নজিরবিহীন হত্যাকাণ্ডের কৃষ্ণ প্রহর
১৪ ডিসেম্বর ২০২৩ ১৩:৪৮
মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয় যখন দরজায় কড়া নাড়ছে তার ঠিক দু’দিন আগে এক নজিরবিহীন ঘটনার সাক্ষী হয় বাংলাদেশ। বিজয়ের প্রাক্কালে বেজে ওঠে বেদনার বিউগল, ৫৬ হাজার বর্গমাইল জুড়ে নেমে আসে অন্ধকার। ১৪ ডিসেম্বর, বাঙালি জাগরণের সূর্য সন্তান বুদ্ধিজীবীদের হত্যার মাধ্যমে পাকিস্তান তার ভয়ংকর নীলনকশা বাস্তবায়ন করে। এই নির্মমতার রূপকার ছিল একদিকে যেমন পাকিস্তান হানাদার সেনাবাহিনী, অন্যদিকে তাদের এ দেশীয় সহচর- আলবদর, রাজাকার ও আলশামস বাহিনীর নেতারা- যারা পরিকল্পিত পন্থায় এই নিধন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছে। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ যেনো মেধায়-মননে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে সেকারণেই মূলত এই বর্বর হত্যাকাণ্ড।
তবে বাঙালি জাতিকে সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও শিক্ষাগত দিক থেকে দুর্বল ও পঙ্গু করে দেওয়ার পরিকল্পনার বাস্তবায়ন তারা শুরু করে যুদ্ধের একদম শুরু থেকেই। অপারেশন সার্চলাইটের মাধ্যমে ২৫ মার্চ যে গণহত্যার সূচনা করে পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠী তা মূলত শুরুই হয় বুদ্ধিবৃত্তিক মানুষকে হত্যার মধ্য দিয়ে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, ফজলুর রহমান খান, গোবিন্দ চন্দ্র দেবসহ আরো অনেকেই ২৫ মার্চের কালরাত্রিতেই শহীদ হন। ঢাকার বাইরেও একই প্রক্রিয়ায় শিক্ষাবিদ, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী,রাজনীতিক, শিক্ষার্থীদের হত্যা করা হয়েছে। স্বাধীনতা যুদ্ধের পুরোটা সময় এথনিক ক্লিনজিং এর পাশাপাশি বুদ্ধিজীবী নিধন চলতে থাকে। কিন্তু ১৬ ডিসেম্বরের বিজয়ের পূর্বে যে বীভৎস নারকীয় হত্যাকাণ্ডের প্রামাণ্য দলিল পাকিস্তানীরা দিয়েছে তা পৃথিবীর ইতিহাসে কখনোই ঘটেনি। ১৪ ডিসেম্বর বিশ্বের শান্তিকামী মানুষ স্তম্ভিত হয়েছিলো, গোটা বিশ্ব অবাক হয়ে প্রত্যক্ষ করেছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রের বর্বরতা।
বুদ্ধিজীবীদের আলাদাভাবে টার্গেট করার পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ ছিলো। দেশভাগের পর বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিকাশে যে কয়টি আন্দোলন হয়েছে তার প্রায় সবকটির শুরুটা ছিলো বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন দিয়েই, যা পরবর্তীতে রাজনৈতিক আন্দোলনে রূপ নিয়েছে। প্রতিটি ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনেই আলোকবর্তিকা হয়ে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন বুদ্ধিজীবীরা।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বাঙালি জাগরণের শুরু। ভাষা আন্দোলনের পুরোটা জুড়েই বুদ্ধিজীবীদের অবস্থান। বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠার দাবীকে স্বাধিকার আন্দোলন থেকে রাজনৈতিক আন্দোলনে রূপ দিয়েছে। শুধু তাইনা, ৫৪’র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ৬২’র শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬’র ছয় দফা, ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ৭০’র নির্বাচন ও ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধসহ প্রতিটি ক্ষেত্রেই বুদ্ধিজীবী সমাজ সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটিয়েছেন।
পর্যায়ক্রমিক এই আন্দোলনের ফলেই জনগণ ধীরে ধীরে নিজেদের দাবি ও অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠতে থাকে যা পরবর্তীতে তাদের স্বাধীনতার আন্দোলনের দিকে ধাবিত করেছে। আর এই কাজটি সুচারুভাবে সম্পন্ন করেছেন আমাদের বুদ্ধিজীবীরা। বুদ্ধিজীবীরা একদিকে যেমন পূর্ব পাকিস্তানের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবিচারের ব্যাখ্যা দিয়েছেন, অপরদিকে বাঙালির সাংস্কৃতিক যুদ্ধকে ত্বরান্বিত করেছেন। এসব কারণেই বুদ্ধিজীবীরা পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও সামরিক জান্তার চক্ষুশূলে পরিণত হয়েছিলো। আর তাই পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে নিশ্চিত হার বুঝতে পেরে বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করার লক্ষ্যে ১৪ ডিসেম্বরের নারকীয় হত্যাযজ্ঞ ঘটায়। বাঙালি জাতি যেন শিক্ষা, সাংস্কৃতিক ও সামাজিকভাবে দূর্বল হয়ে পড়ে সে হীন উদ্দেশ্য নিয়েই বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশা প্রণয়ন ও বাস্তাবায়ন করে পাকিস্তানী শাসকেরা।
এ হত্যা অভিযানটি মূলত পরিচালিত হয় ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান বাহিনীর ঐতিহাসিক আত্মসমর্পণের আগ মুহূর্তে। ডিসেম্বরের ৪ তারিখ থেকেই ঢাকায় নতুন করে কারফিউ জারি করা হয়। ডিসেম্বরের ১০ তারিখ হতে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের প্রস্তুতি নেয়া হতে থাকে। এ হত্যার চূড়ান্ত পরিণতি আসে ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১, যেদিন তারা একমাত্র ঢাকা নগরীতেই ২০০ এর বেশি বুদ্ধিজীবীকে বাড়ি থেকে তুলে নেয় এবং নিষ্ঠুর পন্থায় হত্যা করে। যাঁদের মধ্যে ছিলেন অধ্যাপক, সাংবাদিক, শিল্পী, প্রকৌশলী, লেখক-সহ চিহ্নিত বুদ্ধিজীবীরা।
ঢাকাতে এই হত্যার ব্যাপকতা বেশি হলেও দেশের জেলা সদরেও চলে একই নিষ্ঠুরতা। হত্যা মিশনে নিযুক্ত অস্ত্রধারীরা গেস্টাপো কায়দায় তালিকাভুক্ত বুদ্ধিজীবীদের নিজ নিজ বাড়ি থেকে তুলে আনে, তাদের চোখ বেঁধে দেয়, তারপর ঢাকার মোহাম্মদপুর, নাখালপাড়া, মিরপুর, রাজারবাগের বিভিন্ন টর্চার সেলে নিয়ে যায়। বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে, গুলি করে এসব বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয় এবং রায়েরবাজার, মিরপুরের আলোকদি, কালাপানি, রাইনখোলা ইত্যাদি জায়গায় লাশ ফেলে রাখা হয়।
১৬ ডিসেম্বরের পর মুক্তি বাহিনী যখন ঢাকা শহরে প্রবেশ করে তখন তারা এদের লাশ দেখতে পায় বিভিন্ন নালা-ডোবায়। এদের প্রায় প্রত্যেকের হাত ও চোখ বাঁধা থাকে, শরীরের বিভিন্ন অংশে বেয়নেটের নির্বিচার আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়। সর্বমোট কতজন বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়েছে তার সঠিক হিসাব পাওয়া যায়নি। তবে বিভিন্ন পরিসংখ্যানে এ সংখ্যা এ রকম : শিক্ষাবিদ ৯৯১, সাংবাদিক ১৩, চিকিৎসক ৪৯, আইনজীবী ৪২, সাহিত্যিক ও শিল্পী ৯।
মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীকালে বিভিন্ন দলিলপত্র দেখে জানা গেছে, এ নৃশংস হত্যাযজ্ঞের মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন পাকিস্তানী সামরিক জান্তার মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী। বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিল পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর কর্নেল হেজাজি, মেজর জহুর, মেজর আসলাম, ক্যাপ্টেন নাসির ও ক্যাপ্টেন কাউয়ুমসহ প্রায় ১০ জন সামরিক ও বেসামরিক অফিসার। আর বুদ্ধিজীবীদের তালিকা প্রস্তুত ও হত্যাকাণ্ড বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে পুরো সহায়তা করে জামায়াতে ইসলামী কর্তৃক গঠিত কুখ্যাত আল বদর বাহিনী।
বুদ্ধিজীবী হত্যার প্রধান ঘাতক ছিলো আল বদর বাহিনীর আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, মতিউর রহমান নিজামী, চৌধুরী মঈনুদ্দীন ও প্রধান জল্লাদ আশরাফুজ্জামান খান। ১৬ ডিসেম্বরের পর আশরাফুজ্জামান খানের নাখালপাড়ার বাড়ি থেকে তার একটি ব্যক্তিগত ডায়েরি উদ্ধার করা হয়, যাতে বুদ্ধিজীবীর নাম ও বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের কোয়ার্টার নম্বরসহ লেখা ছিল। পরবর্তীতে বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে কয়েক বছর আগে নিজামী ও মুজাহিদের ফাঁসির রায় কার্যকর করেন মহামান্য আদালত।
বুদ্ধিজীবীদের হারিয়ে এ জাতি হোঁচট খেয়েছে বারংবার। স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় জাতির জনককে হত্যার মাধ্যমে বাংলাদেশের গতিপথকেই পাল্টে দেওয়া হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও জাতীয় চার নেতা হত্যার পর অচলায়তনের পাষাণবেদীতে ক্ষত বিক্ষত হয়েছে এ বাংলাদেশ, দেশের সংবিধান। দেশকে অসাম্প্রদায়িক ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপরীতে নিয়ে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বীজ বুনেছে শকুনেরা। চেতনার দিক থেকে পাকিস্তানের কাছাকাছি ফিরিয়ে আনার কাজটি করেছেন অনেক রাজনৈতিক নেতাই, দীর্ঘসময় থেকেছে মিলিটারি শাসন।
আর এসব কিছু সম্ভব হয়েছে প্রগতির পক্ষে কাজ করা জাতির সূর্য সন্তানদের হারানোর ফলেই। বুদ্ধিজীবীদের অগ্রণী ভূমিকার কারণে যেখানে ৪৭ থেকে ৭১ পর্যন্ত স্বাধীকার ও মুক্তির চেতনা গণচেতনায় রূপ নিয়েছে সেখানে মাত্র এক দশকের ব্যবধানে এতো অধঃপতন কেনো হয়েছিলো এ জাতির!
শিক্ষার এতো বিস্তার ঘটার পরেও মননে চিন্তায় কেন দৈন্যতা পরিলক্ষিত হয় সর্বত্র! এখন তাই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে আমাদের বুদ্ধিজীবীরা যে চেতনার ধারা তৈরি করেছিলেন, যে ধারায় এগিয়ে চলার পথ রচনা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু, আজ কি আমরা তারই ধারাবাহিকতায় পথ চলছি? আমরা কি সমাজের মানুষকে সঠিক শিক্ষা দিতে পারছি? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর যদি নিজেরা খুঁজি তবেই সমাধান সম্ভব।
অন্যথায় শুধু কাগজে কলমে জাতি শিক্ষিত হলেও মননে অন্ধকারেই থেকে যাবে জাতি। আমাদের মনে রাখতে হবে, বুদ্ধিজীবী সবসময়ই বিদ্যমান ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করে বদল ঘটাতে চায়। তাদের উপস্থিতি আর অনুপস্থিতির তফাৎ সমাজের বিদ্যমান কাঠামোকে পরিবর্তন করে দেয়। যেমন ফরাসি বিপ্লবের আগে বুদ্ধিজীবী শ্রেণির হাতে গড়ে উঠেছিল সে দেশের গণমানুষের মৌলিক জাগরণ, যা তাদের ঐতিহাসিক বিপ্লবের পথে ধাবিত করেছে। সেদিনকার পূর্ববঙ্গ, পূর্ব পাকিস্তান বা বাংলাদেশের বেলাতেও এমনটিই হয়েছিল। এই তফাৎটুকু আমরা বুঝতে পারলেই বুদ্ধিজীবীদের হারানোর মাধ্যমে এ জাতি কি হারিয়েছে তা উপলব্ধি করতে সক্ষম হবে!
মেধাশূন্য করার মাধ্যমে বাঙালিকে পঙ্গু জাতিতে পরিণত করার হীন চক্রান্ত যারা করেছিলো তাদের উত্তরসূরিরা এখনো বিদ্যমান এই সমাজে। বর্তমান প্রজন্মকে বিপথে পরিচালিত করার জন্য চুপিসারে তারা এখনো কাজ করে যাচ্ছে। কাজ করে যাচ্ছে একটি ভ্রান্ত প্রজন্ম তৈরি করতে, যে প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের ভুল ইতিহাস নিয়ে বেড়ে উঠবে। তাই ১৪ ডিসেম্বরকে শুধু ‘একদিনের স্মরণসভা’য় ব্র্যাকেটবন্দী না করে আগামী প্রজন্মকে সঠিক ইতিহাস জানাতে চলুন সবাই কাজ করি।
১৪ ডিসেম্বর এর চেতনা যেন সর্বদা আমাদের হৃদয়ে থাকে, আগামী প্রজন্ম যেন সঠিক ইতিহাস জানার মাধ্যমে বেড়ে ওঠে সেই চেষ্টাটা আমাদের সকলের মাঝে রাখতে হবে। জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানেরা যে মৌল চেতনার ভিত্তিতে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছে তা অক্ষুণ্ণ রাখাই হোক শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে আমাদের শপথ।
সারাবাংলা/এসবিডিই