Saturday 13 Sep 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

গর্ভ মায়ের, পদবী কেন বাবার?


২৬ জুন ২০১৮ ১২:৩৮ | আপডেট: ২৬ জুন ২০১৮ ১৬:২২
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

গর্ভধারণের কষ্ট মা করলেও পদবী কেন বাবার

জান্নাতুল মাওয়া।।

আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষকে তাদের  জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একজন মানুষের কথা বলতে বললে উত্তর আসে- মা। সন্তানের জীবনে মা’কে গুরুত্ব দিয়ে কত গদ্য, কাব্য, গীত যে লেখা হয়েছে তার কোন সীমা সংখ্যা নেই। অথচ এই অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ একজন মানুষের নাম সন্তানের কোন গুরুত্বপূর্ণ দাপ্তরিক কাজে এই মাত্র আঠারো বছর আগেও ব্যবহার করা হতোনা। মায়ের নাম জানা ছাড়াই সন্তান বড়  হয়ে যেত, কারণ মায়ের নামের দরকারই  ছিলো না।

২০০০ সালের ২৭ আগস্ট একটি সরকারি  প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে মায়ের নাম ব্যবহারের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। এখন প্রায় সব দাপ্তরিক কাগজেই সন্তানের পরিচয়ে বাবার পাশাপাশি মায়ের নাম উল্লেখ করতে হয়। সন্তানের পরিচয়ে মায়ের নাম থাকাটা অত্যন্ত স্বাভাবিক একটি বিষয় হওয়ার কথা থাকলেও পিতৃতান্ত্রিক সমাজে সন্তানের পরিচয়ে বাবার নামই প্রধান হয়ে ওঠে। সনাতন ধর্ম অনুযায়ী বিয়ের পরে স্ত্রীর গোত্র পরিবর্তন হয়। সেই সাথে বিবাহিত দম্পতির সকল সন্তান বাবার গোত্রপরিচয়েই বেড়ে ওঠে। অন্যান্য ধর্মে গোত্রের বিষয়টি না থাকলেও সন্তানের বংশপরিচয় বাবার বংশ অনুযায়ী নির্ধারিত হয়। তাই বিনা প্রশ্নে সন্তানের নামের পেছনে ঝুলতে থাকে বাবার বংশের পদবি। একটি জরিপ বলছে ইওরোপে চার শতাংশ নারী সন্তানের নামে নিজের সারনেম ব্যবহার করেন। স্পেনে এবং স্প্যানিশ ভাষী দেশগুলোতে সন্তানকে বাবা মা দুজনেরই সারনেম দেয়া হত একসময়। তবে ইদানিং অনেকেই শুধু বাবার নাম নিচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

ইসলাম ধর্মে বাবার নামের অংশ ব্যবহারের বিধানের বিষয়ে দেশের অন্যতম ইসলামি চিন্তাবিদ  মুফতি এনায়েত  জানান, ইসলাম ধর্ম বলছে শিশুর অর্থবহ সুন্দর নাম রাখতে। শিশুর নামের সাথে বাবার নামের অংশ ব্যবহারের বাধ্যবাধকতা ইসলাম ধর্মে নেই। তবে কেউ যদি বাবার পরিচয়ে পরিচিত হতে চায় সেটিকেও গ্রহণযোগ্য বলে মনে করে ইসলাম।

আমাদের দেশে পদবী সংক্রান্ত ঝমেলা বেশ কম। সন্তানের নামের শেষে পারিবারিক পদবী ব্যবহার করার কোন প্রথা এখানে সেভাবে গড়ে ওঠেনি। তবে আমাদের দেশেও অনেককেই দেখা যায় সন্তানের নামের শেষে বা যে কোন অংশে বাবার নামের একটি অংশ জুড়ে দেন। এছাড়াও আমাদের দেশে চৌধুরী, খানসহ বেশ কিছু বংশের মানুষ খুব আগ্রহ করে নিজেদের বংশপরিচয় নামের সাথে বয়ে বেড়ান। আর পশ্চিমের দেশগুলোতে তো এটি একটি অবশ্যপালনীয় প্রথা।

স্ত্রীর নামে স্বামীর নাম জুড়ে দেয়ার বিষয়টির ওপর সন্তানের নামে বাবার নামের অংশ ব্যবহারের প্রত্যক্ষ প্রভাব রয়েছে । এখন পশ্চিমের অনেক সচেতন নারী বিয়ের পরে তাদের নাম পাল্টাননা। কিন্তু সন্তান হবার পরে দেখা যায় সেখানকার রীতি অনুযায়ী সন্তানদের এবং বাবার নাম এক, শুধু মায়ের নাম আলাদা। সে সময় অনেক নারী নিজেকে দলছুট মনে করতে থাকেন। যার ফলে তারাও স্বামীর সারনেম যুক্ত করে ফেলেন নিজের নামের সাথে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান বেবিসেন্টারের একটি জরিপ অনুযায়ী এখন ১৮ শতাংশ নারী তাদের নাম বিয়ের পরে পাল্টাননা। তবে এই জরিপ বলছে এই আঠারো শতাংশের মাঝে অর্ধেক সংখ্যক নারী সন্তান জন্মের পর এক রকম বাধ্য হয়ে নিজের নাম পাল্টান। কারণ হিসেবে এদের প্রায় সবাই জানান, সন্তানের নাম এবং তাদের বাবার নামের অংশ এক। এতে মাঝে মাঝে নিজেকে পরিবারের বাইরের কেউ মনে হয়।

ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টসের ছাত্রী তাফরিহা তারান্নুম জানান, তার সারনেমে বাবার নাম নেই আর এতে তিনি বেশ আনন্দিত। তার আইডেন্টিটি একান্তই তার নিজের। কারো সন্তান এই পরিচয়ে বা কোন বংশ পরিচয়ে পরিচিত হবার বিষয়টিকে তিনি একটা প্রাচীনপন্থী ধারণা বলে মনে করেন। কারো নামের সাথে বংশ পরিচয়ের ব্যবহার সেই মানুষটির সাথে পরিচয়ের শুরুতেই তার সম্পর্কে একটা স্টেরিওটাইপ ধারণা মানুষের মনে জন্মাতে পারে বলে মনে করেন তাফরিহা। অনেকে আবার নামের পেছনে ঝুলে থাকা বংশ পরিচয়ের গৌরবে বেশ গর্বিত থাকেন যা তাফরিহার কাছে হাস্যকর মনে হয়। এছাড়াও বংশ বা বাবার নামে পরিচিত হবার সাথে সাথেই একজন মানুষের ওপর সেই বংশের তথাকথিত ‘গৌরব’ ধরে রাখার একটা বাড়তি  চাপও এসে যায়।  তাফরিহা বলেন, প্রতিটি মানুষই আলাদা। প্রতিটি মানুষের নামও তাই আলাদা হওয়া উচিত।

অপরদিকে নিজের নামের সাথে বাবার নামের অংশ রয়েছে এমন একজন নাশিদ কামাল। একটি  সরকারি  প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা নাশিদ কামালের নামের শেষের অংশটি তার বাবার নামের প্রথম অংশের সাথে মিলিয়ে রাখা হয়েছে। নাশিদ কামাল বলেন,  নাম রাখার ওপরে আমাদের নিজেদের তো কোন হাত নেই। আমরা কিছু  জানার বা বোঝার আগেই আমাদের নাম রাখা হয়ে যায়। তিনি বলেন, যেহেতু তার ভাই আর তার নামে মিল রয়েছে, সেটি তার খুব ভালো লাগে। নামের মিলের সাথে একই পরিবারের মানুষ হবার বোধটি বেশ জড়িয়ে রয়েছে, যা একটা ভালোলাগার জায়গা। আবার খারাপ লাগে যখন অনেকে বলে তাহলে বিয়ের পরে তো নামের শেষ অংশ পাল্টাতে হবে; নাহলে মানুষ এটা তোমার স্বামীর নামের শেষ অংশ বলে ধরে নেবে। তখন বেশ বিরক্ত লাগে। মনে হয় নিজের একটা ইউনিক নাম থাকলেই ভালো হত। নাশিদ আরো জানান, তার মা নিজের আগের নাম পাল্টাননি। এই ব্যাপারটিকে তিনি  সাধুবাদ জানান।

সন্তানের নামে বাবার নাম দেয়া হয়েছে এমন একজন মাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম এই বিষয়ে তার মত কী? এ প্রজন্মের মা লীনা (ছদ্মনাম) জানালেন, সন্তান জন্মের ঠিক পরের সময়টাতে বার্থ সার্টিফিকেটে এই নাম তার স্বামী দিয়েছেন। তিনি সে সময় এত অসুস্থ ছিলেন যে এই নিয়ে ভাবতে পারেননি। তবে এখন তিনি ঠিক করেছেন মেয়ের নাম পালটে ফেলবেন। তিনি আরও বলেন, একটা সন্তান জন্ম দিতে মায়ের যে কী পরিমাণ কষ্ট হয় তার কোন ধারণাই অন্য কারোর নেই। অথচ সেই সন্তানের নামের শেষে শুধু বাবার নাম জ্বলজ্বল করে যা তিনি কিছুতেই মন থেকে মেনে নিতে পারেন না।  হয় মায়ের নামও রাখতে হবে নয়তো সন্তানের নিজস্ব নাম দিতে হবে কারও নামের লেজ ছাড়াই।

অন্যদিকে বেশ আগের প্রজন্মের একজন নারী রিজিয়া খাতুন (ছদ্মনাম) জানান, সন্তানের নামের পেছনে বাবার নাম থাকাটাকেই তিনি স্বাভাবিক বলে জেনে এসেছেন এতদিন। কখনও তো এর ব্যতিক্রম দেখেননি তাই এটাও যে কোন প্রশ্ন করার মত বিষয় হতে পারে সেটাই ভাবেন নি।

কথা হয় এমন একজন বাবার সাথেও যার সন্তানের নামের শেষে নিজের নাম যুক্ত রয়েছে। এই বিষয়ে জনাব প্রীতম হাসান (ছদ্মনাম) বলেন, এটি নিয়ে সিরিয়াসলি কখনো ভাবিনি। আমাদের ভাইবোন কারও নামের সাথেই আব্বার নাম নাই। তবে মেয়ের জন্যে সুন্দর সংক্ষিপ্ত একটা নাম দিতে গিয়ে নিজের নামের অংশ ব্যবহার করেছি। এতে আমার স্ত্রীরও আপত্তি ছিলোনা। তবে এখন আপনি বলার পর ভাবছি।

সন্তান শুধুমাত্র পিতৃপরিচয়েই পরিচিত হবে এই ধারণাটি আমাদের  সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এমনভাবে গেঁথে গিয়েছে যে এটা নিয়ে অনেকেই এতদিন ভাবেননি হয়তো। তবে নতুন প্রজন্মের মানুষেরা ভাবতে শুরু করেছে প্রচলিত এইসব অযৌক্তিক এবং নারীর প্রতি অবমাননাকর  নিয়ম নিয়ে। নতুন করে তোলা প্রশ্নগুলোকে সমস্যা হিসেবে না নিয়ে যখন  বিদ্যমান এই বিষয়গুলোকে মানুষ সমস্যা বলে মনে করা শুরু করবে তখন সমাধানের দরজাও খুলে যাবে খুব সহজেই।  বর্তমান প্রেক্ষাপটে এই আশাটুকু অন্তত করা যায়।

সারাবাংলা/এসএস

** দ্রুত খবর জানতে ও পেতে সারাবাংলার ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে রাখুন: Sarabangla/Facebook

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর