মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যার ভিডিওচিত্র ধারণকারী ড. নূরুল উলা
৩০ মার্চ ২০২৪ ১৫:৪০
মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যার দুর্লভ ভিডিওচিত্র ধারণকারী ড. নূরুল উলার সাক্ষাৎকার (মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্রে থেকে সংগৃহীত)
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ তারিখে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. নূরুল উলার তোলা বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ সময়ের গণহত্যার কিছু দুর্লভ ভিডিওচিত্র ধারণ করেছিলেন।
২৬ মার্চ সকালে বুয়েটের আবাসিক এলাকার বাসভবনের জানালার ফাঁক গলিয়ে থেকে জগন্নাথ হলের মাঠে গণহত্যার ভিডিও কীভাবে ধারণ করেছেন, সে বিষয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র প্রকল্পের এক গবেষককে অধ্যাপক ড. নূরুল উলার সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন।
অধ্যাপক ড. নূরুল উলার সেই সাক্ষাৎকার তুলে ধরা হলো-
প্রশ্ন: আপনি কি ২৬ মার্চের হত্যাকাণ্ডের ছবি নিজ হাতে তুলেছিলেন? উত্তর: হ্যাঁ, আমি জগন্নাথ হলের মাঠে ২৬ মার্চ সকাল বেলা যে মর্মস্পশী দৃশ্য ঘটেছিল তার ছবি আমার বাসার জানালা থেকে টেলিস্কোপ লাগিয়ে মুভি ক্যামেরায় তুলেছিলাম।
প্রশ্ন: এ ছবি তোলার জন্য কি আপনার পূর্ব পরিকল্পনা ছিল, না-কি হঠাৎ করে মনে হওয়াতে তুলে নিয়েছেন?
উত্তর: ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ভাষণের পর থেকেই আমার ধারণা হয়েছিল, এবার একটা বিরাট কিছু পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে। তাই তখন থেকেই বিভিন্ন সভা, শোভাযাত্রা, বিক্ষোভ মিছিল, মশাল মিছিল ব্যারিকেড ইত্যাদির ছবি আমি তুলতে আরম্ভ করি।
প্রশ্ন: ক্যামেরাটি কি আপনার নিজস্ব?
উত্তর: না, ওটা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের টেলিভিশন ভিডিও টেপ ক্যামেরা। ছাত্রদের হাতে-কলমে শিক্ষা দেবার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে বহু ক্যামেরা ও জটিল যন্ত্রপাতি রয়েছে।
প্রশ্ন: ক্যামেরাটি আপনার কাছে রেখেছিলেন কেন?
উত্তর: এর জবাব দিতে গেলে একটু পেছনের ইতিহাস বলতে হয়। এ জন্য বলছি যে এগুলো ইতিহাসের পাতায় লিখে রাখা উচিত। ৭ মার্চের পরে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের কিছু ছেলে এসে বলল, ‘স্যার আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের যন্ত্রপাতি দিয়ে একটি অয়্যারলেস স্টেশন তৈরি করতে হবে। আমি ওদের কথা একেবারে উড়িয়ে দিতে পারলাম না। এর পরে ওরা একদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে কথা বলে আমাকে তাঁর ধানমন্ডির বাড়িতে নিয়ে গেল। আমি প্রথমে ব্যাপারটার গুরুত্ব অতটা উপলব্ধি করিনি। অনেক ভিতরের একটা কক্ষে নিয়ে যাওয়ার পরে দেখলাম সেখানে সোফার উপরে তিনজন বসে রয়েছেন- মাঝখানে বঙ্গবন্ধু। তাঁর ডানে সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেব ও বাঁ পাশে তাজউদ্দিন সাহেব। আমি ঢুকে বঙ্গবন্ধুকে সালাম করলাম। ছাত্ররা আমাকে বঙ্গবন্ধুর সাথে পরিচয় করিয়ে দিল, যদিও আগেও অনেকবার তাঁর সাথে আমার সাক্ষাৎ হয়েছিল। তিনি আমাকে ঘরের এক কোণে নিয়ে কাঁধে হাত রেখে অত্যন্ত সন্তর্পণে বললেন, “নূরুল উলা আমাকে ট্রান্সমিটার তৈরি করে দিতে হবে। আমি যাবার বেলায় শুধু একবার আমার দেশবাসীর কাছে কিছু বলে যেতে চাই। তুমি আমায় কথা দাও, যেভাবেই হোক একটা ট্রান্সমিটার আমার জন্য তৈরি রাখবে। আমি শেষবারের মতো ভাষণ দিয়ে যাব।’ বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠ তখন আমার কাছে বাচ্চা শিশুর আবদারের আবেগময় কন্ঠের মত মনে হচ্ছিল। এর পরেই বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে তড়িৎ কৌশল বিভাগের অন্যান্য শিক্ষকদের কাছে সব খুলে বলি। শুরু হল আমাদের কাজ। বিভাগীয় প্রধান ড. জহুরুল হকসহ প্রায় সকল শিক্ষক আমাকে সহযোগিতা করতে লাগলেন। ৯ দিন কাজ করার পর শেষ হল আমাদের ট্রান্সমিটার। এর ক্ষমতা বা শক্তি ছিল প্রায় সারা বাংলাদেশব্যাপী। শর্ট ওয়েভে এর শব্দ ধরা যেত। যাহোক, পরবর্তী সময়ে এর ব্যবহার আসেনি। এই সাথেই আমার মাথায় ধারণা এল, যদি কোন হত্যাকাণ্ড, অগ্নিসংযোগ বা গোলাগুলি হয় তা আমি ক্যামেরায় তুলে ফেলব। সে থেকেই ক্যামেরাটি সাথে রাখতাম।
প্রশ্ন: আপনি কখন ভিডিও শুরু করেন?
উত্তর: রাত্রে ঘুমের মাঝে হঠাৎ বিকট শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যায়। আমি ভেবেছিলাম যে আগের মতই হয়ত ছাত্রদের ভয় দেখাবার জন্যে ফাঁকা
গুলি করা হচ্ছে। অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেরা আমাদের নির্দেশ ও সহযোগিতায় যে সমস্ত হাত বোমা তৈরি করছিল তারই দু’একটা হয়ত বিস্ফোরিত হয়েছে। সারা রাত আতঙ্কের মধ্যে কাটালাম। জানালা দিয়ে মাঝে মাঝে জগন্নাথ হলের দিকে তাকাতাম। কিন্তু সমগ্র এলাকাটা আগে থেকেই বিদ্যুৎ লাইন কেটে দেওয়ায় অন্ধকারাচ্ছন্ন ছিল। জগন্নাথ হলের এলাকায় কি হচ্ছিল কিছুই দেখতে পারলাম না। শুধু গোলাগুলির শব্দ শুনছিলাম। কিন্তু স্পষ্ট বুঝতে পারলাম, ওখানে একটা ছোটখাটো লড়াই হচ্ছে। সাথে সাথে আমার ক্যামেরাটার কথা মনে পড়ে গেল। অপেক্ষা করতে লাগলাম কখন সকাল হবে আর দিবালোকে আমি ছবি তুলতে পারব।
প্রশ্নঃ আপনি যে ক্যামেরা বসিয়েছিলেন তা কি বাইরে থেকে দেখা যাচ্ছিল না?
উত্তর: এমনভাবে ক্যামেরা বসান হয়েছিল যে বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই। পর্দার আড়ালে এমনভাবে বসান হয়েছিল যে শুধু ক্যামেরার মুখ বের করা ছিল। পুরো ক্যামেরাটা কালো কাপড় দিয়ে মোড়ান। আমাদের জানালাগুলো এমনভাবে তৈরি যে বন্ধ করার পরেও ধাক্কা দিলে কিছুটা ছোট ফাঁক থেকে যায়। ওই ফাঁক দিয়ে ক্যামেরার মুখটা বাইরে বের করে রাখলাম।
প্রশ্ন: ক্যামেরা চালু করেন কখন? উত্তর: সকাল ৭ টা থেকে ৮ টার মধ্যবর্তী সময়ে। জানালা দিয়ে লক্ষ্য
করলাম যে জগন্নাথ হলের সামনের মাঠে কিছু ছেলেকে ধরে এনে লাইনে দাঁড় করান হয়েছে, তখনই আমার সন্দেহ জাগে, আমি ক্যামেরা অন করি। আমাদের ক্যামেরাটির একটা বিশেষ গুণ এই যে, এতে মাইক্রোফোন দিয়ে একই সাথে শব্দ তুলে রাখা যায়। তাই আমি টেপের সাথে মাইক্রোফোন যোগ করে ক্যামেরা চালু করি। কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখলাম যে ছেলেগুলোকে এক ধারছে গুলি করা হচ্ছে, একজন একজন করে পড়ে যাচ্ছে। পাকিস্তানি সৈন্যরা আবার হলের ভিতরে চলে গেল। আমি ভাবলাম আবার বেরিয়ে আসতে সৈন্যদের হয়ত কিছু সময় লাগবে। এই ফাঁকে আমি টেপটা ঘুরিয়ে (রিউইন্ড) আমার টেলিভিশন সেটের সাথে লাগিয়ে দেখতে লাগলাম ছবি ঠিকভাবে উঠেছে কিনা। এটা শেষ করে জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি, আবার কিছুসংখ্যক লোককে ধরে নিয়ে এসে লাইনে দাঁড় করান হয়েছে। আমি তখন পূর্বের তোলা টেপটা মুছে তার উপর ছবি তোলা শুরু করলাম।
প্রশ্ন: আপনি পূর্বের তোলা টেপ কেন মুছে ফেললেন?
উত্তর: আমার মনে হচ্ছিল, আগের ছবিতে সবকিছু ভালোভাবে আসেনি। আর নতুন ছবি তুলতে গিয়ে আমি হয়ত আরো হৃদয়স্পর্শী দৃশ্য ধরে রাখতে পারব। হাতের কাছে আমার আর টেপ ছিল না। মোট কথা, আমি ওই সমস্ত দৃশ্য দেখে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে পাগলের মত হয়ে গেলাম। আজও দুঃখ করি, যদি আমি নতুন টেপে ছবি তুলতে পারতাম তাহলে কত ভালো হতো। দুটো দৃশ্য মিলে আমার টেপের দৈর্ঘ্য বেড়ে যেত। কিন্তু তখন এত কিছু চিন্তা করার সময় ছিল না। যা হোক, দ্বিতীয় বারের লাইনে দেখলাম একজন বুড়ো দাড়িওয়ালা লোক রয়েছে। সে বসে পড়ে হাত জোর করে ক্ষমা চাইছে। আমার মনে হচ্ছিল সে তার দাড়ি দেখিয়ে বোঝাতে চেয়েছিল যে সে মুসলমান। কিন্তু বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী তার কোন কথাই শুনতে চায়নি। তাকে গুলি করে মারা হল। মাঠের পূর্বপার্শ্বে পাকিস্তানি বাহিনী একটা তাঁবু বানিয়েছিল। সেখানে ওরা চেয়ারে বসে চা খাচ্ছে আর হাসি তামাসা ও আনন্দ উল্লাসে ফেটে পড়ছে।
প্রশ্ন: লোকগুলোকে হলের ভিতর থেকে কিভাবে আনা হচ্ছিল?
উত্তর: যাদেরকে আমার চোখের সামনে মারা হয়েছে ও যাদের মারার ছবি আমার ক্যামেরায় রয়েছে তাদের দিয়ে প্রথমে হলের ভিতর থেকে মৃতদেহ বের করে এনে এক জায়গায় জমা করা হচ্ছিল। ওদেরকে দিয়ে লেবারের কাজ করানোর পরে আবার ওদেরকেই লাইনে দাঁড় করিয়ে এক সারিতে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে।
প্রশ্ন: জমা করা মৃতদেহ দেখে আপনার ধারণায় কতগুলো হবে বলে মনে হয়েছিল?
উত্তর: আমার মনে হয়, ৭০/৮০ জনের মৃতদেহ এক জায়গায় জমা করা হয়েছিল।
প্রশ্ন: ওগুলো সবই ছাত্রদের মৃতদেহ ছিল?
উত্তর: আমার মনে হয় ছাত্র ছাড়াও হলের মালি, দারোয়ান, বাবুর্চি এদেরকেও একই সাথে গুলি করা হয়েছে।
প্রশ্ন: আপনি কি দেখেছেন যে কাউকে গুলি না করে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে?
উত্তর: না, তবে লাইনে দাঁড় করাবার পরে যে খান সেনাটিকে গুলি করার নির্দেশ দেওয়া হচ্ছিল সে যখন পিছনে তার অফিসারের দিকে মুহূর্তের জন্য তাকিয়ে ছিল এই ফাঁকে দু’জন লোক সামনে স্তুপ করা মৃতদেহের মধ্যে শুয়ে পড়ল। আর বাকিদের গুলি করে মারা হলো। গুলি করার পর যখন খান সেনারা কয়েক ঘন্টার জন্য এই এলাকা ছেড়ে চলে গেল, সেই ফাঁকে ঐ দু’জন উঠে পালায়। পরবর্তীকালে তাদের একজন আমার বাসায় এসে আশ্রয় নিয়েছিল। সে ঢাকায় এসেছিল চাকরির ইন্টারভিউ দিতে।
প্রশ্ন: আপনি কি ইচ্ছা মত সব ছবি তুলতে পেরেছিলেন?
উত্তর: না, আমি থেমে থেমে তুলছিলাম, পাছে টেপ ফুরিয়ে যায়। তাই আমি সব ছবি তুলতে পারিনি। পরে যখন বুলডোজার দিয়ে সব লাশ ঠেলে গর্তে ফেলা হচ্ছিল সে ছবি তুলতে পারিনি। কারণ ওরা কিছুক্ষণের জন্যে চলে যাবার পরপরই আমার পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে বাসা ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিল।
প্রশ্ন: আপনি কি টেপ সাথে নিয়েছিলেন?
উত্তর: না, এটা আরো ঝুঁকির বলে মনে করে বাসাতেই যত্ন সহকারে রেখে যাই। আর এ ঘটনা আমার স্ত্রী ছাড়া কেউ জানত না। বাইরে নিয়ে গেলে হয়তো অনেকেই জেনে ফেলত এবং এই মূল্যবান দলিল আমি দেশবাসীর সামনে পেশ করতে পারতাম না।
প্রশ্ন: আপনি কখন এই টেপ সবার সামনে প্রকাশ করলেন?
উত্তর: মুক্তিযুদ্ধকালীন নয় মাস প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে আমার আতঙ্কের মধ্যে কেটেছে। কখন কে জেনে ফেলে। কখন আমি ধরা পড়ে যাই বা কখন কেউ এসে এটা নিয়ে যায়। বাংলাদেশ হানাদারমুক্ত হওয়ার পর আমি এই গোপন দলিলের কথা সবাইকে জানালাম। কয়েকদিন পর আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, শিক্ষক ও অন্যান্যদের দেখালাম। এ খবর শুনে অনেক বিদেশী সাংবাদিক আমার কাছে বহু টাকার বিনিময়ে এই দলিলের অরজিনাল কপি অর্থাৎ আসল টেপ কিনতে চাইলেন।
প্রশ্ন: আপনি রাজি হলেন?
উত্তর: আমার রাজি হবার প্রশ্নই ওঠে না। অরিজিনাল কপি আমি হারালে সেটা বাংলাদেশের জন্য বিরাট ক্ষতির কারণ হতো।
সারাবাংলা/এসবিডিই