ইতিহাস, ঐতিহ্য ও স্থাপত্যের অমর কীর্তি পুরান ঢাকা
২ ডিসেম্বর ২০২৪ ০৯:৪৭ | আপডেট: ২ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৩:২০
বাংলাদেশের রাজধানী শহর ঢাকা। এটি বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত থাকলেও এখন স্থানান্তর করা হয়েছে। তৎকালীন সময়ে প্রশাসনিক কার্যক্রম, ব্যবসা বাণিজ্য, যোগাযোগ ব্যবস্থা পুরান ঢাকায় ছিল। আর সদরঘাট ছিল এর প্রধান কেন্দ্র। এখানে নদীপথে লঞ্চ, স্টিমার, নৌকা চলাচল করে। ফলে খুব সহজে মানুষ পুরান ঢাকা থেকে দক্ষিণ অঞ্চলের বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, খুলনা, বাগেরহাট এবং চাঁদপুরে যাতায়াত করতো। পুরান ঢাকায় আছে হাজার বছরের পুরান ঐতিহ্য। বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত আহসান মঞ্জিল। এখানে ১৯০১ সালে বাংলাদেশে সর্বপ্রথম বিদ্যুতের ব্যবহার করা হয়। নবাব আব্দুল গণি তার পুত্র খাজা আহসানউল্লাহর নাম অনুসারে স্থাপত্যটির নামকরণ করেছিলেন আহসান মঞ্জিল। ঐতিহাসিক এই নিদর্শনের নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছিল ১৮৫৯ সালে ও সমাপ্ত হয়েছিল ১৮৭২ সালে।
পুরান ঢাকার শ্যামবাজার এলাকায় ঊনবিংশ শতকে নির্মিত ভবন তৎকালীন ঢাকার হিন্দু ব্যবসায়ী ভ্রাতৃদ্বয় রূপলাল দাস ও রঘুনাথ দাস তৈরি করেন। রূপলাল ঢাকার বিখ্যাত আর্মেনীয় জমিদার আরাতুনের কাছ থেকে বাড়িটি কিনে বাড়িটির পুনঃনির্মাণ করেছিলেন। কিন্তু এই পুরান নিদর্শন ভূমিদস্যুদের দখলে আছে। তারা সেখানে দখল করে মসলার আড়ৎ করছে। রূপলাল হাউজে দ্বিতীয় তলায় মোট ৫০টিরও বেশি কক্ষ রয়েছে। এছাড়াও রয়েছে কয়েকটি প্রশস্ত দরবার কক্ষ। দোতলায় অবস্থিত নাচ ঘরটি অনেক সুন্দরভাবে নির্মাণ করা হয়েছে। এর মেঝে কাঠ নির্মিত। কারণ তৎকালীন সময়ে রডের ব্যবহার ছিল না। ১৮৮৮ সালে ভারতের ভাইসরয় লর্ড ডাফরিন ঢাকা সফরে আসেম এবং একটি বল নাচের আসর আয়োজন করা হয়েছিল। তিনি বল নাচ দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন।
লক্ষীবাজারের ঋষিকেশ দাস ছিলেন ব্রিটিশ আমলের নব্য ধনী ব্যবসায়ী। কথিত আছে যে, একবার তিনি জমিদার নরেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরীর বাগানবাড়ি বলধা গার্ডেনের এক জলসায় গিয়ে অপমানিত হয়ে ফিরে আসেন। এরপর তিনি রোজ গার্ডেন প্যালেস তৈরির সিদ্ধান্ত নেন। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৯৩১ সালে পুরান ঢাকার ঋষিকেশ দাস রোডে একটি বাগানবাড়ি তৈরী করা হয়। বাগানে প্রচুর গোলাপ গাছ থাকায় এর নাম হয় রোজ গার্ডেন। ১৮৭৪ সালে ভারতের গভর্নর জেনারেল জর্জ ব্যারিং নর্থব্রুক ঢাকায় সফর করেন। তার সফর কেন্দ্র করে একটি টাউন হল নির্মিত হয়। বুড়িগঙ্গার তীর ঘেঁষে ফরাশগঞ্জের এ টাউন হলটিকে নর্থব্রুক হল নামে পরিচিত। তবে ভবনটি লাল রঙের হওয়ায় এটি লালকুঠি নামেই বেশি পরিচিত। বর্তমানে ভবনটির সংস্কার কাজ চলছে। এর পাশেই অবস্থিত ফরাশগঞ্জ স্পোর্টিং ক্লাব।
ঢাকার প্রথম বেসরকারি স্কুল পোগোজ স্কুল। ১৮৪৮ সালে নিজ বাসভবনে স্কুলের যাত্রা শুরু করেছিলেন। ৫ একর জায়গায় অবস্থিত স্কুলটিতে প্রায় ১৫০০ শিক্ষার্থী কে নিয়মিত পাঠ দান করা হচ্ছে! এখানে বর্তমানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট এর ক্লাস হয়। এই স্কুল অনেক পুরাতন ঐতিহ্য বহন করে। এখানে প্রফুল্ল চন্দ্র ঘোষ পশ্চিম বঙ্গের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী, পিকে রায় ঢাকা কলেজের প্রথম অধ্যক্ষ, ভাই গিরিশ চন্দ্র সেন যিনি বাংলায় প্রথম কুরআন শরীফ প্রকাশক পড়াশোনা করেন। এছাড়াও ছাত্র ছিলেন বরেণ্য কবি কালী প্রসন্ন রায়, শামসুর রহমান, কায়কোবাদসহ অনেকে। লক্ষ্মী ভিলা যা বসন্ত বাবুর বাড়ি। এটি ৪৭ বি কে দাস রোড, ফরাশগঞ্জ অবস্থিত। ১৯২৭ সালে বিখ্যাত ব্যবসায়ী বসন্ত কুমার দাসের নামে তার বাড়ির সামনে রাস্তাটির নামকরণ করা হয়। ১৮৫৮ সালে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন নাম ছিল ‘ব্রাহ্ম’ স্কুল। ১৮৭২ সালে স্কুল টির নাম পরিবর্তন করা হয়। প্রতিষ্ঠাতা কিশোরীলাল রায় তার বাবার নাম অনুসারে নাম দেন জগন্নাথ কলেজ। ১৯২১ সালে ঢাকায় প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হলে জগন্নাথ কলেজে স্নাতক কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়। ১৯৪৯ সালে পুনরায় স্নাতক কার্যক্রম চালু হয়। ১৯৬৮ সালে কলেজটিকে সরকারিকরণ করা হয় কিন্তু ১৯৬৯ সালেই তা নাটকীয়ভাবে পুনরায় বেসরকারি করে দেওয়া হয়। ১৯৭১ সালে জগন্নাথ কলেজ পাক বাহিনীর টার্গেটে পরিণত হয়। চালায় নির্মম হত্যাযজ্ঞ। ভাষা শহীদ রফিক ছিলেন জগন্নাথ কলেজের ছাত্র। ১৯৮২ সাল থেকে জগন্নাথ কলেজের জায়গা জমি স্থানীয় ভূমিদস্যুদের কুনজরে পড়ে! শুরু হয় দখলের মহা উৎসব। ১৯৯২ সালে এসে ১৪টি হলের ভেতর মাত্র ৩টি হল থাকে কলেজ কর্তৃপক্ষের হাতে। বাকিগুলো চলে যায় বেদখলে। উল্লেখ্য কলেজ ২০০৫ সালে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিনত হয়।
বাংলাদেশ ব্রাহ্ম সমাজ অবস্থিত ২/৩ লয়েল স্ট্রিট, পাটুয়াটুলী, পুরান ঢাকা। এটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৬৯ খ্রিষ্টাব্দে। ভারতীয় নবজাগরণের অগ্রদূত রাজা রামমোহন রায় ১৮২৮ খ্রিষ্টাব্দে একেশ্বরবাদ প্রচারের উদ্দেশ্যে ‘ব্রাহ্মসমাজ’ প্রতিষ্ঠা করেন। মঙ্গলাবাস, ৩ মোহনী মোহন দাস রোড, শ্যামবাজারে অবস্থিত। সুন্দর কারুখচিত এই অট্টালিকা ছিল টাঙ্গাইলের জমিদার যতীন্দ্র কুমার সাহার ঢাকাস্থ বাসভবন। ১৯৪৭ এর আগ পর্যন্ত উনাদের যাতায়াত ছিল। বর্তমানে এটি সরকারি কবি নজরুল কলেজের ছাত্রাবাস হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। প্রসন্ন বাবুর বাড়ি ৪৫ বিকে দাস রোড, ফরাশগঞ্জ। এটি বড় বাবুর বাড়ি নামে পরিচিত। সুন্দর আল্পনায় নির্মিত এই বাড়ি। হাজী বেগ মসজিদ, পলাশীতে অবস্থিত। ৩৩৯ বছরের প্রাচীন মসজিদ এটি। কিন্তু প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের স্বীকৃতি পায়নি। স্যার নবাব খাজা সলিমুল্লাহ মুসলিম এতিমখানা পুরান ঢাকার, ৪৮ নং আজিমপুর রোডে অবস্থিত। ১৯০৯ সালে এতিমখানাটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে এতিমখানাটির নাম ছিল ‘ইসলামিয়া এতিমখানা’। নবাব সলিমুল্লাহ এতিমখানাটি প্রতিষ্ঠা করেন। শুরুতে আহসান মঞ্জিলের পাশে কুমারটুলি মহল্লায় একটি ভাড়া বাড়িতে এতিমখানাটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯১৫ সালে নবাব সলিমুল্লাহর মৃত্যুর পর এতিমখানাটি অর্থনৈতিক সঙ্কটে পড়ে। সে সময় অনেকেই আর্থিক সহযোগিতায় এগিয়ে আসেন। এমন হাজারও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে পুরান ঢাকায়। সুতরাং প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদপ্তরের উচিত নিদর্শন রক্ষা করা।
লেখক: শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
সারাবাংলা/এসবিডিই