Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বক্তাবলী জেনোসাইড: শত লাশের স্তুপ

রা’আদ রহমান
২৩ মার্চ ২০২৪ ১৩:৪৯

আলীরটেক, বক্তাবলী ও বালুচর- এ তিনটি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত ছিল নারায়ণগঞ্জের বক্তাবলী পরগণা। এর পূর্ব ও দক্ষিণ দিকে বুড়িগঙ্গা, পশ্চিমে ধলেশ্বরী এবং আরো দক্ষিণে ছিল মেঘনা। ধলেশ্বরী ও বুড়িগঙ্গার মাঝে ছিল ২২টি গ্রাম, যেকারণে সম্ভবত বক্তাবলী পরাগণা বাইশময়াল নামেও পরিচিত ছিল। একাত্তরের পুরো সময়টা জুড়ে দুর্গম এই ২২ গ্রাম ছিল অনেকটাই মুক্তাঞ্চল, স্বাধীনতাকামী এই গ্রামগুলো ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়স্থল। যার মাশুল তাদের দিতে হয়েছিল নির্মমভাবে।

বিজ্ঞাপন

একাত্তরে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ থেকে মুন্সিগঞ্জের দিকে সরে যাওয়ার নিরাপদ যাত্রাপথটিও ছিল এই বক্তাবলী। পূর্ব ও দক্ষিণ দিকে থাকা দুই নদীর মাঝের লম্বা সরু এক সরলরেখা জুড়ে থাকা বক্তাবলীর এই ২২ গ্রাম যেন দক্ষিণ আমেরিকার আটলান্টিকের পাড়ে লম্বা সরু দেশ চিলির মতো। ২৫ মার্চ ক্র্যাকডাউনের পর থেকে শুরু করে একাত্তরের পুরো সময় জুড়েই বক্তাবলীর নদীপথ ধরে পালিয়েছে এবং এই ২২ গ্রামে আশ্রয় নিয়েছেন অজস্র মানুষ।

বিজ্ঞাপন

গ্রামের মানুষেরা আশ্রয় দিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধাদের, নিরাপদ মুক্তাঞ্চল বিবেচনায় লক্ষ্মীনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও আলীরটেকের মুক্তারকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কানাইনগর হাইস্কুলসহ বেশ কয়েকটি জায়গায় ঘাঁটি স্থাপন করেছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা। দিনে ও রাতে আশেপাশের নানা এলাকায় অপারেশন চালিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা এসে আশ্রয় নিতেন এখানে। এছাড়াও নদীর পাড়ে ডিক্রিরচর মসজিদ ও বিভিন্ন বাড়িতে রাত কাটাতেন মুক্তিযোদ্ধারা।

মুক্তিপাগল এই গ্রামের মানুষেরা নিজেদের জান-মাল পরিবারের মায়া তুচ্ছ করে আশ্রয় দিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধাদের, খেয়ে না খেয়ে খাইয়েছেন মুক্তিযোদ্ধাদের। যেহেতু এই বিশাল এলাকায় কোন রাজাকার বা স্বাধীনতাবিরোধী ছিল না, সুতরাং নিশ্চিন্তেই যাওয়া আসা করতেন মুক্তিযোদ্ধারা। একাত্তরের পুরোটা সময় জুড়েই মুক্তিসংগ্রামী ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত এই জায়গাটি ভয়াবহভাবে আক্রান্ত হয় দুইবার। একাত্তরের ২৭ জুন ও ২৯ নভেম্বর।

বক্তাবলীর এক গ্রামের নৌকাচালক নুরুল হক মুক্তিযোদ্ধাদের নৌকা চালাতেন। তিনি ভাষ্য থেকে জানা যায়, নারায়ণগঞ্জের পাটকলে চাকরী করা গোলজার নামে একজন বিহারি নিয়মিত আসা-যাওয়া করত এখানে। সেই গোলজারের দেয়া তথ্য ও নির্দেশনায় এই মুক্তাঞ্চলের খোঁজ পায় পাকিস্তানী সেনাবাহিনী। প্রথমে ২৭ জুন এসে গণহত্যা চালায়, ১৪৭ জন মানুষ শহীদ হন সেই নির্বিচার হত্যাযজ্ঞে।

কিন্তু বিভীষিকার পালা সেখানেই শেষ না, নভেম্বরের শেষদিকে নারায়ণগঞ্জ শহরের রাজাকারদের মাধ্যমে বক্তাবলী অঞ্চলে বড় আকারের মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং ক্যাম্প ও ঘাঁটির খবর পায় পাকিস্তানী সেনাবাহিনী। রক্তের ঘ্রাণ পাওয়া হাউন্ডের মতন দ্বিতীয়বার ছুটে আসে তারা বক্তাবলীতে।

২৯ নভেম্বর ভোররাতে চারটি গানবোট নিয়ে ধলেশ্বরী নদীযোগে আসে পাকিস্তানী সেনাদের দলটি। তিনদিক থেকে ঘিরে ফেলে তারা বক্তাবলীর গ্রামগুলো। কিন্তু ঘন কুয়াশার ফলে পাকিস্তানীরা শুরুতেই পাড়ে নেমে গ্রামে ঢোকার সাহস পায়নি। ওদিকে নদীর পাড়ে অবস্থিত ডিক্রির চর মসজিদসহ বিভিন্ন বাড়িতে রাত কাটানো মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানীদের উপস্থিতি টের পেয়ে যান এবং প্রতিরোধের প্রস্তুতি শুরু করেন। বেলা বাড়ার সাথে সাথে কুয়াশা কেটে ক্রমশ চারপাশ আরো পরিষ্কার হতে শুরু করলে কুঁড়ের পাড় অঞ্চলে নদীর কাছ থেকে গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে প্রথমে গ্রামের দিকে অগ্রসর হতে থাকে পাকবাহিনী। তখন প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সিরাজুল ইসলাম ও মুক্তিযোদ্ধা মাহফুজুর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিরোধ শুরু করে। সকাল তখন প্রায় সাড়ে সাতটা।

এমন সময় মুন্সীগঞ্জ থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের একটা দল এসে যোগ দেয় বক্তাবলীতে, সম্ভবত তারা কোন অপারেশন শেষ করে ফিরেছিলেন। শক্তি বেড়ে যাওয়ায় মুক্তিযোদ্ধারা বিপুল বিক্রমে লড়াই শুরু করেন পাকিস্তানী সেনাদের বিরুদ্ধে। দুই ঘন্টা মতান্তরে চার ঘন্টা চলমান যুদ্ধে কমপক্ষে ৫ জন পাকিস্তানী সেনা নিহত এবং কয়েকজন আহত হয়। আহত দুজন এবং নিহতদের লাশ নিয়ে পাকিস্তানী সেনারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। এসময় মুক্তিযোদ্ধারা মোক্তারকান্দি কবরস্থানের সামনে থেকে কয়েকজন রাজাকারকে ধরে ফেলেন। ধারণা করা হয় তারাই পাকিস্তানী সেনাদের পথ দেখিয়ে বক্তাবলী নিয়ে এসেছিল। তাদের আগুনে পুড়িয়ে নিকেশ করে দেয়া হয়।

মুক্তিযোদ্ধাদের এই প্রবল প্রতিরোধের কারণে বক্তাবলীর গ্রামগুলো থেকে পঞ্চাশ হাজারেরও বেশি মানুষ মুন্সিগঞ্জ ও বিভিন্ন অঞ্চলে সরে যেতে সক্ষম হন। বাঁচে হাজারো প্রাণ। কিন্তু সাময়িক বিরতির পর পাকিস্তানী সেনারা আবার ফিরে আসে আরো বড় বহর এবং বাহিনী নিয়ে। অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র-এর মাধ্যমে তাদের চালানো প্রচন্ড আক্রমণের মুখে অবশেষে পিছু হটতে বাধ্য হয় মুক্তিযোদ্ধারা। ঘাঁটি আছে জেনে আসলেও পাকিস্তানীরা মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে এমন প্রতিরোধ কোনভাবেই আশা করেনি। তাই তাদের হামলাও হলো মারাত্মক, মুক্তিযোদ্ধাদের তীব্র প্রতিরোধ ভেঙ্গে পড়তেই তখনো পালাতে না পারা গ্রামগুলোর নিরীহ সাধারণ মানুষেরা আক্রান্ত হলো।

প্রথমেই ডিক্রিরচর গ্রামের ৪০ জনকে হাত-পা বেঁধে এক লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। এরপরে প্রায় ১৩৯ জন গ্রামবাসীকে ধরে এনে জড়ো করে বক্তাবলীর লক্ষ্মীনগর গ্রামের পূর্বপাড়া সংলগ্ন বুড়িগঙ্গার তীরে সবাইকে হাত-পা বেঁধে একসঙ্গে গুলি করে হত্যা করা হয়। লক্ষ্মীনগর কবরস্থানের কাছে খড়ের পাড়ার ভেতরে আশ্রয় নেয়া দলবদ্ধ নিরীহ গ্রামবাসীদের আগুনে জ্বালিয়ে জীবন্ত পুড়িয়ে মারে পাকিস্তানীরা। শীতের সকালে রাজাপুরের হলুদ সরিষা ক্ষেত লাল হয়ে ওঠে, পড়ে থাকে লাশের পর লাশ।

এই নির্মম হত্যাযজ্ঞে মুক্তিযোদ্ধারাসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র শহীদুল্লাহ্, মুনীরুজ্জামানসহ বহু ছাত্র; শাহিদ, ফারুক, অহিদ, মনির, শাহ আলম, রহমতউলাহ, শামসুল, আলম, সালামত, খন্দকার, সুফিয়া, আম্বিয়া, খোদেজাসহ শত শত মানুষ নিহত হন। বিকালে পাকিস্তানী সেনারা হত্যাযজ্ঞ শেষে ফিরে গেলে লুকিয়ে থাকা গ্রামবাসীরা ফেরেন গ্রামে, খুঁজতে থাকেন তাদের মা-বাবা, ভাই-বোন, আত্মীয় ও প্রিয়জনদের। নদীর তীরে শহীদদের লাশের স্তুপ থেকে লাশ তুলে এনে বা আগুনে পুড়ে যাওয়া লাশের অংশবিশেষ এনে গ্রামবাসী লক্ষ্মীনগরে গণকবর দেন। এ ছাড়া অনেকেই তাদের প্রিয়জনদের লাশ কবর দেন বাড়ির আঙিনায়।

এ গণহত্যায় একই গ্রামের রহমত আলীর ভাই ২৫ বছরের সালেহ আহমেদও শহিদ হন। অন্যদিকে গুলির হাত থেকে বেঁচে যান সিরাজুল ইসলাম ও শাহজাহান মিয়া। রহমত আলী আজো বেঁচে আছেন ভাই হারানোর শোক বুকে চেপে, জানালেন বক্তাবলীর গণহত্যা একাত্তরের পাকিস্তানীদের নৃশংসতার অন্যতম প্রমাণ। মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়টা মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন অপারেশনের নৌকাচালক মো. সেকান্দার আলীর বয়স ছিল বিশ বছর। তার বাড়ি আলীরটেকের মোক্তারকান্দি।

মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন কাজে বিভিন্ন স্থানে যাতায়াতের জন্য সেকান্দার আলীর নৌকা নিয়ে যেতেন।পাকিস্তানীদের গুলি তার ডান হাতে লেগেছিল, অল্পের জন্য বেঁচে যান তিনি। সেকান্দার আলী বলেন,

সেদিনের কথা মনে পড়লে এখনো শরীর শিউরে ওঠে। কনকনে শীতের মধ্যে মোটাকাঁথা গায়ে জড়িয়ে ঘুমিয়ে ছিলাম। হঠাৎ গুলির শব্দে ঘুম ভাঙে। চোখ মেলে দেখি চারদিকে আগুন, মানুষের দৌড়ঝাঁপ, কান্নাকাটি। প্রাণ বাঁচাতে আমরাও পালাই। সন্ধ্যায় ফিরে এসে দেখি বাড়িঘর সবই আগুনে পুড়ে ছাই। এদিক-সেদিক পড়ে আছে লাশ। নদীর তীরে গিয়ে দেখি লাশের স্তূপ। গ্রামের চারটি গরুও পুড়ে মারা গেছে। পুড়ে নষ্ট হয়েছে গ্রামের কৃষকের সংরক্ষণে থাকা কয়েকশ মন আলু। এরপর আমরা সবাই মিলে বিভিন্ন স্থান থেকে লাশ সংগ্রহ করে যতটা সম্ভব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে গণকবর দেই।

বক্তাবলীর জেনোসাইডের ঘটনায় এই এলাকাকে এখনো বধ্যভূমি ঘোষণা করা হয়নি। এলাকার আশেপাশের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা শহীদদের কবরগুলোও চিহ্নিত ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়নি। কেবল বাঁধানো গণকবরটিতে শহীদদের নামফলক বসানো হয়েছে। এছাড়া ২০০৫ সালে বক্তাবলীর কানাইনগরে একটা স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করা হলেও শহীদদের নামের তালিকা বা গণহত্যায় নিহতদের কোন বর্ণনা নেই। অবিলম্বে বক্তাবলী জেনোসাইডের গণকবরের জায়গাটিকে বধ্যভূমি হিসেবে ঘোষণা করা হোক। গণহত্যার শিকার প্রত্যেক শহীদের পূর্ণাঙ্গ বিবরণ ও ২৯ নভেম্বরে গণহত্যার বিবরণ দিয়ে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হোক। শহীদের আত্মত্যাগের ইতিহাস স্মরণ হোক যেন নতুন প্রজন্মের নাগরিকেরা জানতে পারে কত রক্তের বিনিময়ে এসেছে এই স্বাধীন দেশ, এসেছে স্বাধীন সার্বভৌম পরিচয়!

তথ্যসূত্রঃ ১। মুক্তিযুদ্ধের সাক্ষী বক্তাবলীর গণহত্যা/ গাজী মুনছুর আজিজ
২। বক্তাবলী গণহত্যা ও প্রতিরোধ দিবস/ রফিউর রাব্বি

সারাবাংলা/এসবিডিই

ফিচার বক্তাবলী জেনোসাইড: শত লাশের স্তুপ রা'আদ রহমান

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর