Wednesday 20 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

স্টেট ডিপার্টমেন্ট ইন্ডিয়া-পাকিস্তান সিচুয়েশন ডিসেম্বর রিপোর্ট

আন্দালিব রাশদী
১২ ডিসেম্বর ২০২৩ ১৪:১১

১৪ ডিসেম্বর ঢাকা সময় খুব ভোরে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মালিক ও মেজর জেনারেল (রাও) ফরমান আলী আলোচনার জন্য কনসাল জেনারেল স্পিভাককে আমন্ত্রণ জানান। পূর্ব পাকিস্তানে ‘রক্তস্নান’ এড়াতে ভারতীয় সেনাবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর সাথে যুদ্ধবিরতির একটি ‘আয়োজন’ করা যায় কিনা সে বিষয়ে আলোচনার জন্যই স্পিভাককে ডাকা। জেনারেল ফরমান আলী বলেছেন, পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনী ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এবং (ভারতীয় বাহিনীর তুলনায়) সংখ্যায় কম এবং তিনি নির্বিচার হত্যাকাণ্ড এড়াতে চাচ্ছেন।

বিজ্ঞাপন

তিনি (কনসাল জেনারেল) স্পিভাককে কথা দিলেন কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তার কাছে সুনির্দিষ্ট অস্ত্রবিরতি প্রস্তাব দেবেন, স্পিভাক যেন ওয়াশিংটন, ইসলামাবাদ ও কোলকাতায় কনসাল জেনারেলের কাছে পাঠিয়ে দেন। প্রশ্নের জবাবে ফরমান আলী বলেন, প্রস্তাবে তার নিজের এবং গভর্নর মালিক ও জেনারেল নিয়াজির স্বাক্ষর থাকবে এবং তাতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সম্মতিও থাকবে।

এই বার্তা প্রেরণের অল্প সময় পরই গভর্নর মালিক কনসাল জেনারেল স্পিভাককে টেলিফোনে জানান, জেনারেল নিয়াজি বলেছেন যুদ্ধবিরতির দরকষাকষির আলোচনা কেন্দ্রীয় সরকার ও রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ডের মধ্যে চলছে, কাজেই সংশ্লিষ্ট পক্ষের কাছে কনসাল জেনারেলের বার্তা পাঠাবার প্রয়োজন নেই। একটি জরুরি বার্তায় রাষ্ট্রদূত ও ফারল্যান্ড বলেছেন, ঢাকার বার্তার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি যুদ্ধবিরতির বিষয়টি জানার জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সাথে জরুরি সাক্ষাৎকার চেয়েছেন।

পূর্ব পাকিস্তান সরকার ভেঙ্গে গেছে

পূর্ব পাকিস্তানের চিফ সেক্রেটারিসহ প্রায় তিরিশজন উর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তা পদত্যাগ করেছেন এবং আন্তর্জাতিক রেডক্রসের ছত্রছায়ায় নিরপেক্ষ অঞ্চল ঢাকা ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাচ্ছেন। ঢাকার কনসাল জেনারেল মন্তব্য করেছেন এই কর্মকর্তা স্পষ্টতই এই উপসংহারে পৌঁছেছেন যে আর কোন আশা নেই। পূর্ব পাকিস্তানের বেসামরিক প্রশাসন বলে আর কিছু নেই।

শেষ খবর : গভর্নর মালিকও ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে (বর্তমানে রূপসী বাংলা) আশ্রয় প্রার্থীদের দলে যোগ দিয়েছেন।

নিরাপত্তা পরিষদের কার্যক্রম

সাধারণ পরিষদের প্রস্তাব বাস্তবায়ন করতে নিরাপত্তা পরিষদ যে সমর্থ হবে না তা আগেই অনুমান করা গেছে। অস্ত্রবিরতি ও উভয় পক্ষের সৈন্য প্রত্যাহার করতে মার্কিন খসড়া প্রস্তাব নিরাপত্তা পরিষদে আলোচনার জন্য ১৩ ডিসেম্বর ১৯৭১ সন্ধ্যায় পুনরায় অধিবেশন ডাকা হয়।

বিজ্ঞাপন

পূর্ব পাকিস্তানে মৌলিক রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটাতে সোভিয়েত ও ভারতীয় পীড়াপীড়ির কারণে প্রস্তাবটি এগোতে পারেনি। এ নিয়ে বিতর্কে অংশগ্রহণকারীদের কট্টর অবস্থান সোভিয়েত ও চাইনিজ প্রতিনিধিদের পরস্পরকে আপন করার সুযোগ করে দেয়।

ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী (সর্দার শরণ) সিংও বক্তব্য রাখেন। তিনি বলেন, আমেরিকার শান্তি প্রস্তাব যদিও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানেরই পরিকল্পিত প্রস্তাব, এতে বাংলাদেশের মৌলিক রাজনৈতিক সমস্যার কোন সমাধান নেই।

নিরাপত্তা পরিষদে ভোটের ফলাফল : পক্ষে এগারো (যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, চীন ও অন্যান্য) বিপক্ষে দুই (সোভিয়েত ইউনিয়ন, পোল্যান্ড) এবং অনুপস্থিতি দুই (যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স)।

ভোটের আগে নিরাপত্তা পরিষদের সিয়েরা লিওনিয়ান প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশ প্রতিনিধিকে অধিবেশনে আমন্ত্রণ জানানোর প্রস্তাব নাকচ করে দেন। তবে তিনি ব্যক্তি হিসেবে বিচারপতি (আবু সায়ীদ) চৌধুরীকে উপস্থিত থাকার অনুমতি দিয়েছিলেন।

পাকিস্তান শর্তহীন যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে আগ্রহী

১৩ ডিসেম্বর জাতিসংঘের প্রস্তাবে ভেটো প্রয়োগের পরিপ্রেক্ষিতে এর সুরাহার লক্ষে পাকিস্তান প্রতিনিধি ভুট্টো ও আগা শাহী অ্যাম্বাসেডর বুশের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন; তারা যুক্তরাষ্ট্রকে বলেন, যেন সোভিয়েত প্রতিনিধিকে জানানো হয় যে পাকিস্তান ভারতের সাথে সাধারণ শর্তহীন যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে রাজি; অন্যান্য বিষয়ে পরবর্তী কোন সময় নিরাপত্তা পরিষদ ব্যবস্থা নিতে পারবে।

যুক্তরাষ্ট্রের জাতিসংঘ মিশন ১৩ ডিসেম্বরের আলোচনা থেকে প্রায় সব দেশের প্রতিনিধিই মনে করেছেন ভবিষ্যত প্রস্তাবনায় ভারত ও সোভিয়েত সমর্থন পেতে রাজনৈতিক বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকবে। ১৪ ডিসেম্বর অপরাহ্নে পুনরায় নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক নির্ধারিত হয়।

নাগরিক প্রত্যাহার : সপ্তম নৌবহরের সম্ভাব্য যাত্রা

ভারত, পাকিস্তান, ওয়াশিংটন ও অন্যান্য স্থানের গণমাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম নৌবহরের সম্ভাব্য যাত্রা নিয়ে বিশেষ করে বিমানবাহী এন্টারপ্রাইজের (বঙ্গোপসাগর অভিমুখ) যাত্রা নিয়ে অনুমাননির্ভর সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে- দক্ষিণ এশিয়ার মার্কিন নাগরিকদের প্রত্যাহারের জন্য প্রস্তুত থাকতে এই আয়োজন। এর মধ্যে সংবাদমাধ্যম থেকে জানা গেছে ৩৬ জন জাতিসংঘ কর্মকর্তা এবং ৯০ থেকে ১০০ জন বিদেশী গত রোববার বয়াল এয়ারফোর্সের উড়োজাহাজে ৪২০ জন বিদেশীর চলে যাওয়ার পরও রয়ে গেছেন। সতেরজন হার্ডকোর আমেরিকান স্বেচ্ছায় ঢাকায় অবস্থান করছেন। বিদেশিদের অধিকাংশই স্বেচ্ছায় ঢাকা শহরে রয়ে গেছেন।

বাংলাদেশ জন-প্রশাসন

১১ ডিসেম্বর ভারতের সংবাদপত্র হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড এর প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে ভারত সরকার এবং বাংলাদেশ সরকার যত শীঘ্র সম্ভব একটি যৌথ বেসামরিক জনপ্রশাসন কর্তৃপক্ষ স্থাপনের পরিকল্পনা করেছে।

প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয় উভয় সরকারই এ অঞ্চলে ত্রাণ ও পুনর্বাসনকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেবে।

এই প্রতিবেদনের উপর মন্তব্য করতে গিয়ে কোলকাতায় কনসাল জেনারেল বলেন, বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ভারতীয় প্রশাসনিক সহায়তা গ্রহণ করার ধারণাটি চরমপন্থীদের অনুপ্রবেশ ঠেকানোর উদ্দেশ্য করা হয়ে থাকতে পারে। ভারত সরকারের শক্তিশালী উপস্থিতিতে পূর্ব বাংলার মানুষের কী প্রতিক্রিয়া হবে তা অনিশ্চিত, তবে ভারতীয়দের পূর্ব বাংলায় অবস্থানকাল প্রলম্বিত হলে তা অন্তহীন উদ্বেগের বিষয় হবে বলে মিশন মনে করে না।

জর্দানি ফাইটার উড়োজাহাজ পাকিস্তানে এসেছে বলে জানা গেছে

১১টি জর্দানি এফ-১০৪ ফাইটার উড়োজাহাজ ১২ ও ১৩ ডিসেম্বর দাহরান হয়ে পাকিস্তানের পথে রওয়ানা হয়েছে বলে আমাদের কাছে খবর এসেছে। আম্মান দূতাবাস তা নিশ্চিত কিংবা অস্বীকার করতে পারেনি যদিও কর্মকর্তাদের কেউ কেউ লক্ষ করেছেন ফাইটার পাইলটরা তাদের প্রিয় পানশালাগুলোতে অনুপস্থিত। ৫ ডিসেম্বরের পত্রে আম্মান দূতাবাস জানিয়েছে বাদশাহ হোসেনকে সামরিক সহায়তা বিশেষ করে এফ-১০৪-এর জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া অনুরোধ জানিয়েছেন।

সামরিক পরিস্থিতি

ধীর লয়ে সামরিক অপারেশন অব্যাহত রয়েছে। ভারতীয় বাহিনী এখন ঢাকার গোলন্দাজ সীমানায় এসে পড়েছে। ঢাকায় পাকিস্তানি জেনারেল নিয়াজি এখনো সাহসী প্রতিরোধের কথা বলে যাচ্ছেন কিন্তু গণমাধ্যমের খবরে জানা গেছে ঢাকা প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত সাধারণ সৈন্যদের মনোবল ভেঙ্গে গেছে। ভারতীয় প্রতিবেদনে পূর্ব পাকিস্তানের বগুড়ার আক্রমণের এবং খুলনায় যুদ্ধ চলার কথা বলা হয়েছে এবং পশ্চিম রণাঙ্গণ সম্পর্কে যথার্থই বলা হয়েছে যে সেখানকার অবস্থা তুলনামূলকভাবে শান্ত।

সিন এম হোলি
উপরিচালক অপারেশন্স

[বাস্তবতা হচ্ছে: এন্টারপ্রাইজ নিয়ে সপ্তম নৌবহর আসেনি; ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানের ‘বীর সৈন্যরা’ আত্মসমর্পন করে; বেসামরিক প্রশাসন দাঁড় করাতে যুদ্ধবিদ্ধস্ত দেশের প্রশাসকরাই যথেষ্ট ছিলেন, ভাতরকে নিয়ে যৌথ প্রশাসন চালু করতে হয়নি; বাংলাদেশে ভারতীয় সৈন্যদের অবস্থানও দীর্ঘস্থায়ী হয়নি।]

সারাবাংলা/এসবিডিই

আন্দালিব রাশদী ফিচার মুক্তিযুদ্ধ স্টেট ডিপার্টমেন্ট ইন্ডিয়া-পাকিস্তান সিচুয়েশন ডিসেম্বর রিপোর্ট

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর