বেড়েছে শিশুদের শীতজনিত রোগ, কী বলছেন চিকিৎসকরা?
২৪ ডিসেম্বর ২০১৯ ০৯:১৫
গত কয়েকদিনের মৃদু শৈত্যপ্রবাহে দেশজুড়ে প্রচণ্ড শীতের সঙ্গে বেড়েছে শীতজনিত রোগের প্রকোপ। মূলত শিশুরাই আক্রান্ত হচ্ছে এসব রোগে। ঠান্ডা, জ্বর-কাশির পাশাপাশি বেড়েছে নিউমোনিয়া এবং অ্যাজমায় আক্রান্ত হওয়ার হার। দেখা দিচ্ছে ভাইরসাজনিত শ্বাসতন্ত্রের রোগ ব্রংকিওলাইটিস।
রাজধানীর শিশু হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেছে, ঢাকা শিশু হাসপাতালের চাইল্ড ওয়ার্ডে ১৬ মাসের ছোট্ট শিশুটিকে কিছুতেই নেবুলাইজার দেওয়া যাচ্ছিল না। পাশেই দাঁড়ানো কিশোরী মেয়েটির মুখে একবার, মায়ের নিজের মুখে একবার করে ধরার পরও সে যন্ত্রটি মুখে নিতে একদমই রাজি নয়। হাত দিয়ে ঠেলে সরিয়ে দিচ্ছে। এদিকে দিনে তিনবেলা নেবুলাইজার দিতে বলেছে চিকিৎসক। গতকাল রাতে ঠান্ডা লাগার পর থেকেই নিঃশ্বাসে কষ্ট, বন্ধ রয়েছে স্বাভাবিক খাওয়া-দাওয়া। এরপর হাসপাতালে নিয়ে আসার পর ভর্তি করে নিয়েছেন চিকিৎসকরা।
এছাড়া জন্ম থেকেই নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে শিশু হাসপাতালে ভর্তি আছে নবাবগঞ্জের বান্দুরার একটি ক্লিনিকে জন্ম নেওয়া শিশু। গত ১৬ ডিসেম্বর তার জন্ম হওয়ার পর শারীরিক অবস্থা খারাপ হতে থাকলে চিকিৎসকরা শিশু হাসপালে পাঠান। হাসপাতালের জরুরি বিভাগে সিলিন্ডারের সাহায্যে অক্সিজেন দেওয়া হচ্ছে শিশুটিকে। কোলে নিয়ে বসে থাকা ওর নানী জানালেন, অক্সিজেন দেওয়ার পর এখন কিছুটা সুস্থ আছে শিশুটি।
আগারগাঁও থেকে দশ মাসের শিশু সন্তানকে নিয়ে এসেছেন আরেকটি পরিবার। কয়েকদিন ধরে শিশুটির শ্বাস-প্রস্বাসে কষ্ট হচ্ছে, খেতেও পারছে না, বমি হচ্ছে। চিন্তিত বাবা-মা তাই ছুটে এসেছেন হাসপাতালে।
এভাবে শিশু হাসপাতালের জরুরি বিভাগ, অ্যাজমা সেন্টার ও ওয়ার্ডে বেশিরভাগ শিশুই এসেছে শীতজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে। কাউকে কাউকে দেখেই ব্যবস্থাপত্র দিয়ে ছেড়ে দিচ্ছেন, আবার কাউকে জরুরি অবস্থা বুঝে ভর্তি করে নিচ্ছেন চিকিৎসকরা।
শীতের প্রকোপ বাড়ার সঙ্গে বেড়েছে শিশু হাসপাতালে রোগী ভর্তির সংখ্যা। এখানকার আবাসিক চিকিৎসক সহকারী অধ্যাপক ডা. রিজওয়ানুল আহসান বিপুল বলেন, ‘গত পাঁচদিন ধরে চলা মৃদু শৈত্যপ্রবাহে শিশুরোগীর সংখ্যা বেড়েছে।’ তিনি বলেন’ ‘সাধারণত ঢাকা শিশু হাসপাতালের আউটডোরে প্রতিদিন দেড়শ থেকে দুইশ রোগী দেখা হলেও এখন প্রতিদিন আড়াইশ থেকে তিনশর কাছাকাছি রোগী আসছে। যাদের অধিকাংশই শীতজনিত রোগে আক্রান্ত।’ গুরুতর অবস্থা বিবেচনা করে এদের মধ্যে অনেককেই হাসপাতালে ভর্তি করতে হচ্ছে বলে জানান তিনি।
ডা. রিজওয়ানুল বলেন, ‘যেসব বাচ্চারা স্কুলে যায় তাদের মধ্যে অ্যাজমার প্রকোপ দেখা যাচ্ছে বেশি। এছাড়া দুই মাস থেকে দুই বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে শ্বাসতন্ত্রে ভাইরাসের প্রদাহজনিত রোগ ব্রংকিওলাইটিসে আক্রান্ত হতে দেখা যাচ্ছে বেশি।’
এইক্ষেত্রে চিকিসকরা বলছেন, অভিভাবকরা তাদের শিশু সন্তানদের ঠান্ডা বাতাস থেকে দূরে রাখবেন। সেইসঙ্গে ধূলাবালি থেকেও যতটা সম্ভব দূরে রাখতে হবে। ডা. রিজওয়ানুল বলেন, ‘শৈত্যপ্রবাহ চলাকালীন শিশুদের যতটা সম্ভব কম ঘর থেকে বের করবেন এবং নবজাতককে গরম কাপড়ে মুড়ে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে রাখতে হবে যেন কিছুতেই ঠান্ডার সংস্পর্শে না আসে। ঘরের মধ্যে ঠান্ডা বাতাস যেন না ঢোকে সেদিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে। প্রয়োজনে ঘরের মধ্যে রুম হিটার ব্যবহার করতে হবে।’ এছাড়া নবজাতক শিশুকে একদিন পরপর দুপুরবেলা কুসুম গরম পানি দিয়ে গোসল করানোর পরামর্শ দেন তিনি।
এছাড়া শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য প্রচুর পরিমাণে তরলজাতীয় খাবার, ফলমূল ও শাকসবজি খাওয়ানোর কথা বলেন তিনি।
তিনি বলেন, ছয় মাস থেকে পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত এবং আঠারো বছরের আগের সব শিশুর ক্ষেত্রেই অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে। যেসব বাচ্চারা স্কুলে যায় তারা স্বাভাবিকভাবেই ধূলার সংস্পর্শে বেশি আসে। আর শীতের এই সময়ে ঠান্ডা বাতাসের সঙ্গে সঙ্গে ধূলা-বালির কারণেও শিশুদের নানাধরনের শীতজনিত ও শ্বাসজনিত রোগে আক্রনাত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। এক্ষেত্রে সব বয়সী শিশুদের অবশ্যই মাস্ক পরানোর কথা বলেন তিনি।
কাশি হলে ছয় মাস বা এক বছরের পর থেকে যে কোনো বাচ্চাকেই তুলসি পাতার রস খাওয়ানো যেতে পারে। রস করার আগে পাতা পরিষ্কার পানি দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে। ছয় মাস হওয়ার আগে বাচ্চাদের মধু বা তুলসি পাতার রস দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না, মায়ের বুকের দুধের মাধ্যমেই প্রতিরোধ তৈরি হয়ে যায়।
শীতে বিভিন্ন বয়সী শিশুদের নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার হারও বাড়ে। সেক্ষেত্রে কোন লক্ষণগুলো দেখলে বোঝা যাবে তা নিউমোনিয়া। ডা. রিজওয়ানুল বলেন, প্রচন্ড জ্বরের সঙ্গে বমি, ঠান্ডা-কাশি, দ্রুত শ্বাস (প্রতি মিনিটে ষাট থেকে চল্লিশ), বুকের খাঁচা দেবে যাওয়া ইত্যাদি নিউমোনিয়ার লক্ষণ।
শিশুদের শীতজনিত রোগের বিপদচিহ্নগুলো কী। অর্থাৎ অভিভাবকরা কখন তাদের শিশুদের হাসপাতালে বা চিকিৎসকদের কাছে নিয়ে যাবেন। ডা. রিজওয়ানুল বলেন, ‘প্রচণ্ড জ্বর, বমি, ডায়রিরা, শ্বাসকষ্ট, বুকের খাঁচা দেবে যাওয়া, ক্রমাগত কাশি ইত্যাদি দেখা দিলে যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে হবে।’
এছাড়া শীত ও পরিবেশ দূষণের কারণে শিশুদের অ্যাজমায় আক্রান্ত হওয়ার হারও বেড়েছে অনেকটাই। ঢাকা শিশু হাসপাতালের অ্যাজমা সেন্টারে বেড়েছে রোগীর চাপ। ঢাকা শিশু হাসপাতালের রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগের রেজিস্ট্রার ডা. নাবিলা আকন্দ বলেন, ‘তাদের বিভাগে রোগীর চাপ বাড়ার পাশাপাশি দু’একজন রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা দিতে হচ্ছে।’
অভিভাবকরা কখন বুঝবেন যে তার শিশু সন্তান অ্যাজমায় আক্রান্ত। ডা. নাবিলা বলেন, ‘অ্যাজমা আক্রান্ত শিশুর দৈনন্দিন জীবনধারণে অস্বাভাবিকতা দেখা যায় অর্থাৎ তাদের খাওয়া, ঘুম, চলাফেরা ইত্যাদিতে অনিয়ম দেখা দেয়। অসুস্থ শিশুর শ্বাস-প্রশ্বাসে কষ্ট হয়, শুয়ে বা বসে কোনভাবেই তারা স্বাভাবিকভাবে শ্বাস নিতে পারে না। আমাদের হাতের তালু, নখ ইত্যাদির রঙ বদলে যায়। স্বাভাবিকভাবে গায়ের রঙ গোলাপি হওয়ার কথা কিন্তু অ্যাজমা আক্রান্ত শিশুর হাত-পায়ের তালু, নখ ইত্যাদির রঙ নীলচে বা ফ্যাঁকাসে হয়ে যায়। এসব লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে নিয়ে আসতে হবে।’
শীতকালে শিশুদের সাধারণ ঠান্ডা-কাশি বা জ্বর হলে অনেকসময় দেখা যায় বাবা-মায়েরা চিকিৎসকের কাছে যেতে চান না। ঘরোয়া চিকিৎসা এবং সচেতনতার মাধ্যমেই রোগ সেরে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করেন। এই প্রসঙ্গে ডা. নাবিলা বলেন, ‘ফ্লু হলে হালকা জ্বর, কাশি, সর্দি দেখা দেয় যার প্রতিকার ঘরোয়া চিকিৎসাতেই মেলে। আদা বা লেবুর রস, কুসুম গরম পানি ইত্যাদিতেই কাজ হওয়ার কথা। ফ্লু এবং ভাইরাস জ্বরের ক্ষেত্রে সাধারণ জ্বরের ওষুধ, কাশির ওষুধ এন্টি-হিসটামিন ইত্যাদির মাধ্যমে চিকিৎসা দেওয়া হয়।’
তবে তিনি পরামর্শ দেন, শিশুর ঠান্ডাজনিত রোগের ক্ষেত্রে একদিন অপেক্ষা করে চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিৎ। শিশুর নিউমোনিয়া অথবা অ্যাজমা আক্রান্তের বিষয়টি একজন এমবিবিএস চিকিৎসক বুঝতে পারবেন এবং তিনি প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে পাঠাবেন। তাছাড়া অ্যাজমার ক্ষেত্রে যেকোনো ভাইরাসজনিত সংক্রমণ ‘ট্রিগার’ হিসেবে কাজ করে ও শিশুর শ্বাসকষ্টের তীব্রতা বাড়ায়। তাই এ বিষয়ে অভিভাবকদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘শিশুদের ঠান্ডা-কাশি বা জ্বরের ক্ষেত্রে একদিন অপেক্ষা করেই একজন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।’