বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ যেভাবে সংরক্ষিত হয়েছিল
৮ মার্চ ২০২৪ ২০:২৭
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঢাকার রমনায় অবস্থিত রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বিকেল ২টা ৪৫ মিনিটে শুরু করে বিকেল ৩টা ৩ মিনিটে ভাষণ শেষ করেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ঐতিহাসিক এ ভাষণে জাতির জনক তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ৭ কোটি বাঙালিকে স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানান।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটি ছিল ১৮ মিনিট ৩৯ সেকেন্ডের। কিন্তু বিভিন্ন পত্রিকা-বইয়ের লেখকরা যে অংশটুকু লিপিবদ্ধ করেছেন সেটা হলো ১১ মিনিটের মতো। এমনকি বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ ২০১১ সালে সংবিধানে যে সংশোধনী বা সংযোজন করে (পঞ্চদশ সংশোধন, ২০১১ সনের ১৪ নং আইনের ৫৫ ধারা), সেখানে সংবিধানের পঁচাত্তর পৃষ্ঠায় গেলে দেখা যাবে পঞ্চম তফসিলে (১৫০ (২) অনুচ্ছেদ) ভাষণটি আছে। এই পঞ্চম তফসিলটাই হলো ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তৎকালীন ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে জাতির জনকের দেওয়া ঐতিহাসিক ভাষণ। সংবিধানেও পুরোটা লিপিবদ্ধ নেই বলে জানাচ্ছেন গবেষকরা। তারা বলছেন, যেহেতু গুরুত্বপূর্ণ কোনও অংশ বাদ পড়েনি এবং বাদ পড়া অংশে বেশকিছু বক্তব্যর ক্ষেত্রে পুনরাবৃত্তি ঘটেছে সেকারণে পুর্ণাঙ্গটি না দিয়ে শুনতে অভ্যস্ত অংশই প্রচারের সিদ্ধান্ত হয়।
‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কণ্ঠের এই ভাষণ বাঙালি জাতিকে উজ্জীবিত করেছিল। প্রস্তুত করেছিল মুক্তিসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্যে। প্রতিটি বাঙালি হৃদয়কে আন্দোলিত করে এ ভাষণ।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ নিয়ে বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ এখন শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বের সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছে। এ ভাষণে যুদ্ধের প্রস্তুতিসহ প্রতিটি বিষয়ে দিকনির্দেশনা ছিল।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণটি ১২টি ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে। এই ভাষণকে ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে ইউনেস্কো। এ ভাষণকে ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টার (এমওডাব্লিউ)’ এ তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। এমওডব্লিউ-তে এটাই প্রথম কোনও বাংলাদেশি দলিল, যা আনুষ্ঠানিক ও স্থায়ীভাবে সংরক্ষিত।
সাতই মার্চের ভাষণ নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে। হয়েছে অনেক আলোচনাও। কথা উঠেছে, রেসকোর্স ময়দানে দেওয়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ সংবিধানের পঞ্চম তফসিলে হুবহু অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। সংশোধন হয়েছে, ২০২০ সালে আদালতে রিটও হয়েছে। ঐতিহাসিক এ ভাষণ অসম্পূর্ণ ও ভুলভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে কিনা—তা খতিয়ে দেখতে উচ্চপর্যায়ের কমিটি করার নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।
এদিকে বঙ্গবন্ধুর সঠিক ও পূর্ণাঙ্গ ভাষণ খুঁজে বের করতে সাত সদস্যের কমিটি গঠন করে তথ্য মন্ত্রণালয়। ভাষণ খুঁজে বের করা কমিটির সদস্য সচিব জাফর ওয়াজেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্ট, চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদফতর ও বাংলাদেশ বেতার থেকে আমরা বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটি সংগ্রহ করি। বিভিন্ন মাধ্যম থেকে সংগ্রহ করে আমরা মোট ২২ মিনিট ১৮ সেকেন্ডের ভাষণ পেয়েছি। এর মধ্যে স্লোগান ছিল চার মিনিটের। স্লোগান বাদ দিয়ে আমরা ১৮ মিনিট ২২ সেকেন্ডের একটি ভাষণ পেয়েছি। কমিটির সিদ্ধান্ত মতে সেটিই এখন পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ ভাষণ।’ তবে এ পূর্ণাঙ্গ ভাষণটি এখনও কোথায়ও প্রকাশ হয়নি। পূর্ণাঙ্গ ভাষণের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার তথ্য মন্ত্রণালয় বা উচ্চ আদালতের।
গবেষকদের দাবি, বেতার থেকে মূল ভাষণের যে কপি জোগাড় করা সম্ভব হয়েছে, সেটির দৈর্ঘ্য ১৮ মিনিটের কিছু বেশি, আর আমরা যেটি শুনি তার দৈর্ঘ্য ১০ মিনিটের কিছু বেশি। কী ছিল পুর্ণাঙ্গ ভাষণে? গবেষক মমতাজুল ফেরদৌস জোয়ার্দারের সহায়তায় পূর্ণাঙ্গ ভাষণের পাওয়া সংস্করণ হুবহু তুলে ধরা হচ্ছে। লিপিবদ্ধ করার সময় বঙ্গবন্ধু যেভাবে উচ্চারণ করেছিলেন ভাষণটি সেভাবেই রাখা হয়েছে। তবে এই সংস্করণেও কয়েকটি শব্দ বোঝা সম্ভব হয়নি।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ
“ভায়েরা আমার—‘আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সবই জানেন এবং বোঝেন। আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুরে আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে। আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তারা আজ তাদের অধিকার চায়। কী অন্যায় করেছিলাম? আপনারা নির্বাচনে গিয়ে, নির্বাচনের পরে বাংলাদেশের মানুষ সম্পূর্ণভাবে আমাকে, আওয়ামী লীগকে আপনারা ভোট দেন, আমরা ভোট পাই। আমরা দেশের একটা শাসনতন্ত্র তৈয়ার করব। আমাদের ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি বসবে, আমরা সেখানে শাসনতন্ত্র তৈয়ার করব এবং এ দেশকে আমরা গড়ে তুলবো। এ দেশের মানুষ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক মুক্তি পাবে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আজ দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, ২৩ বৎসরের করুণ ইতিহাস বাংলার অত্যাচারের, বাংলার মানুষের রক্তের ইতিহাস। ২৩ বৎসরের ইতিহাস মুমূর্ষু নর-নারীর আর্তনাদের ইতিহাস। বাংলার ইতিহাস, এ দেশের মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস।’
‘১৯৫২ সালে রক্ত দিয়েছি। ১৯৫৪ সালে নির্বাচনে জয়লাভ করেও আমরা গদিতে বসতে পারি নাই। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান মার্শাল-‘ল’ জারি করে ১০ বছর পর্যন্ত আমাদের গোলাম করে রেখেছে। ১৯৬৬ সালে ৬ দফার আন্দোলনে ৭ই জুনে আমার ছেলেদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। ১৯৬৯- এ আন্দোলনে আইয়ুব খানের পতন হওয়ার পরে যখন ইয়াহিয়া খান সাহেব সরকার নিলেন। তিনি বললেন, দেশে শাসনতন্ত্র দেবেন, গণতন্ত্র দেবেন, আমরা মেনে নিলাম। তারপরে অনেক ইতিহাস হয়ে গেল, নির্বাচন হলো।’
‘আপনারা জানেন, দোষ কী আমাদের? আজকে তিনি, আমি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সাহেবের সঙ্গে দেখা করেছি, আপনারা জানেন আলাপ-আলোচনা করেছি। আমি পাক, শুধু বাংলার নয়, পাকিস্তানের মেজরিটি পার্টির নেতা হিসাবে তাকে অনুরোধ করলাম, ১৫ই ফেব্রুয়ারি তারিখে আপনি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন দেন। তিনি আমার কথা রাখলেন না, তিনি রাখলেন ভুট্টো সাহেবের কথা। তিনি বললেন, প্রথম সপ্তাহে মার্চ মাসে হবে, তিনি মেনে নিলেন, মেনে নিলেন। তারপরে, আমরা বললাম ঠিক আছে, আমরা অ্যাসেম্বলিতে বসবো। আমরা আলাপ-(অস্পষ্ট) আলোচনা করব। আমি বললাম, বক্তৃতার মধ্যে, অ্যাসেম্বলির মধ্যে আলোচনা করব। এমনকি আমি এও পর্যন্ত বললাম, যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও, একজন যদিও সে হয়, তার ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেবো।’
‘তারপর জনাব ভুট্টো সাহেব এখানে এসেছিলেন, আলোচনা করলেন। বলে গেলেন যে, আলোচনার দরজা বন্ধ না, আরও আলোচনা হবে। তারপরে পশ্চিম পাকিস্তানের জামায়েত ইসলামীর নেতা নুরানি সাহেবের সংগে আলাপ হলো, মুফতি মাহমুদ সাহেবের সঙ্গে আলাপ হলো, তারপরে অন্যান্য নেতৃবৃন্দ তাদের সঙ্গে আলাপ করলাম। আসুন বসি, জনগণ আমাকে ভোট দিয়েছে ৬ দফা ১১ দফার মাধ্যমে শাসনতন্ত্র করতে, একে পরিবর্তন পরিবর্ধন করার ক্ষমতা আমার নাই। আপনারা আসুন, বসুন আমরা আলাপ করে শাসনতন্ত্র তৈয়ার করি। তিনি বললেন, পশ্চিম পাকিস্তানের মেম্বাররা যদি এখানে আসে তাহলে আমাদের, আমাদের ওপরে তিনি দোষ দিলেন এখানে আসলে কসাইখানা হবে অ্যাসেম্বলি। তিনি বললেন, আমি ডাবল হোস্টেজ হতে চাই না। তিনি বললেন, যেভাবে তাকে মেরে ফেলে দেওয়া হবে, যদি কেউ অ্যাসেম্বলিতে আসে তাহলে পেশোয়ার থেকে করাচি পর্যন্ত দোকান জোর করে বন্ধ করা হবে। তারপরেও যদি কেউ আসে তাকে ছান-নাছার করা হবে। আমি বললাম, অ্যাসেম্বলি চলবে। তারপরে হঠাৎ ১ তারিখে অ্যাসেম্বলি বন্ধ করে দেওয়া হলো।’
‘ইয়াহিয়া খান প্রেসিডেন্ট হিসেবে অ্যাসেম্বলি ডেকেছিলেন। আমি বললাম যে, আমি যাবো। ভুট্টো সাহেব বললেন, তিনি যাবেন না। ৩৫ জন সদস্য পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এখানে আসলেন। তারপরে হঠাৎ বন্ধ করে দেওয়া হল, দোষ দেওয়া হল বাংলার মানুষকে, দোষ দেওয়া হল আমাকে যে, ‘আমার অনমনীয় মনোভাবের জন্য তিনি তা করতে পারলেন না।’ তারপরে বন্ধ করে দেওয়ার পরে এ দেশের মানুষ প্রতিবাদ-মুখর হয়ে উঠলো।’
‘আমি বললাম, শান্তিপূর্ণভাবে আপনারা হরতাল পালন করেন। আমি বললাম, আপনারা কল-কারখানা সবকিছু বন্ধ করে দেন। জনগণ সাড়া দিলো। আপন ইচ্ছায় জনগণ রাস্তায় বেরিয়ে পড়লো, তারা শান্তিপূর্ণভাবে সংগ্রাম চালিয়ে যাবার জন্য স্থির প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলো। কী পেলাম আমরা? আমাদের যাদের অস্ত্র নাই আমাদের হাতে। যা-আমার পয়সা দিয়ে অস্ত্র কিনেছি বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য, আজ সেই অস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে আমার দেশের গরিব-দুঃখী নিরস্ত্র মানুষের বিরুদ্ধে। তার বুকের ওপরে হচ্ছে গুলি। আমরা পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু, আমরা পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু-আমরা বাঙালিরা যখনই ক্ষমতায় যাবার চেষ্টা করেছি, যখনই এ দেশের মালিক হবার চেষ্টা করেছি, তখনই তারা আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। তারা আমাদের ভাই, আমি বলেছি তাদের কাছে এ কথা যে, আপনারা কেন আপনার ভায়ের বুকে গুলি মারবেন? আপনাদের রাখা হয়েছে যদি বহিঃশত্রু আক্রমণ করে তা থেকে দেশটাকে রক্ষা করার জন্য।’
‘তারপরে উনি বললেন যে, আমার নামে বলেছেন আমি নাকি বলে স্বীকার করেছি যে, ১০ তারিখে রাউন্ড-টেবিল কনফারেন্স হবে। আমি উনাকে এ কথা বলে দিবার চাই, আমি তাকে তা বলি নাই, টেলিফোনে আমার সঙ্গে তার কথা হয়। তাকে আমি বলেছিলাম, জনাব ইয়াহিয়া খান সাহেব, আপনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট, দেখে যান ঢাকায় আসেন, কীভাবে আমার গরিবের ওপরে, আমার বাংলার মানুষের বুকের ওপর গুলি করা হয়েছে। কী করে আমার মায়ের কোল খালি করা হয়েছে, কী করে মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। আপনি আসুন, দেখুন, বিচার করুন। তারপরে আপনি ঠিক করুন আমি এই কথা বলেছিলাম।’
‘তিনি বললেন, আমি নাকি তাকে, তিনি নাকি খবর পেয়েছিলেন নাকি আমি তাকে আর.টি.সিতে বসবো। আমি তো অনেক আগেই বলে দিয়েছি কিসের আর.টি.সি? কার আর.টি.সি? কার সঙ্গে বসবো? যারা আমার মানুষের বুকের রক্ত নিয়েছে, তাদের সঙ্গে বসবো? আপনি আসুন, দেখুন জাতীয় পরিষদের জন্য আমরা (যারা বা নেতারা কিছু একটা বলেছেন সেটা ঠিকমত বোঝা যাচ্ছে না) রক্ত দিয়েছি, সত্য কথা কিন্তু তা কী আপনারা দেখেছেন? তারপরে তিনি আজকে, আজকে আমার দেশ অ্যাসেম্বলির-(জনতা কিছুটা অধৈর্য হলে) আহা বসেন আপনারা, সিট ডাউন। তিনি ২৫ তারিখে অ্যাসেম্বলি, এরপরে আপনারা জানেন আমি গেলাম, আমি গেলাম পল্টন ময়দানে, আমি বললাম সবকিছু বন্ধ। সরকারি অফিস বন্ধ, আহা ভাইরা আপনারা স্টপ প্লিজ। আমি বললাম, আমার কথা সকলে মানলো, সকলে আমাকে বললো এবং আপনারা আমাকে যে (সে) নেতৃত্ব দিয়েছেন। আমি বললাম কোনও সরকারি অফিস চলবে না, কোনও কিছু চলবে না। আমি কিছু কিছু জনগণের কষ্ট হয় সেটা স্লাক (শিথিল) করলাম। যে এই জিনিস চলবে, ঠিক সেভাবে চললো। হঠাৎ আমার সঙ্গে পরামর্শ না করে বা আমাদের সঙ্গে আলোচনা না করে, পাঁচ ঘণ্টা গোপনে বৈঠক করে যে বক্তৃতা তিনি করেছেন এবং যে বক্তৃতা করে অ্যাসেম্বলি করেছেন সমস্ত দোষ তিনি আমার ওপরে দিয়েছেন, বাংলার মানুষের ওপরে দিয়েছেন। আমরা গুলি খায় দোষ আমাদের। তিনি বাধা দিলেন যে আসতে পারবা না, গোলমাল হলো না পশ্চিম পাকিস্তানে, গুলি করে মারা হলো আমার বাংলার মানুষকে। আমি পরিষ্কার মিটিংয়ে বলেছি, এবারের সংগ্রাম আমার মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
‘ভায়েরা আমার—২৫ তারিখে অ্যাসেম্বলি কল করেছে। রক্তের দাগ শুকায় নাই। আমি ১০ তারিখে বলে দিয়েছি, ওই শহীদের রক্তের ওপর দিয়ে পাড়া দিয়ে আর.টি.সি’তে মুজিবুর রহমান যোগদান করতে পারে না। অ্যাসেম্বলি কল করেছেন, আমার দাবি মানতে হবে। প্রথম মিলি- সামরিক আইন মার্শাল-ল উইথড্রো করতে হবে। সমস্ত সামরিক বাহিনীর লোকদের ব্যারাকে ফেরত দিতে হবে। যেভাবে হত্যা করা হয়েছে তার তদন্ত করতে হবে। আর জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। তারপরে বিবেচনা করে দেখবো, আমরা অ্যাসেম্বলিতে বসতে পারবো, কি পারবো না। এর পূর্বে অ্যাসেম্বলিতে বসা, আমরা অ্যাসেম্বলিতে বসতে পারি না। জনগণ সে অধিকার আমাকে দেয় নাই।’
‘ভায়েরা আমার—তোমাদের ওপর আমার বিশ্বাস আছে? আমি- প্রধানমন্ত্রীত্ব-(এখানে কেউ কিছু বলেন, তখন বঙ্গবন্ধু উত্তরে বলেন হ্যাঁ) আমি প্রধানমন্ত্রীত্ব চাই না। আমরা এ দেশের মানুষের অধিকার চাই। আপনারা জানেন, আমি পরিষ্কার অক্ষরে বলে দিবার চাই যে, আজ থেকে এই বাংলাদেশের কোর্ট-কাচারি, আদালত-ফৌজদারি এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে। গরিবের- গরিবের যাতে কষ্ট না হয়, গরিবের যাতে কষ্ট না হয়, যাতে আমার মানুষ কষ্ট না করে সেই জন্য সমস্ত অন্যান্য যে জিনিসগুলি আছে, সেগুলোর হরতাল কাল থেকে চলবে না। রিকশা, ঘোড়ারগাড়ি চলবে, রেল চলবে, সব চলবে, লঞ্চ চলবে, শুধু সেক্রেটারিয়েট, সুপ্রিমকোর্ট, হাইকোর্ট, জজকোর্ট তারপরে আর কী সেমি-গভর্নমেন্ট দফতরগুলো, ওয়াপদা কোনওকিছু চলবে না। ২৮ তারিখে কর্মচারীরা যেয়ে বেতন নিয়ে আসবেন। এরপরে যদি বেতন দেওয়া না হয়, আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোকদের ওপর হত্যা করা হয়, তোমাদের ওপর কাছে আমার অনুরোধ রইলো, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে। আমরা ভাতে মারবো, আমরা পানিতে মারবো। তোমরা আমার ভাই, তোমরা ব্যারাকে থাকো, কেউ তোমাদের কিছু বলবে না। কিন্তু আর আমার বুকের ওপর গুলি চালাবার চেষ্টা করো না। ভালো হবে না, সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি তখন কেউ আমাদের দাবাতে পারবে না।’
‘আজ (এখানে বঙ্গবন্ধু কারও সঙ্গে একটু কথা বলেছেন যেটা পরিষ্কার না) আর যে সমস্ত লোক শহীদ হয়েছে, আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে, আমরা আওয়ামী লীগের থেকে, আমাদের আওয়ামী লীগ অফিসে রিলিফ কমিটি করা হয়েছে, যদ্দুর পারি তাদের সাহায্য করতে চেষ্টা করব। যারা পারেন আমার রিলিফ কমিটিতে সামান্য টাকা-পয়সা পৌঁছিয়ে দেবেন। আর এই সাতদিন হরতালে যে সমস্ত শ্রমিক ভাইরা যোগদান করেছেন, সান্ধ্য আইনের জন্য যোগদান করতে পারেন নাই, প্রত্যেকটা- প্রত্যেকটা শিল্পের মালিক তাদের বেতন পৌঁছাইয়া দেবেন। মনে রাখবেন, আর সরকারি কর্মচারীদের বলি, আমি যা বলি তা মানতে হবে। কাউকে যেন সেক্রেটারিয়েটে, হাইকোর্টে বা জজকোর্টে দেখা না হয়। দ্বিতীয় কথা, যে পর্যন্ত আমার এই দেশের মুক্তি না হবে, খাজনা ট্যাক্স বন্ধ করে দেওয়া হলো, কেউ দেবে না।’
‘আপনারা আমার ওপর ছেড়ে দেন, আন্দোলন কী করে করতে হয়। শোনেন মনে রাখবেন, একটা অনুরোধ আপনাদের কাছে, শত্রু বাহিনী ঢুকেছে ছদ্মবেশে, নিজেদের মধ্যে আত্মকলহ সৃষ্টি করবে, লুটতরাজ করবে। এই বাংলায়, হিন্দু-মুসলমান, বাঙালি, নন-বাঙালি যারা আছে তারা আমাদের ভাই। তাদের রক্ষার দায়িত্ব আপনাদের ওপরে, আমাদের যেন বদনাম না হয়। মনে রাখবেন, দ্বিতীয় কথা হল এই যে, যদি আবার কোনও রকমের কোনও আঘাত আসে, আমি যদি হুকুম দেবার না পারি, আমার সহকর্মীরা হুকুম দেবার না পারে, মনে রাখবেন আরেকটা কথা অনুরোধ করছি, রেলওয়ে চলবে সত্য কথা। কিন্তু সামরিক বাহিনীর লোকদের কোনও জায়গা থেকে, এক জাগা আরেক জাগা নেবার চেষ্টা করবেন না। তাহলে দুর্ঘটনা ঘটলে আমি দায়ী হবো না। প্রোগ্রামটা বলছি আমি, শোনেন রেডিও, টেলিভিশন, নিউজ পেপার। মনে রাখবেন, রেডিও টেলিভিশনের কর্মচারীরা যদি রেডিওতে আমাদের কথা না শোনে তাহলে কোনও বাঙালি রেডিও স্টেশনে যাবেন না। যদি টেলিভিশন আমাদের নিউজ না দেয়, কোনও বাঙালি টেলিভিশনে যাবেন না। (এখানে বঙ্গবন্ধু একটু থামেন কারণ একটা যুদ্ধ বিমান প্রচণ্ড শব্দে ওই এলাকা দিয়ে উড়ে যায়) রেডিওতে যদি আমাদের নিউজ না দেবার দেয় কোনও বাঙালি রেডিও স্টেশনে যাবেন না। টেলিভিশনে যদি আমাদের নিউজ না দেওয়া হয়, কোনও বাঙালি টেলিভিশন অফিসে যাবেন না। দুই ঘণ্টার মতো ব্যাংক খোলা থাকবে, যাতে মানুষ তাদের মাইনাপত্র নিবার পারে। কিন্তু পূর্ববাংলা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে এক পয়সাও চালান হতে পারবে না। টেলিফোন, টেলিগ্রাম আমাদের এই পূর্ববাংলায় চলবে এবং বিদেশের সঙ্গে নিউজ পাঠাতে হলে আপনারা চালাবেন। কিন্তু যদি এই দেশের মানুষকে খতম করার চেষ্টা করা হয়, বাঙালিরা বুঝেশুনে কাজ করবেন। আমার কিছু বলার থাকবে না, দরকার হয় চাকা বন্ধ করে দেওয়া হবে।’
‘ভায়েরা আমার— আমার কাছে, এখনই শুনলাম আমার এই বক্তৃতা রিলে করা বন্ধ করে দিয়েছে। আমি আপনারা আমার প্লেয়ার চালায়ে দেন, কারো হুকুম মানতে পারবেন না। তবে আমি অনুরোধ করছি, আপনারা আমাদের ভাই, আপনারা দেশকে একেবারে জাহান্নামে- ধ্বংস করে দিয়েন না। জীবনে আর কোনওদিন আপনাদের মুখ দেখাদেখি হবে না। যদি আমরা শান্তিপূর্ণভাবে আমাদের ফায়সালা করতে পারি তাহলে অন্ততপক্ষে ভাই-ভাই হিসাবে বাস করার সম্ভাবনা আছে। সেইজন্য আপনাদের অনুরোধ করছি, আমার এই দেশে আপনারা মিলিটারি শাসন চালাবার চেষ্টা আর করবেন না। দ্বিতীয় কথা প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায়, প্রত্যেক ইউনিয়নে, প্রত্যেক সাব-ডিবিশনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোল এবং তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেবো। এই দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
‘ভায়েরা আমার—যেভাবে আপনাদের, আপনারা ঠাণ্ডা হবেন না, ঠাণ্ডা হয়ে গেলে জালেম আত্মা আরম্ভ করবে আক্রমণ করতে। আপনারা হুঁশিয়ার থাকবেন এবং প্রস্তুত থাকবেন। পজিশন চলবে। কিন্তু মনে রাখবেন, ডিসিপ্লিন সোলজার ছাড়া, ডিসিপ্লিন ছাড়া কোনও জাতি জিততে পারে না। আপনারা আমার ওপরে বিশ্বাস নিশ্চয়ই রাখেন, জীবনে আমার রক্তের বিনিময়েও আপনাদের সঙ্গে বেঈমানি করি নাই। প্রধানমন্ত্রীত্ব দিয়ে আমাকে নিতে পারে নাই, ফাঁসি-কাষ্টের আসামি দিয়ে আমাকে নিতে পারে নাই। যে রক্ত দিয়ে আপনারা একদিন আমাকে জেলে থেকে বের করে নিয়ে এসেছিলেন, এই রেসকোর্স ময়দানে আমি বলেছিলাম, আমার রক্ত দিয়ে, আমি রক্তের ঋণ শোধ করব। মনে আছে? আমি রক্ত দেবার জন্য প্রস্তুত, আমাদের মিটিং এখানেই শেষ। আসসালা-মুআলাইকুম।’ জয় বাংলা।”
সারাবাংলা/এজেডএস