বাঙালির বরষার গান
১৯ আগস্ট ২০২২ ১১:৩০
বরষার বাঁধভাঙা জোয়ারে প্লাবিত হয় প্রকৃতি আর মানব মনে জাগে প্রণয় বিরহ ও স্মৃতিকাতরতার অঝোর ধারা। এমন দিনে তারে বলা যায় এমন ঘনঘোর বরষায়। বৃষ্টির শব্দের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কথারা ঝাঁপিয়ে পড়তে চায় যেন। মনে হয়, কত যে ছিল, কত যে ছিল গান-সব কথা বলিবার, সব গান শোনাবার আকুলতায় প্রাণ আকুপাকু করে, বুঝি বর্ষা রাতের শেষেও। বহুযুগের ওপার হতে কার হাত ধরে অঙ্গে অঙ্গে জলতরঙ্গে শুধুই খেলা চলে। যেন বরষাকে বলে হৃদয়, আজি তোমার সঙ্গে প্রাণের খেলা। বর্ষার ভেতর কল্পনারাও কখনো কখনো খেলাঘর বাঁধতে লেগে যায়। বরষায় দেখি তাই, ‘আজ সেই ঘরে এলায়ে পড়েছে ছবি, এমন ছিল না আষাঢ় শেষের বেলা, উদ্যানে ছিল বর্ষা-পীড়িত ফুল’। বর্ষার নিজস্ব ফুল তো কদম-কেয়া-কেতকী। কেয়াপাতার নৌকা করে ভাসিয়ে দিয়ে বর্ষার জলে কবি হয়তো তাকিয়ে থাকেন তার চলাচলে ঢেউয়ের দোলাচলে। গগনে গরজে মেঘ ঘনবরষা-সেই তো চায় হৃদয়কূলে একা বসে যতই না যাক, ভরসা তবু বরষার বর্ষণকে পায়ে ঠেলে দূরে সাজানো কী যায়?
বর্ষার বুকের ভেতর একটা চাপা বিষণ্নতা থাকে, তাই ঝরঝর মুখর বাদল দিনে কেন যে মন লাগে না। বহুযুগের ওপার হতে কোন সে কবি কালিদাসের ছন্দে বেজে উঠেছিল এ অনুভব যে, আকাশে মেঘোদয় হলে সুখী লোকেরও অন্তরে এমনকি অন্যথাবৃত্তি জেগে ওঠে। আর বিরহীজনের তো কথাই নেই। বর্ষা-কোদালে মেঘে বিদ্যুৎ রেখা মেলে যখন, বিরহী চোখ ভরা জল যেন বরষার জলে মিশে দুঃখকে ছড়িয়ে দিতে চায়। ষড়ঋতুর এই বাংলাদেশে বর্ষাই সবচেয়ে হৃদয়প্লাবী। কাব্যে গানে অনুচিত্রে খুব বড় জায়গা নিয়ে আছে বর্ষা তার বিশাল জলধারার মতো। নিবিড় প্রকৃতিময়তার বিস্তারে আকাশের ওপারের আকাশ থেকে রাজকীয়ভাবে নেমে আসে বর্ষার রূপসুধার আয়োজন। এ বর্ষাকে গানে ধরা সে কি সহজ গান? বর্ষণমন্দ্রিত অন্ধকারে বরষার জলভরা গাঢ় দেহ কেবলি উথালপাথাল করে। দেহজসুখের বরষা কখন যে টুং টাং টুং টাং চুড়ির তালে থই থই বন্যা নাচেরে। বন্যা তো নাচবেই, নৃত্যপরায়ণা যে কোমল নয়, প্রচণ্ডতা নিয়ে আসে। দুর্দমনীয় শক্তিতে দুমড়ে মুচড়ে ফেলে দেহলতাও। বাদলের মাদল যতো গুরুগুরু বাজে ততই হৃদয় অঙ্গনন্দনে জাগে আরও কাছাকাছি, পাশাপাশি, মুখোমুখি বসিবার।
বাঙালির জীবনে বর্ষা মানেই পাগলা হাওয়ার বাদলদিনে মন পাগল হয়ে যাওয়া। এ কীসের পাগলামি। কেমন তরো তার রূপ। জানে সে জন, হৃদয়ের একূল ওকূল দু’কূল ভেসে যায় যার। বাঙালিকে পাওয়া যায় বর্ষার গানে। আর বর্ষার গান মানেই রবীন্দ্রনাথ, ভেসে আসেন প্রথমেই তিমির অবগুণ্ঠনে বদন ঢাকি। যে যতই বর্ষার গান নানা ছাদে বাঁধুক না কেন, রবীন্দ্রনাথের গানেই সব চেয়ে প্রবল আকারে আষাঢ় আসে গহণ সঘন ব্যঞ্জনায়, ‘বর্ষা এলায়েছে তার মেঘময় বেণী।’ সুরের ছকে বা বাণী রচনার বিশিষ্টতায় নয়। কী শব্দচয়নে, বিন্যাস এবং মেঘমন্দ্র ধ্বনি সন্নিবেশে সে এক অবগহন। তাতে সন্তরণও চলে বরষার জলে। এক একটি গান যখন ধ্বনিত হয়ে, হৃদয় তাতে সাড়া দেয়, শুনতে শুনতে যেন শোনা যায় অশনি গর্জন। অন্তর্চক্ষু দেখে বাদল বাউল নেচে নেচে একতারা বাজাচ্ছে। গানই বলে দেয় শ্রাবণের বুকের ভেতর অগ্নিতাপের অস্তিত্ব। সেই দিকপ্লাবী গহনঘন ধারাপাতে মত্ত হাওয়ায় শাল পিয়াল তমাল মাথা নাড়ে। আর সব ক্ষুব্ধতার অবসানে, শেষ হলে সাগর বিভাবরী, বর্ষার শুশ্রূষায় ভোরে চোখে পড়ে শান্তস্নিগ্ধ হেনার মঞ্জরি।
বাংলায় বর্ষার গান অনেক। সেই উনিশ শতক থেকে ধরা হলে, রবীন্দ্রনাথ এবং সমকাল পেরিয়ে বর্ষা আসে গানে গানে সুরে সুরে, নানা আবরণে আভরণে। রবীন্দ্রনাথকে সরিয়ে পর্দা ওঠালেই অতুল প্রসাদের বর্ষায় দেখি অন্যতর স্বর। ঢাকা শহরে জন্ম নেওয়া কবি গায়ক অতুলপ্রসাদ সেন (১৯০২-১৯৩৪) তার লক্ষ্ণৌ প্রবাসকালে যে বর্ষার রিমঝিম, কলকল ধ্বনি শুনেছেন, তা বাংলার নয়। উত্তর ভারতীয় লচাঠুমরির উচ্চ সুরঠাসে শ্রাবণ ঝুলাতে বাদল রাতের প্রেম গীতিছন্দ। বাংলার বর্ষার গানে যেটুকু তার বৈচিত্র্যপূর্ণ সংযোজন বাঙালি শ্রোতার মনে ও মননে সেই সুরকারের গুঞ্জন একেবারে নতুন ঠেকেছিল বলে সংগীতজ্ঞ ওয়াহিদুল হকের মতো। কিন্তু গানের অন্তর্গত বাদলে নিজস্ব ভাষা লচাঠুমরির অনুষঙ্গে বেঁকে গেছে রাধাকৃষ্ণের প্রেমের সুদূরতায়। গহণ হিল্লোলে কালো মেঘের ছবিটুকু এঁকে ঝুমঝুম নূপুর ধ্বনির অঙ্গনে অতুলপ্রসাদ তার অপটু অনভিজ্ঞ কল্পনায় উচ্চারণ করেন, ‘শ্যাম পত্র কোলে/ কুসুম দোলে/ রাধ সনে যেন শ্যামরায়।’ কোথায় বর্ষা আর কোথায় শ্যামরায়! এতে একই সঙ্গে ধ্বস্ত হয়ে গেছে বর্ষা আর ভক্তিরস, কোনোটাই যে ফুটল না। ঠুমরির চাল আর পিলু রাগিণীর সামাল দিতে পারল কোথায় আর? এমন দিনে ঘনঘোর বর্ষায় যে অকথিত সংলাপ বেজে ওঠে মর্মে, বলতে প্রাণ ব্যথিয়ে ওঠে, অতুলপ্রসাদ তার ধারে কাছেও যে যান না। সেটি হয়েছে, বাংলাদেশ ছেড়ে দূরত্ব দূরে থাকায় তার বর্ষার গান হৃদয় নদীতে ঢেউ তোলে না। বাদলের গান গাওয়া সেকি সহজ? তার সমগ্রতার গায় উন্মোচন যে দূরায়ত্ত। গানের বরষার সঙ্গে নয়ন বর্ষণ লেখা যতই সহজ, তাতে আর যাই হোক শ্রোতার চোখে অশ্রুজলের সুদূর নদী তৈরি হবে না।
যদি কান পাতা যায় অতুলপ্রসাদে, ‘বঁধুয়া নিদ নাহি আঁখিপাতে/ আমিও একাকী তুমিও একাকী/ আজি এ বাদল রাতে।’ বরষার রাতে মনে বোধহয় জেগে ওঠে পরিপূর্ণতার বোধ। সুরে আর্তি, বাণীর গভীর একমুখিতা তন্ময় কবে দিতে পারে। জীবনের অনাকাক্সিক্ষত বিরহ, স্ত্রী ঢাকার মেয়ে হেমকুসুমের সঙ্গে তীব্র মনান্তর, অথচ দু’জনেই থাকতেন একই লক্ষ্ণৌ শহরে আলাদা আলাদা বাড়িতে। এ সবই বুঝি পুঞ্জিত হয়েছে এ গানের পরতে পরতে। এ যেন এক অশ্রুময় আত্মকথন, রচনা মুহূর্তেই শাশ্বতের স্থায়ী মোহর চাপা পড়েছে এ গানে। রিমঝিম শব্দকল্পের টানে এসে যায় নজরুল সংগীত। ‘রিমঝিম রিমঝিম ঝিম ঘন দেয়া বরষে।’ বর্ষার গানে যেমন মেঘ, বর্ষণ, মত্তময়ূরী; বাহিরে ঝড় বহে, তেমনই এই দেয়ার ডাক। রবীন্দ্রনাথের কুশলী লেখন এই গগনে গগনে ডাকে দেয়ার সঙ্গে এনে ফেলে কেয়াফুলের অন্তর্গুপ্ত সুবাস-তাতে ঘনদেয়ার ডাক বেশ øিগ্ধ শ্রুতিমধুরই। শাওন রাতে স্মরণে আসে, কারণ বর্ষার ভরসায় সেই সব দৃশ্যপট ভাসে হৃদয় উথালপাথাল করে। বাংলা গানে রিমঝিম মানেই বরষা। ‘রিমঝিম ঘন ঘন রে বরষে,’ একেবারে বাঙালির প্রাণের টানে মেশে। এ রিমঝিম বা রিমিঝিমি বাংলা গানে বর্ষার জলতরঙ্গ বাজায়। কেবল রিমঝিম শুনেই কানে ভাসে ‘নয়নে বরষে রিমঝিম রিমঝিম’। আধুনিক বাংলা গানে বাদলের মাদল বাজিয়ে রিমঝিম আসে, ‘এল বরষা যে সহসা মনে তাই/ রিমঝিমঝিম রিমঝিমঝিম গান গেয়ে যাই’ হয়ে ওঠে বর্ষা মানেই রিমঝিম।’ কিংবা ‘রুমঝুমঝুম মেঘলা মনটারে কোন ভরসায়/ একলা কাটায়/ থই থই থই বরষা নাচে ওই রুমঝুমঝুম।’ রিমঝিম বৃষ্টিধারার বর্ষণ ষাট-সত্তর দশকের এপার-ওপারের বাংলা গানে বেশ ভালোই ঝাঁকিয়ে বসেছিল, ‘রিম ঝিমঝিম বৃষ্টি/ আমার সারাদিন/ কী ভাবে কেটে যায়/ শুধু তুমি তুমি তুমি করে।’
রবীন্দ্রনাথের বরষায় রিমঝিমঝিম কোথায়। তীব্র সুগভীর কানফাটা বজ ধ্বনি তার হাতে অন্য আমেজ আনে-‘বজে তোমার বাজে বাঁশি’ কিংবা ‘বজ মানিক দিয়ে গাঁথা আসার তোমার মালা’। তীব্র দহনশক্তি কবিত্বের মাধুর্যে শোভাময় রূপশ্রী জড়িয়ে নেয়। নেমে আসে যেন স্নেহের মতো, আবার যুক্তাক্ষর বিন্যস্ত স্বরবিন্যাস সত্ত্বেও ‘আঁধার অম্বরে প্রচণ্ড ডমরু বাজিল গম্ভীর গর্জনে’, গানটি কোনো প্রচণ্ডতা বহন করে না। বরং নদীর কল্লোল, বনের মর্মর, বাদল উচ্ছল নির্ঝর ঝরঝর আলোকরেখাকে করে তোলে শ্যামল সুন্দর। এই ঝড়ঝঞ্ঝার রুদ্রমুখের পেছনেই আছে অভিসারের আয়োজন। কে সেই তিমির অবগুণ্ঠনে, সুদূর কোনো নদীর পারে গহন কোনো বনের পার দিয়ে চকিতে দেখা দিয়ে অন্তর্হিত হয়ে যায়। তারপর যে রাতে দুয়ারগুলো ভাঙে, যখন আর সব কুটিরে বন্ধ দরোজা আত আতঙ্কিত হাতে ধরা বাতি যখন নিভে যায় আকস্মিক ঝঞ্ঝারবাত্যায়, সেই পবিত্র ব্যক্তিগত অন্ধকারে দু’জনে দেখা হয় প্রার্থী ও প্রার্থিনীর। গানের অনুষঙ্গে এই যে অভিসার তার আদিকথা বাংলার বৈষ্ণব পদাবলিতেই আছে। পদাবলি মানে কীর্তন গান বা কীর্তি গান। যার সূচনা শ্রীচৈতন্যের আগে ও পরে। কিন্তু তারও আগে সেই সুদূর দ্বাদশ শতকে, কবি জয়দেব তার ‘শ্রী গীত গোবিন্দম,-এর প্রথম শ্লোকে লিখেছিলেন, মেঘমেদুর আকাশের তলায় শ্যামতমাল বনভূমির পটে কৃষ্ণরাধা প্রণয়ের নীটগীতি। ঘনায়মান নীল অঞ্জনঘন পুঞ্জছায়ায় যখন ধরণি আত্মলীন, নিসর্গেও লেগেছে ‘এসেছে এসেছে’ এই তান, তখনই তো রাধাকৃষ্ণের নিভৃত প্রণয়ের অবকাশ। এমন বর্ষণঘন অনালোকে গোপনে রাধা ঢলেছে অভিসার মুখটি ফিরায়ে কুঞ্জের দিকে। বাঙালির প্রথাগত বর্ষার গানে প্রণয়, বিরহ আর স্মৃতিকাতরতা প্রধান হয়ে উঠেছে। তাই ‘বঁধু এমন বাদল দিনে তুমি কোথা/ পড়িছে মনে তোমার কত কথা-ই যেন বর্ষার গানের ধ্রুবপদ, সে অতুলপ্রসাদই লিখুন আর পঞ্চাশ দশকের গীতিকার কুমিল্লার অজয় ভট্যাচার্যই লিখুন। পঞ্চাশ ও ষাট দশকের আধুনিক বাংলা গানের স্বর্ণযুগে, বর্ষার গান আছে, কিন্তু বর্ষার মহিমা নাই। সেসব অনেক গান এই একুশ শতকেও রিমেক হয়। কমল দাশগুপ্তের সুরে প্রণব রায়ের লেখা ‘এমনই বরষা ছিল সেদিন/ শিয়রে প্রদীপ ছিল মলিন/ তব হাতে ছিল অলসবীণ/ মনে কি পড়ে প্রিয়?।’ এমন শিথিল চিত্র, গদগদ কোমল প্রেমের এলানো বাণীতে বর্ষা আসে না, কিন্তু গান ‘সুপার ডুটার হিট’ হয়ে গ্রামফোন কোম্পানির আয়ে বরষার জলের মতো টাকা এনেছে। ‘এই মেঘলা দিনে একলা ঘরে থাকে না তো মন’ যেন সুর পায় শব্দের মেলা নিপুণ কণ্ঠবাদন, বরষা ঢেউ আনে। ঢাকায় ‘এক বৃষ্টিতে ভিজে দুটি মন এক হলে’ও মহিমায় ভাসা বর্ষার গান তেমন হয়নি। ‘বরষার বারি ঝরে’ মার্কা গান তৈরি হয়েছে অনেক।
রবীন্দ্রনাথের সমকালের কবি গায়ক সুরকার গীতিকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায়। বিশ শতকের গোড়ায় লিখলেন ‘বরষা আইল ওই ঘনঘোর মেঘে/ দশদিশ তিমির আঁধরি।/’ সে সময়ের কল্পনা ও গভীরতার দৈন্য; প্রথাগত বর্ণনার পরিসর বড় শীর্ণ লাগে। পাশাপাশি তারই আর এক গান, ‘ঘন ঘোর মেঘ আই ঘোরি গগন। বহে শীকর স্নিগ্ধচ্ছ্বসিত পবন।’ সমাসবদ্ধ তৎসম শব্দের এমন কড়া চাপে বরষার প্রাণ আইঢাই করতে থাকে যেন। ‘আই’ শব্দটি সংকেত দেয় কোনো হিন্দুস্থানি গানের পূর্বস্মৃতি। অবশ্য এটি একটি টপ্পা খেয়ালের বন্দিশে রচিত। তাই বাণীর নয়, এখানে সুরই মুখ্য। অতুলপ্রসাদ লক্ষ্ণৌর অচ্ছুন বাঈয়ের ঠুমরির চলে বর্ষার সুর তোলা বাংলা গান বাঁধেন। ‘ঝরিছে ঝরঝর গরজে গর গর/ স্বনিছে সর সর শ্রাবণ মাঃ/ তাটিনী তর তর সরসী ভর ভর/ ধরণী থর থর সিকত গা।’
বর্ষার গানে কৃষক মেলে অতুল প্রসাদেই। ‘কৃষক হলে হলে/ বলাকা জলে জলে/ নচিছে টলে টলে শিখীর পা।’ এই একবারই কৃষকের আবির্ভাব মেলে। বাংলার বর্ষার গানে কৃষকের ঠাঁই কোথায়? যদিও বরষার ভাষায় গ্রাম বাংলাই। বৃষ্টির জন্য তাদের প্রার্থনা সংগীত কম নয়। জ্যৈষ্ঠের কাঠফাটা রোদে বৃষ্টিহীন কৃষক গায় ‘আল্লা ম্যাঘ দে পানি দে ছায়া দে।’ কৃষক দেখে ‘আসমান হইল টুটাফাটা/ জমিন হইল ফালা-/’ তবু বাংলার নারীর কণ্ঠে বাজে ‘আয় বৃষ্টি ঝেঁপে, ধান দেব মেপে/ আয় রিমঝিম বরষার গগনে/ কাঠফাটা রোদের আগুনে।/ এতো আকুল আহ্বানে বর্ষা আসে। দু’কূকুল প্লাবিত হয়। ‘কখন বাদল ছোঁয়া লেগে/ মাঠে মাঠে ঢাকে মাটি/ সবুজ মেঘে মেঘে। ওই ঘাসের ঘন ঘোরে/ ধরণিতল হল শীতল/ চিকন আভায় ভরে/’ ওরা হঠাৎ গাওয়া গানের মতো এলো প্রাণের বেগে।
জলসিঞ্চিত ক্ষিতি সৌরভে আকীর্ণ এই বাংলাদেশের চিরন্তন বর্ষা বাঙালির প্রাণের, যেন প্রথম দিনের চেনা। পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে পাগল মনের জাগরণ, আবার তিমির নিবিড় রাতে যখন বৃষ্টি নামে, তখন আমাদের স্বপ্ন স্বরূপের উন্মোচন। প্রথমে তাই বৃষ্টির আকাক্সক্ষা তার পরে ঝরঝর মুখর বর্ষণ। তৃষ্ণার শান্তি। নজরুলের গানে মেলে বর্ষণক্ষান্ত উপচিত মনের লাবণ্য-‘থই থই জলে ডুবে গেছে পথ/ এসো এসো পথ ভোলা/ সবাই দুয়ার বন্ধ রেখেছে/ আমার দুয়ার খোলা।’
সব ছাড়িয়ে ছাপিয়ে বাংলায় বর্ষা আনে রবীন্দ্রনাথের হাত ধরেই। সঘন গহণ শ্রাবণ রাত্রিতে ওই আসে ওই অতি হরষে। বরষা ফুরিয়ে যায় আবার আসে। আর রবীন্দ্রনাথ ঘনঘোর বরষায় কত কী বলিবার বলে যান মন্দ্রিত স্বর তারে।
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি