Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ?

মোহাম্মদ আবু সালেহ
১ জুলাই ২০২২ ১০:৪৭

গত কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন মহল থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠছে, তিনি নাকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় সরাসরি বিরোধিতা করেছিলেন। ২০২০ সালের ১ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষে পদার্পণ উপলক্ষে এ বিষয়টি আবারও জোরালোভাবে আলোচনায় উঠে আসে। এরপর ২০২১ সালের ১ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার গৌরবোজ্জ্বল একশো বছর পূর্ণ করেছে। গতবছরে এই গৌরব উদযাপেনের সময়ে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও ব্লগে কোনো রেফারেন্স ছাড়াই রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে বলা হয় যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তিনি নাকি বিরোধিতা করে বলেছেন, ‘মূর্খদের দেশে আবার কিসের বিশ্ববিদ্যালয়? এরা তো ঠিকমতো কথাই বলতে পারে না!’

বিজ্ঞাপন

রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে যারা জানেন এবং যারা তার লেখা ও কর্মের সঙ্গে পরিচিত তারা নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন এ ধরনের মন্তব্য কবিগুরুর ব্যক্তিত্বের সঙ্গে যায় না। রবীন্দ্রনাথের সমস্ত সাহিত্যকর্ম ও বক্তৃতার কোথায় এ মন্তব্য করেছেন, এমন কোনো তথ্যসূত্র কেউ উল্লেখ না করেই অপবাদ দিয়ে তার বিরুদ্ধে বিষোদগার ছড়াচ্ছেন। অত্যন্ত আলোচিত ও বিতর্কিত এ বিষয়টি আণুবীক্ষণিক চোখ দিয়ে গবেষকের দৃষ্টিতে অনুসন্ধানের মাধ্যমে অত্যন্ত নিরপেক্ষ, নৈর্ব্যক্তিক ও নির্মোহভাবে ঘটনার সত্যতা যাচাইয়ের চেষ্টা করা হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে অভিযোগের কারণ

বঙ্গভঙ্গের সময় (১৯০৫) রবীন্দ্রনাথ ছিলেন উগ্র জাতীয়তাবাদী, সে কারণে তিনি বাংলা ভাগ চাননি। কিন্তু ১ম বিশ্বযুদ্ধের পরে তিনি জাতীয়তাবাদের কুফল বুঝতে পেরে ক্রমশ আন্তর্জাতিকতাবাদের দিকে ঝুঁকে পড়েন।

রবীন্দ্রনাথ মনেপ্রাণে অসাম্প্রদায়িক ছিলেন। কিন্তু তিনি সাম্প্রদায়িকতা ঘৃণা করলেও সাম্প্রদায়িক দলগুলোর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর মতো দৃঢ়তা দেখাতে পারেননি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকালীন রবীন্দ্রনাথ ভারতের বড়লাট লর্ড হার্ডিঞ্জের কাছে হিন্দু-অধ্যুষিত বোলপুরে বিশ্বভারতীকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে রবীন্দ্রনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে মৌন ছিলেন।

রবীন্দ্রনাথ বারবার স্বীকার করেছেন যে, সরকারি চাকরিতে মুসলমানরা ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ না করায় বঞ্চিত হয়েছে এবং এ বৈষম্য আস্তে আস্তে দূর করা দরকার। কিন্তু কম যোগ্য মুসলমান অনগ্রসর হওয়া সত্ত্বেও কোটা প্রথায় চাকরি পাবে আর যোগ্য হিন্দু প্রার্থীরা কোটার কারণে বেকার থাকবে— তাই তিনি মুসলমানদের জন্য কোটা মানতে চাননি। মুসলমানদের জন্য সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিলের পক্ষে তার অনিচ্ছাসত্ত্বেও তাকে স্বাক্ষর করতে হয়েছে। সুদূরপ্রসারী চিন্তা থেকে রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন দীর্ঘমেয়াদে হিন্দু মুসলমান সম্পর্ক কোটা দিয়ে সমাধান হবে না, মুসলমানদের হিন্দুদের সমকক্ষতা অর্জন করতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় যারা বিরোধিতা করেছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম প্রধান ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখার্জি, ড. রাসবিহারী ঘোষ ও রাজনীতিবিদ সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি। এদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ওঠাবসা ছিল। কোনো প্রকার তথ্যপ্রমাণ ছাড়াই এ থেকে কেবল ধারণা করা হয়, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধিতা করেছিলেন।

শুধুমাত্র ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে রবীন্দ্রনাথের লেখা না পড়েই তাকে মুসলিমবিদ্বেষী ভাবা হয় ও তার বিরুদ্ধে পৌত্তলিকতার অভিযোগ আনা হয়। অথচ রবীন্দ্রনাথ ছিলেন একেশ্বরবাদী ব্রাহ্ম ধর্মের অনুসারী। তার লেখায় পৌত্তলিকতা স্থান পায়নি।

রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে অভিযোগ ও তার খণ্ডন

সর্বপ্রথম ২০০০ সালে আহমদ পাবলিশিং হাউস থেকে প্রকাশিত সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) প্রধান ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল এম এ মতিনের লেখা ‘আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ধারাবাহিকতা এবং প্রাসঙ্গিক কিছু কথা’ নামক বইয়ে উল্লেখ করা হয়, ‘১৯১২ সালের ২৮ মার্চ কলিকাতার গড়ের মাঠে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সভাপতিত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রতিবাদে এক বিশাল জনসভার আয়োজন করা হয়। এখানে বলা প্রয়োজন যে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো ব্যক্তিত্বও সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন। কারণ হিসেবে বলা যেতে পারে যে, রবীন্দ্রনাথ তখন ছিলেন হিন্দু সমাজ তথা হিন্দু মনমানসিকতা ও হিন্দু চেতনা ও হিন্দু ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ একজন হিন্দু স্বভাবকবি।’

এ তথ্য প্রকাশিত হওয়ার পর এ জেড এম আবদুল আলী সমকাল পত্রিকায় এ বক্তব্যের সত্যতা চ্যালেঞ্জ করে রেফারেন্স বা তথ্যসূত্র জানতে চান, কিন্তু কোনো জবাব পাওয়া যায়নি। ২০১৪ সালে অক্টোবর মাসে বই পত্রিকায় অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষ ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও রবীন্দ্র প্রসঙ্গ’ নামে একটি নিবন্ধে এ বক্তব্যের অসত্যতা প্রমাণ করেন।

বস্তুত রবীন্দ্রনাথের পক্ষে ১৯১২ সালের ২৮ মার্চ এ ধরনের সভায় সভাপতিত্ব করা দূরের কথা, উপস্থিত থাকাই সম্ভব ছিল না। ১৯১২ সালের ১৯ মার্চ রবীন্দ্রনাথের কলকাতা থেকে ‘সিটি অব প্যারিস’ জাহাজে ইংল্যান্ড যাত্রার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এর আগের দিন জাহাজে তার মালপত্র তুলে দেওয়া হয়। কিন্তু ১৯ মার্চ অসুস্থ হওয়ার ফলে তিনি জাহাজে উঠতে পারেননি। কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ এ ঘটনা নিম্নরূপে বর্ণনা করেছেন যা প্রশান্তকুমার পাল সম্পাদিত ‘রবিজীবনী (১৯৯৩)’, ৬ষ্ঠ খণ্ডে উদ্ধৃত হয়েছে।

“জাহাজ ছাড়বার আগের দিন রাত্রে স্যার আশুতোষ চৌধুরীর বাড়িতে বাবার নিমন্ত্রণ। কেবল খাওয়াদাওয়া নয়, সেই সঙ্গে ‘বাল্মীকিপ্রতিভা’ অভিনয়ের ব্যবস্থা হয়েছিল। দীনেন্দ্রনাথ বাল্মীকির ভূমিকায় অভিনয় করলেন। অসুস্থ শরীরে বাবাকে অনেক রাত অবধি জাগতে হলো। আমরা ঘরে ফিরলাম বেশ রাত করে। বাকি রাতটুকু বাবা না ঘুমিয়ে চিঠির পর চিঠি লিখে কাটিয়ে দিলেন। ভোরবেলা উঠে বাবার শরীরের অবস্থা দেখে আমরা ভয় পেয়ে গেলাম, ক্লান্তিতে অবসাদে যেন ধুঁকছেন। তাড়াতাড়ি ডাক্তার ডাকতে পাঠানো হলো।….জাহাজ আমাদের জিনিসপত্র সমেত যথাসময়ে পাড়ি দিল, কিন্তু আমাদের সে যাত্রা আর যাওয়া হলো না।”

প্রশান্তকুমার পাল রবিজীবনীর (১৯৯৩) ৬ষ্ঠ খণ্ডে আরও উদ্ধৃত করেন, ১৯১২ সালে ২১ মার্চ রবীন্দ্রনাথ ডা. দ্বিজেন্দ্রনাথ মিত্রকে লেখেন— ‘আমার কপাল মন্দ—কপালের ভিতরে যে পদার্থ আছে, তারও গলদ আছে—নইলে ঠিক জাহাজে ওঠবার মুহূর্তেই মাথা ঘুরে পড়লুম কেন? অনেক দিনের সঞ্চিত পাপের দণ্ড সেইদিনই প্রত্যুষে আমার একেবারে মাথার উপরে এসে পড়ল। রোগের প্রথম ধাক্কাটা তো একরকম কেটে গেছে, এখন ডাক্তারের উৎপাতে প্রাণ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে।’

ডাক্তারের পরামর্শে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য রবীন্দ্রনাথ কলকাতা থেকে শিলাইদহ চলে যান ১১ চৈত্র বা ২৪ মার্চ। এর প্রমাণস্বরূপ রবীন্দ্রজীবনীকার প্রশান্তকুমার পাল ঠাকুরবাড়ির ক্যাশ বইয়ের হিসাব উদ্ধৃত করেন। ২৫ মার্চ তিনি শিলাইদহ থেকে কাদম্বিনী দেবীকে চিঠি লেখেন। ২৮ মার্চ ১৯১২ সালে তিনি শিলাইদহ থেকে জগদানন্দ রায়কে চিঠি লেখেন। ওই দিন থেকেই তিনি শিলাইদহে গীতিকবিতা লেখা শুরু করেন। তার গীতিমাল্য কাব্যগ্রন্থে ‘স্থির নয়নে তাকিয়ে আছি’ কবিতাটির নিচে লেখা আছে ‘শিলাইদহ ১৫ই চৈত্র ১৩১৮’ (২৮ মার্চ ১৯১২ খ্রিস্টাব্দ)। গীতাঞ্জলী কাব্যগ্রন্থেও একই তারিখ রয়েছে। ২৮ মার্চ যিনি শিলাইদহে বসে কবিতা লিখেছেন, তার পক্ষে একই দিনে কলকাতার গড়ের মাঠে বক্তৃতা করা সম্ভব ছিল না।

সাবেক সচিব ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান তার ‘দুর্ভাবনা ও ভাবনা: রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে’ (প্রথমা প্রকাশন, ২০১৯) গ্রন্থে এ বিষয়ে অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ ও অনুসন্ধান করে বলেছেন— ‘এই তারিখ ছাড়া রবীন্দ্রনাথ অন্য কোনো তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধী কোনো সভায় অংশ নিয়েছেন, এ রকম কোনো তথ্য রবীন্দ্রবিদ্বেষীরা এখন পর্যন্ত পেশ করেননি।’

দ্বিতীয়ত, ২০০১ সালে অধ্যাপক আহমদ শরীফ ‘রবীন্দ্র-উত্তর তৃতীয় প্রজন্মে রবীন্দ্র মূল্যায়ন’ নামে একটি প্রবন্ধ লেখেন। এই প্রবন্ধে তিনি বলেন, ‘রবীন্দ্রানুরাগী ও রবীন্দ্র স্নেহভাজন অন্নদাশঙ্কর রায় বলেছেন, রবীন্দ্রনাথ তার ত্রুটি-নিন্দা-কলঙ্কের সাক্ষ্য প্রমাণ সতর্ক প্রয়াসে অপসারিত বা বিনষ্ট করতেন।’

ড. আকবর আলি খান তার পূর্বোক্ত বইয়ে ‘রবীন্দ্রনাথ ও সাম্প্রদায়িকতা‘ অধ্যায়ে ড. আহমদ শরীফের ওপর বিরক্ত হয়ে লেখেন— ‘গবেষণামূলক প্রবন্ধে এ ধরনের বক্তব্যের সমর্থনে অবশ্যই সূত্রের উল্লেখ করতে হয়। অধ্যাপক শরীফ এ বক্তব্যের ওপর ১০ নম্বর পাদটীকা বসান। আমি খুশি হয়ে ১০ নম্বর পাদটীকাতে গিয়ে দেখি তিনি লিখেছেন, অন্নদাশঙ্কর রায়ের উক্তিটি কোথায় দেখেছি মনে পড়ছে না। গুজবভিত্তিক বক্তব্যে খিস্তিখেউর লেখা যায় কিন্তু যুক্তিভিত্তিক গবেষণামূলক প্রবন্ধ লেখা সম্ভব হয় না।’

রবীন্দ্রবিরোধী বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই অপপ্রচার চালাচ্ছেন।  এইরকম একটি লেখায় দেখা যাচ্ছে, সেখানে উল্লেখ করা আছে নীরদ চন্দ্র চৌধুরী তার ‘অটোবায়োগ্রাফি অব এন আননোন ইন্ডিয়ান’ গ্রন্থে লিখেছেন, রবীন্দ্রনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু তন্নতন্ন করে খুঁজে ও বই ঘেঁটে দেখা গেল নীরদ চন্দ্র চৌধুরী তার আত্মজীবনীতে রবীন্দ্রনাথ যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছেন এরূপ কোনো মন্তব্যই করেননি। নীরদচন্দ্র চৌধুরী রবীন্দ্রানুরাগী ছিলেন না বলে তারা ধরেই নিয়েছেন, তিনি রবীন্দ্রনাথের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতার ব্যাপারে বলেছেন।

২০১০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট অধিবেশনে এক বক্তৃতায় তদানীন্তন উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতা উদ্ধৃত করে বক্তব্য পেশ করলে সিনেটের একজন সদস্য এ উদ্ধৃতি প্রত্যাহার করতে বলেন। অবশ্য রবীন্দ্রনাথ যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছেন, তার কোনো প্রমাণ সিনেটের সদস্য দাখিল করতে পারেননি। তবুও এ গুজব একটা গোষ্ঠী উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ছড়াচ্ছে।

কারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধিতা করেছিলেন

সে সময়ে রবীন্দ্রনাথের আচরণ সম্পর্কে আমিনুল ইসলাম ‘রবীন্দ্রমানস ও মুসলিম সমাজ’ (২০১১) গ্রন্থে লিখেছেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে সেদিন পথে নেমেছিল হিন্দু সংবাদপত্রগুলি, হিন্দু বুদ্ধিজীবী ও নেতাগণ। গিরিশচন্দ্র ব্যানার্জি, রাসবিহারী ঘোষ এমনকি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর স্যার আশুতোষ মুখার্জির নেতৃত্বে বাংলার এলিটগণ পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে ১৮ বার স্মারকলিপি দেন লর্ড হার্ডিঞ্জকে। রবীন্দ্রনাথ এই সময় মৌন ছিলেন।’ এ তথ্যসূত্র থেকে দেখা যাচ্ছে রবীন্দ্রনাথ প্রত্যক্ষভাবে ঢাকা ইউনিভার্সিটির বিরুদ্ধে নামেননি, আবার যারা বিরোধিতা করেছিলেন তাদের ব্যাপারেও সরাসরি প্রতিবাদ করেননি।

বঙ্গভঙ্গ রদের (১৯১১) সান্ত্বনা হিসেবে লর্ড হার্ডিঞ্জ ১৯১২ সালে ঘোষণা দেন, পূর্ববঙ্গে একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করবেন। কিন্তু শুরুতেই তা বাধার সম্মুখীন হয়। লর্ড হার্ডিঞ্জের ঢাকা সফর শেষে কলকাতা ফিরে যাওয়ার পরে ১৯১২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ড. রাসবিহারী ঘোষের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের বিরোধিতা করে স্মারকলিপি দেয়। রাসবিহারী ঘোষের সঙ্গে একমত ছিলেন বিপিন চন্দ্র পাল, সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি, সুরেন্দ্রনাথ সমাজপতি, ব্যারিস্টার ব্যোমকেশ চক্রবর্তী, পেয়ারী মোহন মুখোপাধ্যায়, অম্বিকা চরণ মজুমদারের মতো নেতারা। ভাইসরয় তাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় হলে সেটি কোনো মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় হবে না, বরং সবার জন্য উন্মুক্ত সাধারণ একটি বিশ্ববিদ্যালয় হবে।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় শুরু থেকেই ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের বিরোধিতা করে আসছিলেন। পরবর্তীকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার তার ‘ঢাকার স্মৃতি’ নামক একটি প্রবন্ধে লিখেছিলেন, ‘ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়কে বলেছিলেন, তিনি ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তিনি সরাসরি আশুতোষ বাবুর কাছে জানতে চেয়েছিলেন, কিসের বিনিময়ে তিনি ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের বিরোধিতা থেকে বিরত থাকবেন। শেষ পর্যন্ত আশুতোষ মুখোপাধ্যায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে চারটি নতুন প্রফেসর পদ সৃষ্টির বিনিময়ে বিরোধের অবসান ঘটান।’

যাদের অবদানে আজকের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য নাথান কমিশন গঠন করা হয়। নাথান কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশের পরে ইউরোপজুড়ে শুরু হয়ে যায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের তোড়জোড়। ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় হবে, এই স্বপ্ন চাপা পড়ে যায় কাগজের স্তুপে। ঢাকার প্রভাবশালী স্যার নওয়াব সলিমুল্লাহ নানাভাবে ব্রিটিশ প্রশাসনকে চাপ দিয়ে বারবার বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন। ১৯১৪ সালে তার মৃত্যুর পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে ইংরেজ প্রশাসনকে চাপ দেওয়ার কাজটি হাতে তুলে নিয়েছিলেন তার ছেলে নওয়াব আলী চৌধুরী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবীকে বারবার সামনে নিয়ে আসতে তার সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন নবাব সিরাজুল ইসলাম, স্যার সৈয়দ শামসুল হুদা, আবদুল করিম, খানবাহাদুর আহছানউল্লা ও শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের মতো নেতারা।

ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হলে মধ্যবিত্তদের আর কষ্ট করে কলকাতায় গিয়ে পড়তে হবে না ভেবেই ঢাকার বালিয়াটির (মানিকগঞ্জ, সাটুরিয়া) জমিদার কিশোরীলাল রায় চৌধুরী এই বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণে প্রচুর অর্থদান করেছিলেন। এ কারণে জগন্নাথ হলের নামকরণ হয় তার পিতা জগন্নাথ রায় চৌধুরীর নামে। তার পিতা জগন্নাথ রায় চৌধুরী ঢাকা জগন্নাথ কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ১৮৫৮ সালে ঢাকা ব্রাহ্ম স্কুল, ১৮৬৮ সালে নাম বদলে জগন্নাথ স্কুল, ১৮৮৪ সালে জগন্নাথ কলেজ এবং ২০০৫ সালে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত করা হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় বিরোধিতার কারণ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় বিরোধিতার কারণ অনুসন্ধানে আমরা নিচে উল্লেখিত বহুমুখী ও বিচিত্র দিক খুঁজে পাই—

বঙ্গভঙ্গ ও বঙ্গভঙ্গ রদ

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক বিরোধিতা ও এর উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখার্জির বিরোধিতা

তৎকালীন কলকাতা ও পূর্ববঙ্গের হিন্দু এলিটদের বিরোধিতা

আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয় এবং অবাঙালি মুসলমান নেতাদের বিরোধিতা

একই সময়ে বোলপুরে রবীন্দ্রনাথ কর্তৃক বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদনের আবেদন

একই সময়ে ড. রাশবিহারী ঘোষ কর্তৃক যাদবপুরে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের আবেদন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পরও বাংলার প্রথম শিক্ষামন্ত্রী প্রভাসচন্দ্র মিত্রের বিরোধিতা

বঙ্গভঙ্গ ও বঙ্গভঙ্গ রদের প্রভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পেছনে বিরোধিতার কারণগুলো বুঝতে হলে অবশ্যই আমাদের বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে কী ঘটেছিল তা জানতে হবে, আর সেসময়কার আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট কেমন ছিল তাও বুঝতে হবে।

বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার বিশাল ভূখণ্ডের প্রদেশটি এবং তার বিপুল জনগোষ্ঠী একজন লেফটেন্যান্ট গভর্নরের অধীনে থাকায় শাসন কাজে সমস্যা হচ্ছিল। ব্রিটিশ সরকার প্রশাসনিক সুবিধার জন্য পূর্ববাংলাকে আসামের সঙ্গে যুক্ত করে নতুন একটি প্রদেশ গঠনের পরিকল্পনা নেয় উনিশ শতকের শেষ দিকে। গভর্নর জেনারেল লর্ড কার্জন ভারত সচিবের সঙ্গে আলোচনা করে বাংলা ভাগ করে নতুন প্রদেশ গঠনের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক স্বার্থে বাঙালি হিন্দু নেতারা বাংলা ভাগের তীব্র প্রতিবাদ জানান। শুধু মৌখিক প্রতিবাদ নয়, তারা এর বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলেন। কিন্তু তাদের প্রতিবাদ সত্ত্বেও ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর নতুন প্রদেশ যাত্রা শুরু করে। নতুন লে. গভর্নর নিযুক্ত হন স্যার ব্যামফিল্ড ফুলার, যিনি তার আগে ছিলেন আসামের কর্মকর্তা। এটিই বঙ্গভঙ্গ নামে পরিচিত।

এখানে উল্লেখ্য যে, রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন লেখায় ও কবিতায় উঠে এসেছে যে, তিনি বঙ্গভঙ্গ চাননি। রবীন্দ্রনাথ সেসময় জাতীয়তাবাদী ছিলেন কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর তিনি উগ্র জাতীয়তাবাদের কুফল বুঝতে পেরে ক্রমশ আন্তর্জাতিকতাবাদের দিকে ঝুঁকে পড়েন। ইতোমধ্যে তিনি ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কারে ভূষিত হন এবং সারা পৃথিবীর কাছে বাংলা ভাষাকে সুউচ্চে তুলে ধরেন। রবীন্দ্রনাথের পরবর্তী রচনায় উঠে এসেছে উগ্র জাতীয়তাবাদের কুফল ও ভয়াবহতা। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, এর মাধ্যমে আর হিন্দু মুসলমানের ঐক্য ধরে রাখা সম্ভব নয়। তাই তিনি বঙ্গভঙ্গের সময়কার জাতীয়তাবাদ থেকে সরে আসেন।

শাসনকাজের সুবিধার কথা বলে ব্রিটিশ সরকার বাংলাকে দুই ভাগ করলেও এর পেছনে তাদের চাতুর্য ও ভেদনীতিও কাজ করছিল। যা হোক, ঢাকাকে রাজধানী করে নতুন ‘পূর্ববাংলা ও আসাম প্রদেশে’র সৃষ্টি এ অঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের সমর্থন পেয়েছিল। এ সমর্থন শুধু সাম্প্রদায়িক বা রাজনৈতিক কারণেই ছিল না, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও অর্থনৈতিক কারণেই প্রথম বঙ্গভঙ্গ এ অঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কাছে সমর্থিত ও গ্রহণযোগ্য হয়েছিল। বঙ্গভঙ্গের ফলে এ পূর্ববাংলার শিক্ষার সুযোগ বঞ্চিত মুসলমান ও তফসিলি সম্প্রদায় আধুনিক শিক্ষা লাভের সুযোগ পায়। বিশ শতকের গোঁড়ার দিকে প্রচুর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয় এবং শিক্ষার হারও উল্লেখযোগ্য হারে বাড়তে থাকে। বঙ্গভঙ্গের সুবিধা এ অঞ্চলের মানুষ পেতে লাগলো।

যদিও মুসলমানরা আধুনিক ইংরেজি শিক্ষায় পিছিয়ে থাকায় নতুন প্রদেশে আরও বহু বছর হিন্দুদেরই প্রাধান্য থাকতো, কিন্তু হিন্দু জমিদার ও আইনজীবীরা কিছুতেই নতুন প্রদেশকে মেনে নিতে পারেননি। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হয়। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের ডাক নাম ‘স্বদেশী আন্দোলন’। এক পর্যায়ে তা সরকারবিরোধী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে রূপ নেয়। গোটা ভারতবর্ষে হিন্দুরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। তাই তাদের দাবি মেনে নিয়ে ১৯১১ সালের ডিসেম্বরে নতুন প্রদেশ বাতিল ঘোষিত হয়। এর নাম বঙ্গভঙ্গ রদ।

রাজকীয় ক্ষতিপূরণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আশুতোষ মুখার্জি স্যাডলার কমিশনের সদস্য হওয়া সত্ত্বেও পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেন। বঙ্গভঙ্গ রদের পটভূমিকায় পূর্ববাংলার ক্ষুব্ধ মুসলমান সমাজকে প্রবোধ দেওয়ার জন্য ব্রিটিশ সরকার সান্ত্বনা স্বরূপ ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের আশ্বাস দেয়। গভর্নর লর্ড লিটনের ভাষায়, ‘বঙ্গভঙ্গ রদের এক উজ্জ্বল রাজকীয় ক্ষতিপূরণ ‘A splendid imperial compensation’।

নবাব পরিবারের ভূমিকা ও রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সম্পর্ক

উচ্চশিক্ষা ও বাঙালি মুসলমানের প্রতি নবাব সলিমুল্লাহর অবদান অপরিসীম। মুসলমান সমাজ আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে হিন্দুদের সঙ্গে সমান তালে চলার ক্ষমতা অর্জন করুক—তা ছিল নবাব পরিবারের সকলের প্রধান আকাঙ্ক্ষা। বাঙালির শিল্পসাহিত্য সম্পর্কে তাদের উৎসাহ ছিল অসামান্য। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নবাব পরিবারের অব্যাহত যোগাযোগ ছিল।

পূর্ববাংলায় মুসলমানদের জন্য একটি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য মুসলমান বুদ্ধিজীবীদের পক্ষ থেকে প্রথম দাবি উঠে ১৮৮২ সালে। সে দাবি ততোটা জোরালো না হলেও ইংরেজদের কিছুটা দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছিল। পরবর্তীতে ১৯০৬ সালের ২৯ ডিসেম্বর মোহামেডান এডুকেশন কনফারেন্সের ২০তম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় ঢাকায়। এই সম্মেলনেই নবাব সলিমুল্লাহর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় নিখিল ভারত মুসলিম লীগ। সম্মেলনে ভাষণদানকালে কনফারেন্সের অনারারি জয়েন্ট সেক্রেটারি ব্যারিস্টার খান সাহেবজাদা আফতাব আহমেদ ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করে তা প্রতিষ্ঠার দাবি জানান।

এই অঞ্চলের কোনো কোনো হিন্দু নেতাও তার সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করেন। নবাবদের একজন অকৃত্রিম বন্ধু ছিলেন ফরাশগঞ্জের জমিদার ও ব্যবসায়ী মোহিনীমোহন দাস। তিনি ছিলেন একজন অসাম্প্রদায়িক ও অসামান্য হৃদয়বান মানুষ। অসংখ্য জনহিতকর কাজ তিনি করেছেন।

মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার পর ঘোষিত ও লিখিত নীতি ছিল হিন্দুদের বা কংগ্রেসের বিরুদ্ধে কোনো আন্দোলন নয়; শুধু যেসব ক্ষেত্রে মুসলমানরা বৈষম্যের শিকার, সেসব ব্যাপারে তাদের স্বার্থ রক্ষা করা। রাজনীতিতে মুসলিম লীগ রক্ষণশীল হলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় শেরেবাংলা একে ফজলুল হকসহ এর নেতাদের অবদান সবচেয়ে বেশি।

বঙ্গভঙ্গ রদের পরে নবাব সলিমুল্লাহর শারীরিক ও মানসিক অবস্থা তুলে ধরে সৈয়দ আবুল মকসুদ তার ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন- ‘নতুন প্রদেশ বাতিল হওয়ার পর সলিমুল্লাহ শারীরিক ও মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। বস্তুত, জাতীয় রাজনীতিতে তিনি উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন। বেশিরভাগ সময় ধর্ম-কর্ম নিয়ে থাকতেন,… সভা-সমাবেশে বিশেষ যেতেন না। শুধু রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরষ্কার পাওয়ার পর কবিকে অভিনন্দন জানাতে আয়োজিত একটি সভায় ঢাকা বার লাইব্রেরিতে গিয়েছিলেন অল্প সময়ের জন্য।’ [পৃ.৫৭]

এ থেকে অনুমেয় রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নবাব পরিবারের সম্পর্ক কেমন ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব ও হিন্দু এলিটদের বিরোধিতা মূলত চরমে উঠে ১৯১২ সালে ও এর পরবর্তী সময়ে। রবীন্দ্রনাথ যদি ১৯১২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ড. রাসবিহারী ঘোষের নেতৃত্বে ভারতের বড়লাট লর্ড হার্ডিঞ্জের কাছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধিতা করে স্মারকলিপি পেশ করার ব্যাপারে সমর্থন করতেন, তাহলে নিশ্চয়ই নবাব সলিমুল্লাহ রবীন্দ্রনাথকে অভিনন্দন জানাতে আয়োজিত অনুষ্ঠানে যেতেন না।

হৃদরোগ ও ডায়াবেটিকসের প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় নবাব স্যার সলিমুল্লাহ ১৯১৫ সালের ১৬ জানুয়ারি কলকাতায় মারা যান। তার মরদেহ ঢাকায় নিয়ে এলে জানাজায় ও শবযাত্রায় মুসলমান ও হিন্দুর উপস্থিতি ছিল সমপরিমাণ। নবাব সলিমুল্লাহর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার বর্ণনা থেকেও তৎকালীন পূর্ববঙ্গের নেতৃবৃন্দের প্রতি হিন্দু মুসলমানের দৃষ্টিভঙ্গির একটা নমুনা পাওয়া যায়।

নবাব সলিমুল্লাহর মৃত্যুর পর প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর পরিস্থিতিতে তার ছেলে নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ সময়ে হাল ধরেন, যখন ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব বানচাল হতে চলেছিল। তিনি ১৯১৭ সালের মার্চ মাসে ইমপেরিয়াল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলে সরকারের কাছে অবিলম্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিল পেশের আহ্বান জানান।

রবীন্দ্রনাথের ঢাকা সফরগুলো

গোপালচন্দ্র রায়ের ‘ঢাকায় রবীন্দ্রনাথ’ গ্রন্থসূত্রে জানা যায়, রবীন্দ্রনাথ তার জীবদ্দশায় মাত্র দু’বার ঢাকা ভ্রমণ করেছিলে— ১৮৯৮ ও ১৯২৬ সালে। প্রথমবার ১৮৯৮ সালের ৩০ মে তিনি ঢাকায় এসেছিলেন ১ জুনের বঙ্গীয় প্রাদেশিক সম্মেলনের দশম অধিবেশনে যোগদান করতে। সেবার তাকে নিয়ে ততোটা মাতামাতি না হলেও তার দ্বিতীয় আগমন (১৯২৬ সালে) নিয়ে শুধু যে মাতামাতিই হয়েছে তা নয়, ঢাকাবাসীর মধ্যে রীতিমতো প্রতিযোগিতা ও দলাদলি শুরু হয়ে যায় যে, কবিগুরু কোথায় থাকবেন, কী খাবেন এসব বিষয় নিয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ও অধ্যাপক আর সি মজুমদারের বাসায় থাকার ব্যাপারে তখনকার দৈনিক সংবাদপত্রে খবর প্রকাশিত হলেও তিনি সেখানে থাকেননি।

ঢাকার বিশিষ্ট নাগরিকেরা মনে করেন রবীন্দ্রনাথ শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেহমান নন, তিনি সমগ্র ঢাকাবাসীর মেহমান— এ নিয়ে তারা দু’টি দলে বিভক্ত হয়ে পড়েন। অধিকাংশের মতে, তিনি মূলত ঢাকাবাসীর দলাদলির হাত থেকে রক্ষা পেতে বুড়িগঙ্গার নৌযান বেছে নেন। রবীন্দ্রনাথ শেষ পর্যন্ত বুড়িগঙ্গার তীরে ওয়াইজঘাটে বাধা ঢাকার নবাবদের রাজকীয় জলযান তুরাগ হাউজ বোটে গিয়ে উঠেন। বিশিষ্ট সাহিত্যিক বুদ্ধদেব বসু তার ‘আমার ছেলেবেলা’ গ্রন্থে এ ঘটনার স্মৃতিচারণ করেছেন। কবিগুরু তুরাগ হাউজ বোটে অবস্থানকালে প্রায় প্রতিদিন সকালে ঢাকার নবাবদের একটি মোটর বোটে করে জলভ্রমণ করতেন। -এ থেকেও প্রমাণিত হয় রবীন্দ্রনাথ যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করতেন তাহলে ঢাকাবাসী তাকে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাত্র পাঁচ বছর পরে এতো মাতামাতি করতেন না।

নেপথ্যে উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখার্জির ভূমিকা

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর বাঙালি মুসলমানের ক্ষোভ ছিল ১৯০৫ সালে পূর্ববাংলা ও আসাম প্রদেশ গঠনের অনেক আগে থেকেই। উনিশ শতকের শেষ দিক থেকেই তারা সভা-সমাবেশে, আলোচনায় এবং লিখিতভাবে সেই ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন। ক্ষোভের কারণ শিক্ষাক্রমে হিন্দু ধর্ম প্রাধান্য পাওয়ায় মুসলমানদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়। আরেকটি কারণ হলো, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈষম্যমূলক আচরণ, স্টেট স্কলারশিপ বিতরণে মুসলমান ছাত্রদের বঞ্চিত করা। সেসময় মীর মশাররফ হোসেন ও নবনূর পত্রিকার সম্পাদক সৈয়দ এমদাদ আলী এসব বিষয়ে প্রচুর লেখালেখি করেছেন।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে একরকম হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় বিবেচনা করে মুসলমান নেতারাও একপর্যায়ে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে ‘মুসলমান বিশ্ববিদ্যালয়’ বা ‘আরবি বিশ্ববিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠা করার কথা বলছিলেন। আসলে একপ্রকার বঞ্চনা থেকেই এসব প্রস্তাব উঠেছিল। হিন্দুরা যেহেতু শিক্ষায়, শক্তিতে, সংখ্যাগরিষ্ঠতায় এবং ক্ষমতায় মুসলমানদের তুলনায় এগিয়ে ছিল, তাদের দূরদর্শিতা ও উদারতার পরিচয় মুসলমানরা একই নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী হওয়ার সুবাদে পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তার পরিবর্তে হিন্দুরা বিংশ শতাব্দীর গোঁড়ার দিকে সংকীর্ণ ও সাম্প্রদায়িক আচরণ করার ফলে দুর্বল পক্ষ হিসেবে মুসলমানদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী চেতনার সৃষ্টি হয়। পরিণতিতে কয়েক দশক পরেই ১৯৪৭ সালে দেখা দেয় ধর্মের ভিত্তিতে দেশ ভাগের; জন্ম নেয় ভারত ও পাকিস্তান নামে ধর্মভিত্তিক দু’টি রাষ্ট্র।

রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা ভাবনা

এখানে রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা ভাবনা বিশেষ পর্যালোচনার দাবি রাখে। রবীন্দ্রনাথ ১৯০১ থেকে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত ৩৯ বছরে শিক্ষা নিয়ে ১২৬টি প্রবন্ধ লেখেন। শিক্ষা নিয়ে তিনি দেশেবিদেশে অনেক বক্তৃতা দিয়েছেন। কোথাও তিনি সাম্প্রদায়িক বক্তব্য ও একটা বিশেষ ধর্ম শিক্ষার কথা বলেননি। রবীন্দ্রনাথ চাইতেন স্কুল পর্যায় থেকেই সকল ধর্ম পড়ানো হোক এবং পাঠ্যপুস্তককে তিনি ‘অপাঠ্য পুস্তক’ বলেই আখ্যা দিয়েছেন। ধর্মীয় শিক্ষার ব্যাপারে তিনি ছিলেন উদার। তিনি নিজেই ছিলেন একেশ্বরবাদী। সুতরাং তার পক্ষে তৎকালীন পাঠ্য পুস্তকে হিন্দু ধর্মের প্রাধান্য নিয়ে কোনো লেখা, বক্তৃতা ও বিবৃতি পাওয়া যায় না।

রবীন্দ্রনাথ হিন্দু ও মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র পাঠ্যপুস্তক রচনার উদ্যোগের বিরোধিতা করে লেখেন— ‘বাংলাদেশে হিন্দু-মুসলমান যখন ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী, পরস্পরের সুখ-দুঃখ নানা সূত্রে বিজড়িত, একের গৃহে অগ্নি লাগিলে অন্যকে যখন জল আনিতে ছুটাছুটি করিতে হয়, তখন শিশুকাল হইতে সকল বিষয়েই পরস্পরের সম্পূর্ণ পরিচয় থাকা চাই। বাঙালি হিন্দুর ছেলে যদি তাহার প্রতিবেশী মুসলমানের শাস্ত্র ও ইতিহাস এবং মুসলমানের ছেলে তাহার প্রতিবেশী হিন্দু শাস্ত্র ও ইতিহাস অবিকৃতভাবে না জানে তবে সেই অসম্পূর্ণ শিক্ষার দ্বারা তাহারা কেহই আপন জীবনের কর্তব্য ভালো করিয়া পালন করিতে পারিবে না।’ [তথ্যসূত্র: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ২০১২ (পুনর্মুদ্রণ)। রবীন্দ্রসমগ্র, খণ্ড ১৭ (পাঠক সমাবেশ), পৃ. ৩৫০]

আজকাল মুসলিম স্কলাররা তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব নিয়ে পড়াশোনা করছেন এবং বিস্তর গবেষণা করছেন। এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও বর্তমানে ওয়ার্ল্ড রিলিজিয়ন ডিপার্টমেন্টেও বিভিন্ন ধর্ম সম্পর্কে পড়ানো হয় যা রবীন্দ্রনাথ প্রায় ১০০ বছর আগে বলে গিয়েছেন। এ থেকে বোঝা যায়, রবীন্দ্রনাথ অসাম্প্রদায়িক ও অগ্রসর চিন্তার মানুষ ছিলেন।

পাঠ্যপুস্তক সম্পর্কেও রবীন্দ্রনাথ তার সমকালীন শিক্ষাবিদদের থেকে প্রাগ্রসর ও অসাম্প্রদায়িক ছিলেন। ১২৯১ বঙ্গাব্দে তিনি ‘শিক্ষার হেরফের’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ লেখেন। এই প্রবন্ধে পাঠ্যপুস্তক প্রসঙ্গে তিনি বলেন— ‘পৃথিবীর পুস্তকসাধারণকে পাঠ্যপুস্তক এবং অপাঠ্যপুস্তক, প্রধানত এই দুই ভাগে বিভক্ত করা যাইতে পারে। টেক্সট বুক কমিটি হইতে যে-সকল গ্রন্থ নির্বাচিত হয় তাহাকে শেষোক্ত শ্রেণীতে গণ্য করিলে অন্যায় বিচার করা হয় না।’ [তথ্যসূত্র: প্রাগুক্ত, রবীন্দ্রসমগ্র, খণ্ড ৬, পৃ. ৫৬৫]

তার মানে রবীন্দ্রনাথ তৎকালীন পাঠ্যপুস্তককে অপাঠ্য পুস্তক হিসেবে চিহ্নিত করে গেছেন। মুসলমানদের পাঠ্যপুস্তক বিষয়ে যে ক্ষোভ ছিল তার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের কোনো যোগসাজশ নেই। এ উদ্ধৃতি থেকেও প্রমাণিত হয় তিনি তার সময়ের চেয়ে কয়েক ধাপ এগিয়ে ছিলেন। কালের পরিক্রমায় সময় অনেক গড়িয়েছে সত্য, কিন্তু বাংলাদেশে পাঠ্যপুস্তকের মান আজও সন্তোষজনক পর্যায়ে নেই।

পূর্ববাংলায় সরকারি চাকরি ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান

মুসলমানদের নেতৃত্ব সংকট ছিল এবং মুসলমানদের পিছিয়ে পড়ার অন্যতম কারণ ছিল হিন্দুদের তুলনায় শিক্ষার হার কম থাকা ও ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণে অনীহা। প্রথম শ্রেণির সরকারি চাকরিতে হিন্দুরাই ইংরেজি শিক্ষার কারণে দখল করে রাখতো; পক্ষান্তরে মুসলমানদের জন্য তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির চাকরির বাইরে দখল ছিল খুবই ব্যতিক্রম। অবিভক্ত বাংলায় ৪৫টি ডিগ্রি কলেজ ও উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল, তার মধ্যে অধিকাংশই (৩০টি) ছিল পশ্চিমবঙ্গে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ববাংলায় ছিল মাত্র ১৩টি।

পূর্ববাংলা সবক্ষেত্রে যেমন বৈষম্যের শিকার হয়েছিল তেমনি শিক্ষা ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ছিল না। পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশ গঠনের আগে অবিভক্ত বাংলায় ১৯টি কলেজ ছিল, তার মধ্যে ১০টি ছিল পশ্চিমবঙ্গে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ববাংলায় ছিল ৯টি। ঢাকা কলেজ (১৮৪১), চট্টগ্রাম কলেজ (১৮৬৯), রাজশাহী কলেজ (১৮৭৩), জগন্নাথ কলেজ (১৮৮৪), ভিক্টোরিয়া কলেজ; নড়াইল (১৮৮৬), বরিশাল ব্রজমোহন কলেজ (১৮৮৯), হিন্দু একাডেমি; দৌলতপুর (১৮৯৬), এডওয়ার্ড কলেজ; পাবনা (১৮৯৮) এবং ভিক্টোরিয়া কলেজ; কুমিল্লা (১৮৯৯)। সিলেট তখন ছিল আসাম প্রদেশের অন্তর্গত। সেখানে ছিল দু’টি কলেজ— সিলেটে মুরারি চাঁদ কলেজ এবং গৌহাটিতে কটন কলেজ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পূর্বে ঢাকা শহরে মাত্র দু’টি উচ্চশিক্ষা কেন্দ্র ছিল। সরকারি ঢাকা কলেজ আর বেসরকারি জগন্নাথ কলেজ। সরকারি ঢাকা কলেজে সাধারণত উচ্চবিত্ত পরিবারের আর বেসরকারি জগন্নাথ কলেজে নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তানেরা পড়াশোনা করত। দু’টি কলেজেই আইএ, বিএ ও এমএ পড়ানো হতো কিন্তু বিশের দশকের শুরুতে যখন ঢাকার জনসংখ্যা প্রায় সোয়া লাখ তখন ওই দু’টি কলেজের ছাত্রসংখ্যা ছিল হাজার দুয়েকের মতো। এমতাবস্থায় অনগ্রসর পূর্ববাংলার নিম্নবিত্ত শ্রেণির মুসলমান ও তফসিলি সম্প্রদায়ের সন্তানেরা উচ্চশিক্ষা ও সরকারি চাকরির সুযোগ পেতে ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা অনিবার্য হয়ে পড়ে। কেননা নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তানদের কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে পড়াশোনা করার সক্ষমতা ছিল না।

স্যাডলার কমিশনের ভূমিকা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা আলোচনা করতে গেলে অবশ্যই স্যাডলার কমিশন এবং এর রিপোর্ট সম্পর্কে জানতে হবে। প্রথম মহাযুদ্ধ প্রায় শেষ হয়ে আসলে ১৯১৭ সালে ভারত সরকার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর মাইকেল স্যাডলারের নেতৃত্বে এক উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিশন গঠন করে। ওই কমিশনে ফিলিপ হার্টগ (তখনকার বাংলা সরকারের শিক্ষা মহাপরিচালক ও পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য) এবং বাংলার বাঘ নামে খ্যাত স্যার আশুতোষ মুখার্জি (পরবর্তীতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন) ১৭ মাস পরিশ্রম করে এবং ভারতের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় পর্যবেক্ষণ করে কমিশনের সদস্যরা ১৩ খণ্ডে বাংলার উচ্চশিক্ষার কিভাবে উন্নয়ন করা যায় সে সম্পর্কে বিরাট প্রতিবেদন জমা দেন। স্যাডলার কমিশন গভীর পর্যবেক্ষণের পর মূল যে কথাটি বলে তা হলো—কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় আকারে অতি বড় হয়ে গেছে এবং ছাত্রসংখ্যা ও কলেজের সংখ্যা অতি মাত্রায় বেড়ে যাওয়ায় বাংলায় উচ্চশিক্ষার প্রসার ব্যাহত হচ্ছে। তার থেকে বেরিয়ে আসতে যে সুপারিশ করা হয়েছিল তার মধ্যে প্রথমটি ছিল ঢাকায় একটি শিক্ষাঙ্গন ও আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, ‘Creation of a teaching and residential university in Dacca’ অন্য দু’টি প্রধান সুপারিশ ছিল— ‘Pooling of teaching resources in Calcutta in order to create a real teaching university’,… ‘development of mofussil colleges’ -অর্থাৎ উচ্চশিক্ষার পদক্ষেপ হিসেবে মফস্বলের কলেজগুলোর উন্নয়ন। [তথ্যসূত্র: সৈয়দ আবুল মকসুদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা, প্রথমা প্রকাশন, পৃ. ৪৭-৪৮]

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধিতার কারণ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধিতার অন্যতম প্রধান কারণ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন হাইস্কুলগুলোর দুই তৃতীয়াংশ ছিল পূর্ববঙ্গে। পূর্ববাংলার এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোই মেট্রিকুলেশন পরীক্ষার ফি থেকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচের সিংহভাগ যোগাত। তাই তারা মনে করেছিলেন পূর্ববঙ্গে আলাদা বিশ্ববিদ্যালয় গড়া হলে, ‘কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে দিব্যি ভাতে মারা যাবে। হিন্দুদের বিরোধিতা সে কারণেই।’ [দীনেশচন্দ্র সিংহ, দেশ, ১৭ জানুয়ারি ২০০৬]

সৈয়দ আবুল মকসুদ তার প্রাগুক্ত গ্রন্থে এর ব্যাখ্যায় বলেন, ‘এ লেখাটি যিনি লিখেছেন, দেশ পত্রিকা থেকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তিনি ১৯৪৬-৪৭ সালে নোয়াখালী জেলা হিন্দু মহাসভার একজন নেতা ছিলেন। তবে তিনি তার গোটা সম্প্রদায়ের অনুভূতিই প্রকাশ করেছেন। কারণ শত বছর পরও এর বাইরে বাংলা ভাগ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাসংক্রান্ত নতুন কোনো থিসিস, তত্ত্ব বা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দেখা যায় না। এত দিন পর দুই সম্প্রসারণ অতীতের ভুলভ্রান্তি নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টিতে দেখাই সংগত। অতীতের ভুলের দায় বর্তমান কালের মানুষের ওপর—কোনো হিন্দু বা কোনো মুসলমানের ওপর—বর্তায় না।’ [পৃ. ৩৯-৪০]

দীনেশচন্দ্র সিংহের এ জাতীয় ব্যাখ্যায়— যা চলে আসছে শতাধিক বছর যাবত—যা প্রকাশ পেয়েছে তা একটি সম্প্রদায়ের মানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গি। গত শতাব্দীর শুরুতে হিন্দু ও মুসলমান মধ্যশ্রেণির যে সাম্প্রদায়িক মনোভাব ছিল, নানারকম রাজনৈতিক উত্থানপতনের পরও তা থেকে বাঙালি আজও মুক্ত হতে পারেনি।

আশুতোষ মুখার্জির বিরোধিতা ও স্বদেশি আন্দোলন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত যখন লর্ড হার্ডিঞ্জ চূড়ান্ত করেন তখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আশুতোষ মুখার্জি চারটি পূর্ণ অধ্যাপক পদের বিনিময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা থেকে সরে আসেন। এই চারটি অধ্যাপক পদ বরাদ্দ প্রসঙ্গে সৈয়দ আবুল মকসুদ তার প্রাগুক্ত বইয়ে খুব চমৎকারভাবে তখনকার পরিস্থিতি তুলে ধরেন।

‘বরাদ্দটি যাতে নিশ্চিতভাবে পাওয়া যায় তার জন্য গুরুদাস, আশুতোষরা কিছুটা চাতুর্যের আশ্রয় নেন। চারটি পদের জন্য শুধু বরাদ্দ নয়, তারা প্রফেসর পদগুলোর নামও প্রস্তাব করেন। চারটি পদের নামকরণ করেন তারা কারমাইকেল প্রফেসর, মিন্টো প্রফেসর, পঞ্চম জর্জ প্রফেসর ও হার্ডিঞ্জ প্রফেসর। মানসম্মত শিক্ষা সংস্কারের জন্য যার অবদান সবচেয়ে বেশি, সেই গভর্নর জেনারেল কার্জনের নামে কোনো পদ নয়। আরও তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার, কোনো ভারতীয় মনীষীর নামেও কোনো পদ নয়। বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনের ডাকনাম স্বদেশি আন্দোলন, বিদেশি প্রভুদের নামে সব প্রফেসরের নামকরণ করাটা স্বদেশি চেতনার সম্পূর্ণ বিপরীত। প্রভুভক্তি আর স্বদেশি চেতনা একসঙ্গে যায় না। এই দৃষ্টান্তটি থেকে প্রমাণিত হয়, বাংলায় কেউ কেউ স্বদেশের মুক্তির জন্য আত্মত্যাগ করছিলেন আর কেউ কেউ ঔপনিবেশিক সরকারের পদলেহন করছিলেন।’

ইতিহাস তো শত বছর পরেও সঠিক পথ পরিক্রমায় চলে। উপরোক্ত আলোচনা থেকে এ কথা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় তৎকালীন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক বিরোধিতা আমাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ববাংলায় কিরূপ নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করেছিল।

লেখক: প্রাবন্ধিক, সহ-প্রতিষ্ঠাতা, ই-স্কুল অব লাইফ

সারাবাংলা/এসবিডিই

মোহাম্মদ আবু সালেহ রবীন্দ্রনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা

বিজ্ঞাপন

সিইসি ও ৪ কমিশনারের শপথ আজ
২৪ নভেম্বর ২০২৪ ০১:৩৩

আরো

সম্পর্কিত খবর