Sunday 01 Jun 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

তাগার গহনায় ফিরে দেখা শিকড়

ফারহানা নীলা
৩১ মে ২০২৫ ১৬:৩৬ | আপডেট: ৩১ মে ২০২৫ ১৬:৪১

কালো সুতা আর ছোট্ট একটি পুঁতির কাজ, কিন্তু তার মাঝেই যেন এক নতুন সৌন্দর্য খুঁজে পাচ্ছেন তরুণীরা। যুগের সাথে ফ্যাশনের ভাষা পাল্টে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। এখনকার নারীরা যেমন আরামকে গুরুত্ব দিচ্ছেন, তেমনি নজর দিচ্ছেন নান্দনিকতাকেও। এই সময়ের এমনই একটি জনপ্রিয় ও ফ্যাশনেবল অনুষঙ্গ হলো— কাইতন সুতা দিয়ে তৈরি গহনা। সাধারণ সুতা হলেও এটি এখন স্টাইল স্টেটমেন্টে পরিণত হয়েছে, বিশেষ করে তরুণীদের কাছে। আর এই কাইতন সুতা আরেক ভাষায় বলা হয় তাগা। আর তাগা দিয়ে তৈরি গহনাকে এক কথায় বলা হচ্ছে তাগামালা।

তাগা বা কাইতন সুতা কী?

কাইতন সুতা মূলত এক ধরনের মজবুত সুতা, যা সাধারণত তুলো কিংবা সিন্থেটিক ফাইবার থেকে তৈরি হয়। এক সময় গ্রামবাংলায় ব্যবহার করা হতো এই কাইতন সুতা। এই সুতার সাথে সৌভাগ্যের কোন একটি বিষয়ও মানতো নানী দাদীরা। এটি সহজে বাঁধা যায়, নরম এবং টেকসই। একসময় যা ঘরোয়া কাজে সীমাবদ্ধ ছিল, তা আজ গহনার উপাদান হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে।

বিজ্ঞাপন

স্টাইল হিসেবে তাগা মালা

এই কাইতন সুতা দিয়ে তৈরি গলার মালা, পায়ের পায়েল, এবং হাতের ব্রেসলেট এখন একটি নির্দিষ্ট স্টাইলের নাম ধারণ করেছে— তাগা মালা। এর ডিজাইন সাধারণ হলেও, তাতে থাকে নানা রঙিন পুঁতি, ঝুনঝুন, ঝুমকা বা ঝিনুক জাতীয় ছোট ছোট অলঙ্কার। এসব উপাদান কাইতন সুতার সাথে মিলিয়ে তৈরি করা হয় এক অনন্য গহনা যা সহজেই নজর কাড়ে।

তাগা মালা—রঙে রঙিন স্বাধীনতা

তাগা দিয়ে তৈরি গলার মালা। সাধারণত এক লকেটের তৈরি এই তাগা মালা। আবার এর সাথে মেলানো হয়, রঙিন পুঁতি এবং একটি ঝিনুকের ঝুলন্ত অংশ। এটি নিছক অলংকার নয়, বরং ব্যক্তিত্ব প্রকাশের একটি মাধ্যম। কলেজগামী ছাত্রীরা থেকে শুরু করে আর্ট-প্রেমী নারীরাও এমন গহনা বেছে নিচ্ছেন, যেটা তাদের অনন্য করে তোলে।

তাগায় তৈরি পায়ের পায়েল—একটি নীরব অভিব্যক্তি

তাগা দিয়ে প্রথমে শুধু গলার মালাই তৈরি করা হত। এখন আধুনিকতার ফ্যাশনে এই তাগা দিয়ে তৈরি হচ্ছে পায়ের পায়েল। হাল ফ্যাশনে এতে যুক্ত করা হয় দুটি রূপালী ঝুমকা, যা হাঁটার সময় হালকা শব্দ তোলে। একদিকে এটি ঐতিহ্যের প্রতীক, অন্যদিকে এটি আধুনিক স্টাইলের অংশ। এটি নিত্যদিনের ব্যবহারেও আরামদায়ক, কারণ এতে ধাতব শৃঙ্খলের চেয়ে অনেক হালকা অনুভূতি থাকে।

তাগা গহনা কেন পছন্দ করছে ফ্যাশন প্রিয় নারীরা?

সহজলভ্যতা ও সাশ্রয়ী মূল্য – তাগা সুতা ও পুঁতি সহজে পাওয়া যায় এবং ব্যয়বহুল নয়।

হালকা ও আরামদায়ক – ধাতব গহনার তুলনায় অনেক হালকা, দীর্ঘ সময় পরে থাকলেও অস্বস্তি হয় না।

নিজেই তৈরি করা যায় – অনেকেই এখন DIY (Do It Yourself) ধারায় নিজে নিজে কাইতন গহনা বানান।

সব ধরনের পোশাকের সাথে মানানসই – শাড়ি, সালোয়ার-কামিজ, ওয়েস্টার্ন ড্রেস—সবটাতেই মানিয়ে যায়।

ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

স্থানীয় শিল্পীরা চাইলে তাগা গহনাকে রপ্তানিযোগ্য পণ্যে রূপ দিতে পারেন। এটি শুধু ফ্যাশনের অংশ নয়, বরং নারীর আত্মপ্রকাশের একটি শিল্পমাধ্যমও হতে পারে। যাদের ঝোঁক আছে হস্তশিল্পের দিকে, তাদের জন্য এটি হতে পারে একটি লাভজনক ক্ষুদ্র উদ্যোগ।

সাদামাটা সুতো আর রঙিন পুঁতির মাঝে কীভাবে উঠে আসে নান্দনিকতার এক অনবদ্য প্রকাশ। সে সম্পর্কে সারাবাংলা’কে জানিয়েছেন ফ্যাশন ডিজাইনার এবং শঙ্খলতা গহনার স্বত্বাধিকার এনামতারা সাকী। তিনি শুধু একজন ডিজাইনার নন, বরং নিজ হাতে গড়া তাগার গহনার মধ্য দিয়ে তিনি গড়ে তুলেছেন এক আত্মনির্ভর শিল্পভুবন। কথা হলো এনামতারা সাকী’র সাথে।

তাগার গহনার প্রতি আগ্রহ কীভাবে শুরু হলো?

ছোটবেলা থেকেই সুতো, ঝিনুক, কাঠের পুঁতি দিয়ে খেলনা গড়ার একটা ঝোঁক ছিল। ধীরে ধীরে বুঝলাম এগুলো দিয়ে শিল্পও সৃষ্টি করা যায়। তাগা আমাদের লোকজ সংস্কৃতির একটা অঙ্গ। আমি শুধু তাকে নতুন ভাবে সাজিয়েছি, যেন শহুরে জীবনের সাথেও মানিয়ে যায়।

আপনার গহনার বৈশিষ্ট্য কী?

আমার প্রতিটি গহনা হাতে তৈরি, তাই প্রতিটা ইউনিক। শাঁখা, ঝিনুক, কাঠ, কাঁথার কাপড়—এইসব উপকরণ দিয়েই আমি মালা, ব্রেসলেট, পায়েল তৈরি করি। কেউ অর্ডার দিলে আমি ওনার স্টাইল, পোশাক আর রঙ পছন্দ বুঝে কাস্টমাইজ করে দিই।

বাজারজাতকরণ কীভাবে করছেন?

প্রথমে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেই শুরু করি। এখন অনলাইন ছাড়াও পরিচিতদের মাধ্যমে অনেক অর্ডার আসে। মাঝে মাঝে এক্সিবিশনেও অংশ নিই। আর এখন অনেকে রাস্তার পাশের স্টল থেকে মালা কিনে আমার মতো ফ্যাশন মিক্স করছে, যা খুবই উৎসাহব্যঞ্জক।

ভবিষ্যতের ভাবনা?

আমি চাই তাগার এই গহনাগুলো শুধু ফ্যাশন নয়, নারীর আত্মপরিচয়ের অংশ হয়ে উঠুক। দেশ থেকে বিদেশেও ছড়িয়ে যাক এর ব্যাপকতা।

তাগা মালা আর তারুন্যের ফ্যাশন

শহরের ফ্যাশন হাটে দেখা গেলো, অনেকেই মুগ্ধ হয়ে তাগা মালা হাতে নিচ্ছেন, আয়নায় মিলিয়ে দেখছেন, আবার হাসিমুখে কিনেও নিচ্ছেন।

সুমনা দে (বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী): ‘আমি খুব সাধারণ পোশাক পরি, কিন্তু একটা তাগার মালা পুরো লুকটাই বদলে দেয়। হাতে বানানো বলেই এর একটা বিশেষ সৌন্দর্য আছে।’

মাহমুদা ইসলাম (ফ্রিল্যান্সার): ‘তাগা আমাদের শেকড়ের সঙ্গে যুক্ত। আমি যখন এই গহনা পরি, তখন মনে হয় আমি আমার সংস্কৃতিকে বয়ে চলেছি। আবার এগুলো ট্রেন্ডিও।’

তাগার গহনা তাই শুধু ফ্যাশনের অনুষঙ্গ নয়, হয়ে উঠছে নিজস্বতা প্রকাশের এক মাধ্যম। পুরাতন ঐতিহ্যের ঘ্রাণ মেখে নতুন প্রজন্ম যেন তাকে আপন করে নিচ্ছে ভালোবাসায়।

সারাবাংলা/এফএন/এএসজি

এনাম তারা সাকি তাগার গহনা শঙ্খলতা