে সম্পূর্ণভাবে পরাভূত না করা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার সংকল্প ছিল ভারতের। তাই জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ‘যুদ্ধবিরতি’ প্রস্তাব পাস হওয়া ঠেকাতে সোভিয়েত সমর্থন ছিল অত্যাবশ্যকীয়। উল্লিখিত চুক্তির বদৌলতে ডিসেম্বরে জাতিসংঘের ‘নিরাপত্তা পরিষদে’ উত্থাপিত পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধবিরতির বিভিন্ন প্রস্তাবে সোভিয়েত রাশিয়া ১০ দিনে চারবার ভেটো প্রয়োগ করেছিল।
লেখক: অর্থনীতিবিদ ও সাহিত্যিক
সারাবাংলা/এসবিডিই
ফয়জুল লতিফ চৌধুরী ফিচার ভিনদেশি সংবাদমাধ্যমে একাত্তরের কথা (প্রথম পর্ব) মুক্তিযুদ্ধ